ডাকসু নির্বাচন কি রাজনীতির নতুন গতিপথের সূচনা করলো?

ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের জয় চমক সৃষ্টি করলেও অনেকে বিস্মিতও হয়েছেন। যে ক্যাম্পাসে সংগঠনটি অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় প্রায় অচ্ছুৎ ছিল তারা এমন ভূমিধ্বস জয় কীভাবে ছিনিয়ে আনলো তার কারণ খুঁজছেন অনেকে।

ডাকসু নির্বাচন কি রাজনীতির নতুন গতিপথের সূচনা করলো?
ছবি: সুবিনয় মুস্তফী ইরন/নেত্র নিউজ

বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ কিংবা অচ্ছ্যুৎ হিসেবে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আঁতুড়ঘর হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সর্বজনবিদিত। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনটি এখানে নানাভাবে নানা মহল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসেছে। অথচ ২০২৫ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে  ছাত্রশিবির নিরংকুশ বিজয় অর্জন করেছে। ভিপি, জিএস, এজিএসসহ প্রায় প্রতিটি আসনে শিবির কিংবা তাদের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট জয়লাভ করেছে। শিবিরের অপ্রতিরোধ্য জয়ের পাশাপাশি ছাত্রদলের একটি আসনও না পাওয়া এবং জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী প্যানেলের ভরাডুবি চমকে দিয়েছে সবাইকে। বলা যায়, বিস্মিত করেছে।

ডাকসুর পরপরই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনেও ফলাফল প্রায় একইরকম। যদিও সেই নির্বাচনটি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবির জিতেছে। শিবিরের শক্ত ঘাটি বলে পরিচিত এই দুই ক্যাম্পাসে ছাত্রদল অন্তত কিছু পদে জিতেছে। তবে ডাকসু নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা, উদ্বেগ, উল্লাস তা অন্য নির্বাচনগুলোর বেলায় হয়নি। ফলত, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল, রণকৌশল এবং এর পরবর্তী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করলে তা থেকে গোটা দেশের ছাত্ররাজনীতি এবং জাতীয় নির্বাচনসহ জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব কেমন পড়তে পারে তা ধারণা করা যাবে। 

শিবিরের ভূমিধস বিজয়ে অনেকে বিস্মিত হলেও, নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে জাকসুর মতো ডাকসুতে শুরুতে তেমন আলোচনা হয়নি। বেশিরভাগ মহলই নির্বাচনটিকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি প্রগতিশীল শিক্ষকদের প্ল্যাটফর্ম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কও একে গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তবে দিন যত গড়িয়েছে, এ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। ব্যালট পেপার ছাপানো নিয়ে অস্বচ্ছতা, প্রশাসনের অস্পষ্ট জবাব এই সন্দেহ বাড়াচ্ছে। তবে সেই আলাপে যাওয়ার আগে ডাকসু নির্বাচনের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। 

বাংলাদেশে নির্বাচন একটি বড় উৎসব। ফলে হাসিনার পতনের পর শুধু গণতন্ত্র রক্ষায় নয়, এই উৎসবের আমেজ ফিরিয়ে আনার খাতিরেও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি মানুষের বিপুল আগ্রহ আছে। তার চেয়েও জরুরি বিষয়, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। দলগুলো জানে না এখন কার জনপ্রিয়তা কতুটুকু, ভোটাররা কী চায়, কীভাবে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। শুধু তাই না, এই দেড় দশকে বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় বড়সড় পরিবর্তন এসেছে, যা সাধারণ মানুষের মানসপটে এবং জাতীয় রাজনৈতিক পরিসরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করেছে। 

প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উত্থানে দুনিয়ায় এখন এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের ব্যবধান নজিরবিহীন। ইন্টারনেট বিশ্বায়নের যুগে জন্ম নিয়ে এআইয়ের উন্নতির সময়ে বড় হতে থাকা জেনজিদের আকাঙ্ক্ষা বা মন পড়তে পারা দূরের কথা, তাদের ভাষা পর্যন্ত বুঝতে পারছেন না পূর্বতনরা। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম এবং উপায়গুলো নিয়ে মুরব্বিরা দিশেহারা। নিওলিবারেল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্রমশ ভাঙন তরুণদেরকে এক ক্রোধান্বিত, ক্ষ্যাপাটে, মরিয়া প্রজন্মে পরিণত করেছে।

