কুমিল্লা হত্যাকাণ্ড: আইনের প্রতি সেনাবাহিনীর অবজ্ঞার নজির
কুমিল্লার এক গ্রামে মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর বিভীষিকাময় অভিযান ও সেনা হেফাজতে এক বাসিন্দার মর্মান্তিক মৃত্যু।
মাত্র ছয় দিন আগে বাবাকে কবরে রেখে এসেছিলেন তৌহিদুল ইসলাম। সপ্তাহ না কাটতেই সে কবরের পাশে তৌহিদুলকেও জায়গা নিতে হবে, এমনটা কেউ ভাবেননি। গত ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার প্রয়াত পিতার স্মরণে কুলখানির প্রস্তুতি চলছিলো তাঁদের বাড়িতে। সকাল থেকে সমবেত হচ্ছিলেন প্রতিবেশি ও দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু দুপুরের পরপরই কুলখানির স্বাভাবিক ভাবগম্ভীর পরিবেশে ছেদ পড়ে। শোকের পরিবেশ আরও কয়েকগুণ ভারি হয়ে ওঠে। সমবেত স্বজনদের অংশ নিতে হয় দ্বিতীয় জানাজায়। আর সে জানাজা ছিলো স্বয়ং তৌহিদুলের। তৌহিদুল ছিলেন বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজন কর্মী।
চল্লিশ বছর বয়সী তৌহিদুল চার কন্যাসন্তানের বাবা, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জনের বয়স মাত্র চৌদ্দ। তিনি চট্টগ্রামে একটি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করতেন। বাবার দাফনকার্য তদারকি করতে এসেছিলেন কুমিল্লার বাড়িতে। দাফন শেষে সেদিন সন্ধ্যায় পিতৃশোক বুকে নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন তিনি। সেই রাতই যে তাঁর জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে, তা তিনি জানতেন না। মধ্যরাতের কিছু পরে, বাড়িতে এসে হাজির হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয় পরিবারের লোকজনদের।
"আমরা ঘুমাচ্ছিলাম"— তার বড় বোন শাহিনুর আক্তার মীনা ওই রাতের কথা স্মরণ করছিলেন। "হঠাৎ, দরজায় জোরে ধাক্কাধাক্কি হয় এবং সেনাবাহিনীর পোশাক পরা প্রায় সাত-আটজন লোক হুমড়ি খেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সাদা পোশাক পরা দুজন ছিলেন। এরপর তারা বিছানার কাথা-কম্বল ফেলে দিতে শুরু করে, ভেতরের রুমে আমাদের মেয়েরা ঘুমাচ্ছিল। ওদের গায়ের কম্বলও ফেলে দেয়। তাদের বলেছিলাম, আমাদের মেয়েরা ভেতরে আছে, আপনারা এতো রাতে এভাবে ঢুকতে পারেন না। তারা আমাদের কোনো কথাই শোনেনি। উনাদের সাথে কোনো মহিলা অফিসার ছিল না।”
পরিবারের সদস্যদের মতে সেনা সদস্যরা কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই প্রবেশ করেছিল। সম্ভবত তারা অস্ত্রের খোঁজ করছিল, যা কখনই সেখানে ছিল না। মীনা বলেন, “সেনাবাহিনীর যারা এসেছিলেন তাদের চেহারা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। শুধু তাদের চোখ এবং কপাল দেখা যাচ্ছিল। তারা কেউ তাদের নাম পরিচয় বলেননি কিংবা কোনো কাগজপত্রও দেখাননি। আমাদের সবার ফোন কেড়ে নেয়, তারপর তৌহিদুলের চোখ বেঁধে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়।”
মীনা স্মরণ করে বলছিলেন, তৌহিদুলের বিধবা স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার সৈন্যদের অনুনয় করে বলছিলেন, "আমরা আপনাদের বিশ্বাস করি। দয়া করে তার কোনো ক্ষতি করবেন না।" তখন একজন সেনাসদস্য জবাবে তাকে বলেছিল, "আমরা উনাকে যেভাবে নিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।”
সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করেননি।
এক ডজনেরও বেশি প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণে উঠে আসে সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা। সেনাবাহিনী যখন গ্রামে ঢুকে পড়ে, তারা লাঠি দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের নির্বিচারে মারধর করে। তৌহিদুল ছিলেন নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে আটকদের একজন। সেনা সদস্যরা সেদিন অন্তত তিনজন ব্যক্তিকে আটক করেছিল এবং চোখ বেঁধে কুমিল্লার উপকণ্ঠে একটি অস্থায়ী বন্দিশালায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তাদের নির্মমভাবে পেটানো হয়। সকাল নাগাদ স্থানীয় পুলিশ নদীর তীরে অজ্ঞাতনামা একটি লাশ পড়ে থাকার খবর পায়। সেটি ছিল তৌহিদুল ইসলামের লাশ।
