নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আলাপ কতদিন গৌণ থাকবে?

দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাসিককালীন প্রয়োজনীয় সেবা-যত্নের বিষয়টি গৌণ করে দেখার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আলাপ কতদিন গৌণ থাকবে?

একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লেখাটি শুরু করতে চাই। একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগ দিতে ২০১২ সালে পাঁচজনের একটি টিম নেপাল যাচ্ছিলাম। ইমিগ্রেশনের সব ফর্মালিটি শেষ করে কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশ বিমানে চড়ে বসবো তার অপেক্ষায় ছিলাম। লাগেজ ততক্ষণে প্লেনের কার্গো হোল্ডে জমা পড়ে গেছে। এমন সময় ঘোষণা এলো যাত্রার সময় পিছিয়েছে। এদিকে আমার চলছিল পিরিয়ড। ঘণ্টার ফ্লাইট। নেপালে হোটেলে পৌঁছে স্যানেটারি প্যাড বদলে নেওয়া যাবে– সেরকমই প্রস্তুতি নেওয়া ছিলো। এরপর আরো দুই দফায় ঘোষণা এলো– সকাল ১১টার ফ্লাইট বিকেল ৫টায় উড্ডয়ন করবে। এতক্ষণ কীভাবে থাকবো?

এয়ারপোর্টের ভেতর কোথায় স্যানিটারি প্যাড বিক্রি হয় খুঁজতে শুরু করলাম। না, কোথাও নেই। ফার্মেসি তো নেই-ই, জেনারেল স্টোর টাইপ দোকানগুলোতেও নেই স্যানিটারি প্যাড। দুনিয়ার জিনিসপত্রে দোকানগেুলো ভরা থাকলেও স্যানিটারি প্যাড বিক্রি হয় না কোথাও। এরপর হেল্প ডেস্কেও খোঁজ নিলাম। কেউ খোঁজ দিতে পারলো না কোথায় স্যানিটারি প্যাড ‍মিলবে। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করে না বলে সাফ জানিয়ে দিলো। এখনো জানি না না, এয়ারপোর্টে স্যানিটারি প্যাড বিক্রি বা সরবরাহ হয় কি না?

সেদিনের শারীরিক ও মানসিক চাপের পর আমার কেবল মনে হয়েছিল, শুধু এয়ারপোর্ট নয়, যে কোন পাবলিক প্লেস, যেমন শপিং মল, পার্ক, ক্লাব, জনসভাস্থল, বাস-রেল স্টেশন বা নৌযানের জেটি– সব জায়গায় বিনামূল্যে বা সুলভে স্যানিটারি প্যাডের প্রাপ্যতা এবং নারীদের জন্য পৃথক টয়লেট (যেখানে স্থায়ী টয়লেট সম্ভব নয় সেখানে ভ্রাম্যমাণ) থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিত।

এত বছর পরে সেই পুরোনো আলাপ তোলার পেছনে কারণ– বাংলা একাডেমি আয়োজিত এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় স্যানিটারি প্যাড নিয়ে কতিপয় উগ্রবাদী মবের আপত্তি, বাংলাা একাডেমির নতি স্বীকার, অনলাইনে-অফলাইনে মানুষের তীব্র প্রতিবাদ, বিরক্তি ও ক্ষোভের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণের ব্যাপারে বাংলা একাডেমির নির্দেশনা প্রদান।