প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবস্থাগুলো বহু আগেই ভেঙে পড়েছে। পারিবারিক বন্ধনের রূপ বদলে গেছে, সামাজিক কাঠামোতে ফাটল ধরেছে। এই শূন্যস্থানগুলো দখল করে নিয়েছে বাজার, যে বাজার সমাজ বা পরিবারের মতো আশ্রয় দেয় না। বাজার রুথলেস, নির্মম। বাজার কেবল মুনাফা বোঝে, আর বাজার বোঝে প্রতিযোগিতা। বাজার হচ্ছে সারভাইভাইল অফ দ্য ফিটেস্টের বাস্টার্ডাইজেশন। এই ব্যবস্থায় শ্রম শোষণও ধারণ করেছে সবচেয়ে নিষ্ঠুর রূপ। একদিকে এআইয়ের প্রতাপে মানুষের চাকরি হারানোর হুমকি, অন্যদিকে শ্রমিকের কোনোরকম দায় না নিয়ে, শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে পুঁজিবাদ এখন গিগ ইকোনমির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। লাখো লাখো ফুড ডেলিভারি পারসন পাঠাও আর উবার চালকেরা টিকে থাকার তাড়নায় অস্থির সময়ে অনিশ্চিততম জীবিকা আঁকড়ে জম্বির মতো ছুটে চলেছেন। 

অস্থিতিশীল এই সময়ে, চরমতম অসাম্যের এই যুগে রাজনীতিও কিম্ভুতকিমার চেহারা ধারণ করেছে। বস্তুগত, সাম্য আর মানবিকতার রাজনীতির বদলে শ্বাপদসংকুল অরণ্যের মতো মানুষের এই দুনিয়ায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে হিংসা, বিদ্বেষ আর বায়বীয় চেতনার জিঘাংসা। গত শতকে, দ্য গ্রেট ডিপ্রেশনের পর টালমাটাল সময়ে দুনিয়া দেখেছে এই উন্মত্ত জিঘাংসা কীভাবে বিশ্বযুদ্ধ ডেকে এনেছে, ঘটিয়েছে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থেই এগুলো করতে দিয়েছে। এই শতকে আরো জটিল, আরো অস্থির সময়ে পরিস্থিতি ভয়াবহতর হবে বলেই আশংকা। আর এই সময়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোই না, নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা, অপতথ্য, আর মুহূর্তেই সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা পরিস্থিতির সংকটকে আরো জটিল করে তুলছে। ক্ষিপ্ত, উদ্ভ্রান্ত দুনিয়া প্রতিদিন ঘৃণা উৎপাদন করতে করতে হয়ে উঠছে বিস্ফোরণোন্মুখ এক বিক্ষুব্ধ আগ্নেয়গিরি। 

এই পরিস্থিতিতে পোয়াবারো অবস্থা ঘৃণা ও বিভাজন ছড়ানো অতি দক্ষিণীদের। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর নরেন্দ্র মোদীদের মতো ঘৃণাবাদীরা মসনদে আসীন হচ্ছেন, লোকরঞ্জনবাদের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষ আর গণতন্ত্র। দুনিয়ার এই বাস্তবতা থেকে খুব দূরে নয় বাংলাদেশ। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ আর প্রগতির নামে হাসিনার দীর্ঘ অপশাসন, প্রতিবেশী ভারতের শক্তিশালী হিন্দুত্ববাদ আর ছোট প্রতিবেশীদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এদেশের মানুষকে আরো অস্থির, নিরাপত্তাহীন, উত্তেজিত করে তুলছে। সেই সঙ্গে আছে চরম আর্থিক বৈষম্য আর সমাজের নানামাত্রিক ফাটল - আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক। বাংলাদেশি তরুণ, তা সে গ্রামের গরিব ঘরের সন্তান হোক কিংবা শহরের সুবিধাভোগী পরিবারের, সবার মোক্ষ হয়ে উঠেছে এই দেশ ছেড়ে পালানো। কেউ ভূমধ্যসাগর পার হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, কেউ কফিলের ছেলে হয়ে ঊষর মরুভূমিতে ষান্ডা শিকারের নিষ্ঠুর জীবনে আবার কেউ মেধার জোরে পশ্চিমা দেশে আপাত উন্নত জীবনের আশায়। রাজনীতিবিদদের একটা অংশ অশ্লীলতম লুটপাটের মচ্ছবে গরিব দেশকে শুষে ধনী দেশে গড়ছে বেগমপাড়া। আর যারা এই দেশে আটকা পড়ছে, সেইসব মানুষেরা, দুনিয়ার অন্য শ্রমিক শ্রেণির মানুষের মতোই অক্ষম ক্রোধে উন্মত্ত। ধর্মের নামে, জাতির নামে, জাতের নামে ছড়ানো ঘৃণার রাজনীতির বেসাতির সহজতম ক্রেতা এরাই। কাঠামোগত বৈষম্য আর অবিচারে উদ্ভ্রান্ত এই নিপীড়িত মানুষেরা দিনবদলের অলীক স্বপ্নের হাতছানিতে নিজেদের ক্রোধের দিশা খোঁজে ঘৃণা আর ধ্বংসের মাঝে। তরুণদের, যাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ভবিষ্যতের আশা, এই ডায়াস্টোপিয়ান সময়ে তারা তাই সবচেয়ে বেশি যেন দিশেহারা, উন্মত্ত। 