বাংলাদেশের দুইজন বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞের মতে, সেই রাতে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড বেশ কয়েকটি আইন গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে হেফাজতে নির্যাতনের ফলে মৃত্যু, বেআইনি গ্রেপ্তার এবং আটক, যা বলপূর্বক অন্তর্ধানের সমতুল্য এবং দেশের ফৌজদারি কার্যবিধির একাধিক বিধানের লঙ্ঘন। এর প্রেক্ষিতে কেবল একজন সেনা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার ঘটনাকে বিশেষজ্ঞরা কেবল লোকদেখানো শাস্তি হিসেবে মনে করছেন।
দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হতে থাকে। গণঅভ্যুত্থানকালে বিক্ষোভ দমনে নৃসংশ অবস্থান নেওয়ার কারণে অভ্যুত্থানপরবর্তী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছিল। এ অবস্থায় জাতীয় প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে ব্যাপক বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামায় মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসন।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তৃত্ব গ্রহণের পর থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী যে “যৌথ বাহিনীর অভিযান” শুরু হয়, সেই অভিযান চলাকালে অন্তত নয়টি মৃত্যুর ঘটনায় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এই পরিসংখ্যানটি নেত্র নিউজের প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত একটি পরিসংখ্যানের সাথে মিলে যায়।
সরকারি বিবৃতিতে এই মৃত্যুর জন্য স্ট্রোক বা বন্দুকযুদ্ধকে দায়ী করা হয়েছে। হাসিনার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যার পর এ ধরনের বিবৃতি দেওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম থেকেই এসবের নিন্দা করে আসছিল। কিন্তু শোকাহত পরিবার এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা সরকারির বিবৃতির বাইরে ভিন্ন গল্প বলেছে। তাদের অভিযোগ, যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনেই এসব অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নবিদ্ধ ও বিপর্যস্ত পুলিশও অভিযানের এ ধরনের পদ্ধতি সাধারণত এড়িয়ে চলে।
এসব বিষয় নিয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ই-মেইল করা হয়। কেউই ই-মেলের মাধ্যমে পাঠানো নেত্র নিউজের প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
অপ্রশিক্ষিত বাহিনীর হাতে সীমাহীন ক্ষমতা
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, সেনাবাহিনীর আক্রমণাত্মক আচরণের কারণ তাদের হাতে থাকা সীমাহীন কর্তৃত্ব।
প্রচলিত আইনের অধীনে পুলিশই সাধারণত আইন প্রয়োগের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং বেশিরভাগ তল্লাশি বা গ্রেপ্তারের জন্য বিচারিক পরোয়ানা পেতে পারে। তবুও, যেহেতু সেনা কমান্ডাররা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করতে পারেন, তাই তাদের আদৌ কোনো পরোয়ানার প্রয়োজন কি না তা স্পষ্ট নয়।
"এটি বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে যে ক্ষমতার বিভাজন থাকে তাকে কার্যত বাতিল করে দেয়”— শাহদীন মালিক নেত্র নিউজকে বলেন।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, সাধারণ পরিস্থিতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের থেকে আলাদা এবং শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট এখতিয়ারের মধ্যে বিচারিক ক্ষমতা রাখেন। বিপরীতে, "সমগ্র সেনাবাহিনীকে কোনো আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে"— যোগ করেন মালিক।
তা ছাড়া রয়েছে সেনাবাহিনীর গোপনীয়তা এবং অস্বচ্ছতার দীর্ঘস্থায়ী সংস্কৃতি।
অ্যাডভোকেট মালিক উল্লেখ করেন যে, সাধারণত, ম্যাজিস্ট্রেটদের একটি সরকারি গেজেটের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়। “এই ক্ষেত্রে (সেনা বাহিনীতে যাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে), কোনো পাবলিক রেকর্ড নেই। সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এমনকি আমরা এও জানি না যে, এই ক্ষমতা কার কার হাতে আছে। তাদের নাম কী, তারা কার কাছে দায়বদ্ধ।”