দুই ঘটনায় একটা বিষয় স্পষ্ট– নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যগত বিষয়টি অদরকারি মনে করেন সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রেণী নির্বিশেষে বিশাল একটি অংশ। সেজন্য এই ইস্যুতে তথা নারী সম্পর্কিত যে কোন ইস্যুতে কোনো পরিকল্পিত চিন্তা ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রয়োজন দেখি না। একই চিন্তার কারণে মব এসে আপত্তি জানালে সাথে সাথে স্যানিটারি প্যাড বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়, স্টল কালো কাপড়ে ঢেকে যায়, স্টল কর্তৃপক্ষ শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন করেনি– এমন অভিযোগ তুলে মব এবং কোম্পানি উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। কিন্তু মূল আলাপটি এখান থেকে হারিয়ে যায়। মূল আলাপ কী আসলে? সেটি হলো– নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা। এটির সঙ্গে মানবশিশুর জন্মের সম্পর্ক। এটি নারীর সেবা পাওয়ার অধিকারের প্রশ্ন। কিন্তু সেখানে যখন নতি স্বীকার করে স্টলই সরিয়ে ফেলা হয় তখন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকারের বিষয়টিই হুমকির মুখে পড়ে। গোপনীয় বিষয় বলে মব কর্তৃক যে ধুয়া তোলা হয়েছিলো তা পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপরীতে দরকার ছিল, যথাযথ বিধি না মানার কারণে জরিমানা করে সেই কোম্পানির কিংবা বাংলা একাডেমির নিজেরই সেখানে পৃথক স্টল স্থাপন করে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা যে একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়, সেটি প্রতিষ্ঠা করা। এখন স্টল সরিয়ে নেওয়ার ফলে মেলায় আগত নারীরা যারা নতুন সার্কুলারটি দেখেননি তাদের পক্ষে জানা সম্ভব না স্যানিটারি প্যাড কোথায় পাওয়া যাবে। অথচ শুরু থেকে স্টলটি মেলায় প্রবেশমুখে ছিল, ঢোকার সময় চোখে পড়তো। আর তাছাড়া, একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আপত্তির বিপরীতে মোক্ষম জবাব হতো যে, স্যানিটারি প্যাড, পিরিয়ড (মাসিক/মেন্সট্রেশন) কোন নিষিদ্ধ বা অপবিত্র বিষয় নয়।

গবেষণার দিকে তাকালে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি কত অবহেলিত তা আরো স্পষ্ট হয়।

‘৪০ ভাগ কিশোরী তাদের মাসিক বা ঋতুচক্রের তিনদিন স্কুল বিরতি দেয়। তিনভাগের একভাগের এই কারণে স্কুলে পারফরমেন্স বাধাগ্রস্ত হয়। এখনও মাত্র ১০ ভাগ কিশোরী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে এবং ৮৬ ভাগ নারী পুরাতন কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করে। মাত্র ৬ ভাগ menstrual hygiene management সম্পর্কে স্কুলে জানতে পারে। এরকম ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসেবা/যত্ন ইত্যাদি তথ্য আছে ২০১৪ সালে করা ‘Bangladesh National Hygiene Baseline Survey প্রতিবেদনে। সেখানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিরিয়ডের সময় সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতার অভাবে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর স্যানিটারি প্যাড বা মাসিকের ব্যবহৃত ন্যাকড়া পরিবর্তনের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে নারীরা বেশি স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন এবং শহর বা নগরের বাইরের বেশির ভাগই পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন। সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে কড়া রোদে শুকানোর কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে আলো-বাতাসহীন, স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে সেই কাপড় শুকানো হয়। যা থেকে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রোদে এসব কাপড় শুকানোর ক্ষেত্রে অনীহার মূল কারণ ‘কুসংস্কার’। কুসংস্কারের বিপরীতে সচেতনতার বার্তা বলতে সমাজে কিছু চলমান নেই।

অন্যদিকে, বেশির ভাগ স্কুলে, বিশেষ করে শহরের বাইরে স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেট বা পানির ব্যবস্থা নেই, স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা এই বিষয়ে শিক্ষা দিতে আগ্রহী নন। কারণ সামাজিক ট্যাবু, নিষিদ্ধ/গোপন/লজ্জার বিষয় বলে রাখ-ঢাক রাখার রীতি। মাসিক নিয়ে পরিবারগুলোতে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয়– এটা সব মেয়ের হয়, এটা নিয়ে এত বলার কিছু নেই, সহ্য করে যাও…। বাড়ির পুরুষরা যেন কিছুতেই টের না পায়..।