তবে কি জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোর উত্থান এইসব কারণেই? ডাকসু বিজয়ের রহস্যের মূলে কি এসব ভাঙনই? মোটাদাগে হয়তো হ্যাঁ। তবে, শুধু এই অস্থির, ভঙ্গুর অবস্থাই একমাত্র কারণ নয়। আর ডাকসু দিয়েই গোটা বাংলাদেশ হয়ত বোঝাও যাবে না। 

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরশাসনে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনা বেচে এন্তার লুটপাট পুরো একটা প্রজন্মকে এই চেতনার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তরুণ সমাজের পোস্ট-আইডলজিতে আক্রান্ত হওয়া। দীর্ঘদিন ধরে এদেশে ‘আই হেইট পলিটিক্স’ মতাদর্শ ছড়িয়েছেন এই দেশের তথাকথিত একটি প্রগতিশীল অংশ, বিরাজনীতিকরণের এই প্রোপাগান্ডায় তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মতাদর্শ ও রাজনীতির প্রতি অনীহা। তদুপরি এই তরুণদের যেহেতু সমাজের দায় থেকে ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, ফলে যেকোনো মতাদর্শের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা ধারণ করাটাই এদের কাছে সবচেয়ে যৌক্তিক মনে হয়। 

আইরনি হচ্ছে, এই মতাদর্শিক বিতৃষ্ণার সুবিধা নিয়েছে অতি দক্ষিণীরা। কারণ, প্রগতিশীল তরুণদের বিছিন্ন করে ফেললেও, সমাজের নিচু তলার বাসিন্দারা এখনো ধর্ম, জাতীয়তাবাদের মতো ব্যাপারগুলোকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের অস্তিত্বের মানে খুঁজে চলে। ‘ধর্ম জনতার জন্য আফিম’—-   মার্ক্সের এই বাক্যংশটি বহুল ব্যবহার হলেও, পুরো বাক্যে তিনি বলেন যে, এই আফিম হচ্ছে, শোষিতের সংস্কৃতি, হৃদয়হীন দুনিয়ার হৃদয় আর আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। 

ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাটাও বোঝা জরুরি। একসময় গোটা দেশের মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাতিঘর হিসেবে দেখতো। মানুষের আশা থাকতো, তাদের করের টাকায় পড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দেশের হাল ধরবে, দিকনির্দেশনা দেবে। আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে দেশের সেরা মেধাবীরাই এখানে পড়তে আসতো তখন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক দলগুলো স্রেফ ক্যাডার তৈরির কারখানা বানিয়েছে, শিক্ষকদের বানিয়েছে দলীয় ধামাধরা। আহমেদ সফা তার গাভী বিত্তান্তে ব্যঙ্গ-রসাত্মকভাবে এই অবস্থা দেখিয়েছেন। দিনে দিনে সেই অবস্থার ক্রম অবনতি হয়েছে। ফলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার জৌলুস হারিয়েছে। হাসিনা পতনের আন্দোলনে অবস্থানগত কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একধরনের কেন্দ্রিকতা উপভোগ করলেও এই আন্দোলনটি শ্রমিক-জনতার সাথে মিলে করেছে মূলত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাই। তারা মাঠে নেমেছে, জীবন দিয়েছে। আবার যখন ক্ষমতার পিঠার ভাগ শুরু হয়েছে, তাদের অধিকাংশই নীরবে নিজেদের পুরনো জীবনে ফিরে গিয়েছে। এই ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের, যাদের একসময় স্বপ্ন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন স্বাধীন দেশ গড়ার— ‘বাংলাদেশ ড্রিম’ । কিন্তু এরা এখন সামর্থ্যর বাইরে গিয়ে হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিচ্ছে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কেন্দ্র থাকছে না। 