তাঁর যুক্তি — এর ফলে কর্তৃত্ব এতটাই সুদৃঢ় হয়েছে যে, পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটরাও এর আগে এ ধরনের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। এবং এই অসাধারণ ক্ষমতা এখন এমন একটি সামরিক বাহিনীর হাতে ন্যস্ত যারা বেসামরিক কর্তৃত্বকে সম্মান করতে অভ্যস্ত নয়। অথচ তাদের হাতেই এই ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
দেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতার উৎস হলো দেশের ঔপনিবেশিক যুগের ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি)। এই কার্যবিধির সব বিধান সম্পর্কে সেনাবাহিনী যথাযথভাবে ওয়াকিবহাল নয় এবং মেনে চলার ক্ষেত্রেও অভ্যস্ত নয়।
তৌহিদুলের বোন মীনার বর্ণনার কথা উল্লেখ করে জ্যোতির্ময় প্রশ্ন তোলেন, "তাদের মুখ ঢেকে কেন মানুষের ঘরে প্রবেশ করতে হলো? সিআরপিসিতে স্পষ্ট বলা আছে এই ধরনের রেইডে গেলে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে— আমার নাম অমুক, আমি এই ডিভিশন থেকে এসেছি এবং আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই ব্যাটালিয়নের একজন কর্মকর্তা। আমাকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং আমি এখানে এসেছি, কারণ এই অপরাধের সাথে সম্পর্কিত একটি অভিযোগ রয়েছে।”
"যদি তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে প্রবেশ করেন তাহলে তাদের অবশ্যই একটি অনুসন্ধান পরোয়ানা থাকতে হবে এবং তা প্রদর্শন করতে হবে। এটি একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা” — যোগ করেন জ্যোতির্ময়।
সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, এখানে বেআইনি তল্লাশি এবং জব্দ নিষিদ্ধ। "সেনাবাহিনীও সংবিধান দ্বারা আবদ্ধ; তারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তারা অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করতে পারে না এবং তারা যথাযথ প্রক্রিয়াও উপেক্ষা করতে পারে না।"
তিনি ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫২ ধারার দিকেও ইঙ্গিত করেন, যেখানে বলা হয়েছে, একজন মহিলা সন্দেহভাজনকে কেবল একজন মহিলা অফিসার দ্বারা তল্লাশি করতে হবে। সেই রাতে এই আইন উপেক্ষা করা হয়েছিল।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও প্রশ্ন তোলেন, কেন পুরো পরিবারের ফোন জব্দ করা হয়েছিল যখন কথিত অপরাধে কেবল তৌহিদুলের কাছেই অবৈধ অস্ত্র থাকার কথা ছিল।
ধারাবাহিক নির্যাতন
ওই অভিযান যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের বাইরে আরও গুরুতর প্রশ্ন হল তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যু এবং এর ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি।
নেত্র নিউজের সাংবাদিকরা যখন কুমিল্লায় তৌহিদুলের বাড়িতে পৌঁছান, তখন স্থানীয় বাসিন্দারা সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং একটি কথা বারবার বলেন— তাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে পোস্টারে পোস্টারে ন্যায়বিচার দাবি করে লেখা ছিল— "তৌহিদুলকে নির্যাতন করা হয়েছে... তৌহিদুলের হত্যার বিচার হোক।"
নেত্র নিউজ তৌহিদের ৩০ বছর বয়সী চাচাতো ভাই আবু তাহেরের সঙ্গে কথা বলে, যিনি বলেছিলেন যে, তাকেও সেই রাতে নির্যাতন করা হয়েছিল। তার ভাষ্য, তিনি তৌহিদুলের বাবার মৃত্যু উপলক্ষে পরের দিনের কুলখানির জন্য রান্নার কিছু জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়েছিলেন। বাড়ি ফেরার পথে সেনা সদস্যরা তাকে থামায় এবং সেখানেই মারধর করে। এতে তার পিঠ, বুক এবং পায়ে ক্ষত হয়। ছয় দিন পরে যখন নেত্র নিউজ তার সাক্ষাৎকার নেয় তখনও তাহের সোজা হয়ে বসতে পারছিলেন না।
“আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না”, তিনি বলছিলেন। “আমার শরীরের যে অংশই বিছানার সাথে লাগে সেখানে ব্যথা হয়। মনে হয় আমার জান ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।”
এলাকার লোকজন তার বর্ণনাকে সমর্থন করে বলেছেন, সেনাবাহিনীর টহলদাররা খাস বাংলায় গালিগালাজ করতে করতে রাস্তায় নির্বিচারে লাঠি দিয়ে মানুষকে মারধর করেছে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার কাছে এই ধরনের লাগামহীন সহিংসতা স্পষ্টতই বেআইনি। “সংবিধান নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ করে। এমনকি সেটা সন্দেহভাজনদের জন্যও।”
