যেমন হলো ডাকসু নির্বাচন ২০২৫

ছয় বছর পর ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ডাকসু নির্বাচন। নেত্র নিউজের প্রতিবেদকদের ভাষ্যে উঠে এসেছে নির্বাচনের দিনের ঘটনাপ্রবাহ।

যেমন হলো ডাকসু নির্বাচন ২০২৫
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা কার্জন হল কেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ।

সকাল সাড়ে আটটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে নিরিবিলি রাস্তায় ছিল শিক্ষার্থীদের ভিড়। এখানে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে অপেক্ষা করছিলেন তারা। মাত্র ত্রিশ মিনিট আগে, সকাল আটটায় শুরু হয় ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে এগিয়ে ভোট দিতে এগিয়ে যান ভোটাররা। দীর্ঘ ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচনের আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। তাই সবার মুখেই ছিল হাসি।

যদিও গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রতি বছরই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের বিধান রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর বাধায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মাত্র সাতবার এ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল বিতর্কিত। কেন্দ্রীয় সংসদে দুইটি পদ বাদে, বাকি সব পদেই তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নির্বাচিত হয়েছিল। ছাত্রলীগের দখলে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হল, তাই সে নির্বাচন নিয়ে ছিল ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ।

তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন আনন্দিত। যদিও বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছিল তাপমাত্রা, বাড়ছিল অধিকাংশ কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের সারিও। কাউকে চলে যেতে দেখা যায়নি। বরং দেখা গেছে অধীর আগ্রহে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে ছিল ছেলে শিক্ষার্থীদের তিনটি আবাসিক হলের ভোটকেন্দ্র। জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের সারি ছিল বেশ লম্বা। তবে কারো মধ্যেই ক্লান্তি দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা বেশ সকাল থেকে এসেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন ভোট দেওয়ার জন্য।

ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা প্রখর রোদের মধ্যে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ।
লিফলেট ও স্লিপ দেখছেন এক শিক্ষার্থী। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ।
ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে ভোট দিয়ে বের হয়ে ছবি তুলছেন দুজন শিক্ষার্থী। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় আবাসিক হলগুলোর অন্যতম বেগম রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দিচ্ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) অবস্থিত ভোটকেন্দ্রে। ভোটারের সংখ্যা যেহেতু বেশি, অপেক্ষার সারিও ছিল বেশ লম্বা। মাঝে মাঝেই কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পাশাপাশি দেশের প্রধান দুই দলের ছাত্রসংগঠন— ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালট বাক্সের নম্বরসহ লিফলেট দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।

এ সময় এগিয়ে আসেন কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক। তিনি ছাত্রদলের একজনকে লিফলেট বিতরণে নিষেধ করেন। তখন শিবিরের পক্ষেও লিফলেট বিতরণ হচ্ছিল। কিন্তু ওই শিক্ষক তাদের খেয়াল করেননি বলে দাবি করেন। এ নিয়ে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বসেন ছাত্রদলের নেতারা। কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। কয়েক মিনিটের বাগবিতন্ডা শেষে কেন্দ্র ত্যাগ করেন তারা। শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ছাত্রদল সমর্থিত জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ।

এর আগে একজন ভোটারকে আগে থেকে দাগ দেওয়া ব্যালট পেপার দেওয়ার অভিযোগ আসে কার্জন হলে স্থাপিত অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্র থেকে। এ ঘটনার পর অভিযুক্ত নির্বাচনী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। তবে কার্জন হলেও দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষার সারির সামনে একাধিক প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট নম্বরসহ লিফলেট বিতরণ করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে কেন্দ্রের একশ মিটারের মধ্যে এ ধরনের লিফলেট বিতরণের সুযোগ নেই। তবে কোনো কেন্দ্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কেন্দ্র থেকে একশ মিটার দূরত্বের সীমানা আগে থেকে নির্ধারণ না করে দেওয়ায় সে নিয়মের তোয়াক্কা করতে দেখা যায়নি অনেককে।

ভোটকেন্দ্রের একশ মিটারের মধ্যে কোনো ভোটারকে স্লিপ দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও, কার্জন হল কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের ঘিরে ধরে ভোটার স্লিপ ও নিজেদের প্যানেলের কার্ড দিচ্ছিলেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ।

এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোট দিতে আসতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ততক্ষণে ভোটারদের ভোটদানের হার ৭০% ছাড়িয়ে গেছে। ভোট দিয়েছেন এমন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেও জানা গেছে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তুষ্টির কথা।

বিকাল চারটায়, তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয় ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতাও ছিল চোখে পড়ার মত।●