নিওলিবারেল পুঁজিবাদের নতুন দুনিয়ায় ছাত্ররাজনীতি এক ধরনের বিলাসিতা। দলীয় ক্যাডার হয়ে ভবিষ্যত বাজি রেখে আখের গোছানো আর নেহায়েত অতি স্বপ্নালু হয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা ছাড়া এখানে সময় ও শ্রম দেওয়ার সুযোগ বাকিদের নেই। প্রচণ্ড চাপের বাজারে ক্যারিয়ারের সিঁড়িতে আগেভাগে পা দেওয়ার দৌড়ে থাকাদের জন্য এখানে আসা মানে বাকি জীবনকে অনিশ্চিত করে তোলা। শুধু তাই না, এর জেরে ছাত্রসংসদে কী হচ্ছে না হচ্ছে, এই নিয়েও সম্ভবত উৎসাহে ভাটা পড়ে। মার্কিন নির্বাচন ঘিরে গোটা দুনিয়ার উদ্বেগ থাকলেও অনেক মার্কিনীদেরই যেমন তা নিয়ে তেমন হেলদোল থাকে না, ডাকসুর অবস্থাও অনেকটা ওইরকম হয়ে গেছে। 

এই উদাসীনতা শিবিরের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে। দীর্ঘসময় গুপ্ত রাজনীতি করা (যেই কৌশল আবার ষাটের দশকের বামপন্থীদের মতোই) সংগঠনটিকে অরাজনৈতিক অনেক ভিত দিয়েছে। নানা পরিচয়ে তারা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে পরিচিত হয়েছে, এমনকি ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের প্রচারণাতেও তারা নেতৃত্ব দিয়েছে, যা তাদের জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়েছে। বামপন্থীদের ষাটের দশকের কৌশলের সাথে যুক্ত হয়েছে শিবিরের শক্তিশালী অর্থনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করা শিবিরের জন্য কয়েক দশকের ইগোর প্রশ্ন। এর জন্য সংগঠনটি এন্তার টাকাপয়সা খরচ করতে দ্বিধা করেনি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নিজেদের ইসলামী লেবাস ও পরিচয় যথাসম্ভব মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। পুরুষ নেতারা ভোটের জন্য নারীদের কাছে গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে, হিজাববিহীন নারী এবং অমুসলিমদেরও প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। ফলত, যেইসব কারণে একসময় ছাত্র ইউনিয়নের মতো বাম সংগঠন ডাকসুতে দারুণ ফলাফল করতো, ইসলামী ছাত্রশিবির একইভাবে দারুণ সফল হয়েছে এবার। পার্থক্য হচ্ছে ষাটের দশকে ছিলো লিবারেল রাজনীতির ঢেউ। আর এখন জনপ্রিয়তা লোকরঞ্জনবাদের। 