তিনি বলেন “এলোমেলোভাবে পথচারীদের মারধর ক্ষমতার একটি স্পষ্ট অপব্যবহার।”
তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের নির্যাতনবিরোধী আইন স্পষ্টভাবে মানসিক যন্ত্রণাকে নির্যাতনের একটি রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। “ভয় দেখানোর জন্য অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে তারা একটি ফৌজদারি অপরাধ করেছে”, বলেন তিনি।
নেত্র নিউজ তৌহিদুলের আরেক প্রতিবেশী লুৎফর রহমানকে (৪২) খুঁজে বের করে। তিনি বলেন, মাদক ব্যবসার সন্দেহে তাকেও সেই রাতে আটক করা হয়েছিল। প্রতিবেশীরা অভিযোগটিকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেন। লুৎফর জানান, তাকে তার বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে কুমিল্লার উপকণ্ঠে গোমতী নদীর কাছে রাস্তার ধারে একটি ছোট ডেরায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তার সাথে তৌহিদুলের দেখা হয়।
"আমি যখন পৌঁছাই, তখন তৌহিদুল সেখানে ছিল"— লুৎফর বলছিলেন। "তারা আমার চোখ বেঁধেছিল, আমি তখনও গাড়িতে ছিলাম। কিন্তু আমি তার (তৌহিদুলকে) চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সে বলছিল, “আমি কিচ্ছু করিনাই আমারে আর মাইরেন না।”
“এক বা দুই ঘণ্টা ধরে এরকম চলেছিল"— বলেন লুৎফর। এক ঘণ্টা পর লুৎফরের চোখ খোলা হয়।
"তৌহিদুল খুব বেশি আহত হয়েছিল, দাঁড়াতে পারছিল না। আমার সামনেও তারা (সেনা সদস্যরা) বেশ কয়েকবার তৌহিদুলকে লাঠি দিয়ে মারধর করে এবং বুট দিয়ে লাথি মারে। তারপর তারা আমাদের ফজরের নামাজ পড়তে বাধ্য করে। তৌহিদুল নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিল না… কিন্ত আর্মির লোকজন ওরে ইমামতি করতে বাধ্য করে।”
নামাজের আগে শরীর পরিষ্কার করার ইসলামী রীতিনীতির কথা উল্লেখ করে লুৎফর বলেন, "ওজু করার জন্য তৌহিদুলকে আমার কাঁধে ভর করে নিচে নামাতে হইছিলো।”
লুৎফর বলেছিলেন যে, অন্য একজন আটক ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, যাকে তিনি চিনতে পারেননি। একাধিক স্থানীয় ব্যক্তিও এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। নেত্র নিউজ ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে পারেনি।
জ্যোতির্ময় যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আটক ব্যক্তিদের বৈধ আটককেন্দ্র বা পুলিশ স্টেশনের পরিবর্তে অন্য কোনো আশ্রয়স্থলে নিয়ে যাওয়া অবৈধ ও গোপন আটক, যা আইন অনুযায়ী বিশেষভাবে নিষিদ্ধ।
তিনি বলছিলেন, সেনা ক্যাম্প, সেনানিবাস বা পুলিশ স্টেশন সবকিছুই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি। "যদি তারা প্রোটোকল অনুসরণ করেন তবে তাকে কেন একটি পরিত্যক্ত স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে? এমন কি চিহ্নিত দাগী অপরাধীদেরও সাংবিধানিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। গোপন স্থানে আটকে রাখার ক্ষেত্রে কোনো সাক্ষী থাকে না, কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে না।”
তিনি বলেন, "চোখ বেঁধে রাখা বলপূর্বক অন্তর্ধানের কৌশল। যাতে আটক ব্যক্তি কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা বুঝতে না পারে। আটকককৃত ব্যক্তি এবং তার পরিবারের অধিকার তার অবস্থান সম্পর্কে জানা।”
কয়েকদিন পরে নেত্র নিউজ যখন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, তখন সাংবাদিকরা লুৎফর যে স্থানে তৌহিদুলকে চিনতে পেরেছিলেন সেখানে নতুন বুটের ছাপ এবং টায়ারের দাগ দেখতে পান।
কাছাকাছি একটি প্ল্যান্ট নার্সারির তিনজন কর্মী জানিয়েছেন যে, তারা সেই সন্ধ্যায় চারটি সামরিক গাড়ি আসতে দেখেছেন। তাদের সেখান থেকে চলে যেতে এবং এক ঘণ্টা পর ফিরে আসতে বলা হয়েছিল।
লুৎফর বলেন, ফজরের নামাজের কিছু পরে তৌহিদুলকে রেখে সেনাবাহিনী তাকে অন্যত্র নিয়ে যায়। লুৎফর তাকে তখন শেষবারের মতো জীবিত দেখতে পেয়েছিলেন।
পরদিন সকাল ১১ টার দিকে কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানতে পারে, গোমতী নদীর তীরে ঝাকুনিপাড়ায় একজন আহত ব্যক্তি পড়ে আছে। পড়ে থাকা ব্যক্তি যে তৌহিদুল, পুলিশ ঘনাস্থলে গিয়ে নিশ্চিত হয়।
কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিনুল ইসলাম বলছিলেন, "আমাদের অফিসাররা তাকে দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।”
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, সেই রাতে এলাকায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে অভিযান হচ্ছিল সে ব্যপারে অবহিত করা হয়নি। অথচ সেটি ছিল একটি যৌথ অভিযান।
সাক্ষীর বক্তব্য এবং শারীরিক নির্যাতনের আলামতের পরিপ্রেক্ষিতে, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, ঘটনাটি স্পষ্টতই হেফাজতে মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়। "তিনি সেনাবাহিনীর হেফাজতে ছিলেন, তাই এটি একটি হেফাজতে হত্যাকাণ্ড। প্রাথমিক গ্রেপ্তার থেকে শেষ নির্যাতন পর্যন্ত জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির বেসামরিক আদালতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” তিনি বলেন, "এটি একটি অপরাধমূলক বিষয়, সামরিক বিষয় নয়।"
যদিও বাংলাদেশী আইনে এ ধরনের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু কোনও তদন্ত হয়নি। পরিবর্তে সেনাবাহিনীর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অভ্যন্তরীণ তদন্তের জন্য শুধুমাত্র একজন অফিসারকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ ধরনের প্রতিক্রিয়াকে যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন। বলেন, "এটি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার অধীনে একটি বেসামরিক অভিযান ছিল, যার পরিণতি হেফাজতে মৃত্যু। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন, ২০১৩-এর অধীনে সমগ্র চেইন অফ কমান্ডকে জবাবদিহি করতে হবে।"
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী শাহদীন মালিক জ্যোতির্ময়ের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। "পেশাদার অসদাচরণ প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে, কিন্তু জীবন নেওয়া একটি অপরাধ।" তিনি বলেন, "এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এই ধরনের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাকে অবশ্যই বেসামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।"
সেপ্টেম্বরে উত্তর গাইবান্ধা জেলায় সেনা সদস্যরা দুজনকে নির্যাতন করেছে এবং নির্যাতনে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নেত্র নিউজ প্রতিবেদন করেছে যে, চার মাস পরে স্থানীয় আদালতে কিছু সেনা সদস্য এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলে, এসব ঘটনায় আদালতের মাধ্যমে জবাবদিহিতার নজির খুব কমই আছে।
বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে সেনাবাহিনীর একই রকম কর্তৃত্ব প্রয়োগের সর্বশেষ উদাহরণ ছিল ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিন হার্ট। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ৮৪ দিনেরও বেশি সময় ধরে হাজার হাজার লোককে আটক করা হয়েছিল এবং কমপক্ষে ৫৭ জন হেফাজতে মারা গিয়েছিল। রাস্তা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের প্রাক্কালে সরকার “যৌথ অভিযান ক্ষতিপূরণ আইন ২০০৩” প্রণয়ন করে, যাতে সেনাবাহিনীসহ অভিযান পরিচালনাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিষিদ্ধ করে।
ওই আইনে বলা হয়েছে, "যদি কেউ ২০০২ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযানের কারণে মারা যায়, আহত হয় বা সম্পত্তির ক্ষতি হয়, তাহলে কোনো আদালতে কোনো মামলা দায়ের করা যাবে না।"
শাহদীন মালিক এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, "ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া উচিত নয়।"
কুমিল্লায় তৌহিদুলের বিধবা স্ত্রী এখনও অসহায়। বলছিলেন, “সে কোনো অপরাধী ছিল না। তার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। সে কেবল আমার স্বামী ছিল, আমাদের মেয়ের বাবা এবং তারা তাকে হত্যা করেছে।”
শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পোস্টারগুলোর প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, “আমি শুধু ন্যায়বিচার চাই।”