বিপরীতে, ছাত্রদলের ‘অতি রাজনৈতিক’ চেহারা তাদের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছে। এমনকি, কিছুদিন আগে তাদের একজন কর্মী ক্যাম্পাসেই নৃশংসভাবে খুন হলেও তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে ক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখা যায়নি। ব্যাপারটি কেবল রাজনীতির প্রতি বিরাগই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্নতাবোধেরও ইঙ্গিত দেয়। রাজনৈতিক চেহারার দরুণ তৈরি হওয়া অনাগ্রহ শুধু নয়, রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রস্তুতির অভাবও তাদেরকে পিছিয়ে দিয়েছে। ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচন নিয়েও একেবারেই গোছালো ছিলো না এবার। শত হলেও নির্বাচন একটি কৌশলী ব্যাপার। সেই কৌশলে দরকার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন। ছাত্রদলের নির্বাচনকৌশলে এর দুয়েরই ঘাটতি ছিলো। বরং মধ্যপন্থী, লিবারেল হিসেবে যে ভাবমূর্তি নব্বইয়ের দশকে ছাত্রদলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল জনপ্রিয় করেছিল, সেই কৌশলও শিবির আত্মস্থ করে নিয়েছে। অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধীদেরকে স্রেফ হতবিহ্বল মনে হয়েছে। শিবিরের সাথে অতি মাখামাখি করে একসময় টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে তারা। তদুপরি ডানে যাবে নাকি লিবারেল থাকবে এই দোটানায় সবই তারা খুইয়েছে। অন্যদিকে, নানাভাগে বিভক্ত থাকলেও বামপন্থীরা এদের চেয়ে অনেক ভালো করেছে। এর পিছনে কিছু বামপন্থী নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভূমিকা ছিল, পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতির ধারাও এখানে প্রতীয়মান। নিওলিবারেল ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থায় যখন বড় অংশের তরুণরা ডানদিকে ঝুঁকে পড়ছে, এর বিপরীতে বাম তরফের প্রতিরোধও বাড়ছে। সারা দুনিয়ায় পরিবর্তনের এই স্রোত চোখে পড়ছে। অতীতে বাংলাদেশে বরাবর মধ্যপন্থীরাই নির্বাচনে ভালো করলেও, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় নানাবিধ মেরুকরণ এখানেও শক্তিশালী হচ্ছে এখন। 

তবে এতকিছুর পরেও মাথায় রাখতে হবে যে, ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নহীন ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শিবিরকে সহায়তা করছে বলে যে অভিযোগ, তাদের আচরণে সেই সন্দেহ ক্রমশই শক্তিশালী হচ্ছে। নানা বিশ্লেষণে এ কথা নিশ্চিত যে শিবির এবার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো করতো, কিন্তু এতটা ভালো করা স্বাভাবিক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। 

এরচেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ডাকসুর প্রভাব কতটা জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতিতে পড়বে? এর উত্তর দেওয়া কঠিন। ঐতিহাসিকভাবে, ডাকসুতে আধিপত্য বিস্তার করলেও বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলা জাতীয় নির্বাচনে কখনোই ভালো করতে পারেনি। তবে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারটা আলাদা হতে পারে। অন্যদিকে, যেই মডেলে ডাকসুতে শিবির ভালো করলো তা গোটা দেশে করা সহজ হবে না। ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ভোটারপ্রতি যেই খরচ তারা করেছেন, গোটা দেশে তা করা সম্ভব হবে না। তবে, জামায়াতের শক্তিশালী আর্থিক, প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক পোস্ট ট্রুথ যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর চলমান প্রবল মেরুকরণের প্রবণতা তো আছেই। জাতীয় নির্বাচনে কতটা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করা যাবে সেটাও একটা দেখার বিষয় অবশ্য। 

বৈষম্যবিরোধীদের দল এনসিপির জন্য নিজেদের ঘরেই ডাকসু এক বিরাট ধাক্কা। নতুন দলটির জন্য এই ধাক্কা সামলানো ভীষণ কঠিন হবে। অন্যদিকে, বিএনপির জন্য এই নির্বাচনের পরাজয় একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। যদিও, মধ্যপন্থী এই দলটি এই সতর্ককতার পরেও আদৌ কতটা শুধরাতে পারবে, নির্বাচন ঘিরে কতটা কৌশলী ও কার্যকর হতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আর বামদের জন্য একটা ভালো অনুপ্রেরণা হতে পারে ডাকসু নির্বাচন। চরম এই উত্তেজনায় উন্মত্ত দুনিয়াতেও বামেরা যদি বায়বীয় চেতনার রাজনীতি বাদ দিয়ে ম্যাটেরিয়াল পলিটিক্স নিয়ে মাঠে হাজির থাকতে পারে, তরুণদের বাস্তব আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের জন্য বস্তুগত লড়াই করতে পারে তবে তারা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন। আওয়ামী লীগের অপচ্ছায়া থেকে বের হয়ে, আওয়ামী লীগকেই দেশের প্রগতিশীলতার আদর্শ দেখানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে, নিজেদের শক্তিশালী করার এই সুযোগ বামদের। 

ডাকসু আগের জৌলুস হারিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ম্রিয়মান হয়েছে। তথাপি ডাকসু নির্বাচনের নানাদিক বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক দলগুলো সামনের দিনের জন্য শিক্ষা নিতে পারে। এই নির্বাচনটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বাঁকবদলের সূচনা হতে পারে।●