খাবার নিয়েও আছে নানা কুসংস্কার। যেমন, মাসিক চলাকালীন আমিষ খাওয়া যাবে না।

আছে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রবণতা। পরিণতি বাল্যবিবাহ! শহরের শিক্ষিত সচেতন পরিবারগুলোতে সচেতনতা থাকলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোজগতে তা পরিবর্তন আনতে পারে না।

এই যে গোপন রাখার সংস্কৃতি, নারীদের মাসিককালীন প্রয়োজনীয় সেবা-যত্নের বিষয়টি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া, পুষ্টিকর খাবার থেকে নারীদের বঞ্চিত রাখা, নানা ধরনের মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া এবং বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে নারীর স্বাস্থ্য ও জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা সমাজে বড় অংশে এখনো প্রবলভাবে বিদ্যমান। এসব অন্যায় রীতি এখনো কেন একইভাবে বিদ্যমান তার উত্তর খুঁজলে নারীদের মাসিক সংক্রান্ত বিষয়-আশয় গোপন রাখার কারণ স্পষ্ট হবে। পরিবারে, সমাজে এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো এটিকে ট্যাবু করে রাখা হয়েছে।

বিপরীতে ছেলেমেয়েদের একইসঙ্গে বয়ঃসন্ধিকালীন পবিবর্তন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে পড়ানো গেলে, ছেলে-মেয়েদের উভয়ের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগেুলো সম্পর্কে একসঙ্গে বসে আলোচনা করলে তারা পরস্পরের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠতো। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। উল্টো শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত এসব বিষয় বাড়িতে পড়ে নিতে বলেন।

এছাড়া ধর্মীয়ভাবে ঋতুমতি নারীরা অপবিত্র– এমন ধারণাও প্রচলিত আছে সমাজে। সে কারণে মেয়েরা নিজেদের গুটিয়ে রাখে, ভীত থাকে এসময়। যে কারণে ধর্মের দোহাই দিয়ে যে কোন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পক্ষে মেয়েদের ঋতুকালীন বিষয়গুলো গোপন, নিষিদ্ধ ইত্যাদি প্রচারণা চালানো সহজ হয়। এই বাস্তবতায় চারদিকের পরিস্থিতি আমাদের এটিও ইঙ্গিত দেয় যে, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের বিষয়টি সামাজিক-রাজনৈতিক অন্যান্য ইস্যুর মতো গ্ল্যামারাস না।

পিরিয়ড বা ঋতুচক্র একটি নারীর শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া– এই ধারণাকে স্বাভাবিক করে তোলা, পিরিয়ড হলে নারী অপবিত্র হয়ে যায় না, এটি গোপন বা হাসাহাসির বিষয় নয়– এরকম সহজ সাধারণ বিষয়াবলি আরো জোরেসোরে সামনে আনা, প্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাড সহজলভ্য করার জন্য ভর্তুকি প্রদান, স্কুলগুলোতে ফ্রি বিতরণ, মেন্সট্রুয়াল হাইজিন দিবসে ট্যাবু ভাঙার জন্য নারী-পুরুষকে একসাথে নিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ, স্লোগানসম্বলিত বড় বড় বিলবোর্ড স্থাপন, মসজিদে মসজিদে বয়ানের মাধ্যমে প্রজনন স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিষয়গুলো তুলে ধরার মাধ্যমে পুরুষের মনোগজতে পরিবর্তন আনতে হবে।

সবশেষে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি, যে কোনো পুরুষতান্ত্রিক বা মৌলবাদী প্রতিবন্ধকতা সামনে এলে পিছু হটার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এই পিছু হটার কারণে নারীর অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বারবার গৌণই থেকে যাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বা অন্য যে কোনো কর্তৃপক্ষ যখন শক্ত হাতে সেটি মোকাবেলা করতে অসমর্থ হয় তখন সমাজে এই বার্তাই যায় যে, নারী প্রশ্নে খোদ সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো পশ্চাৎপদ ধারণাকেই বয়ে বেড়াচ্ছে।●

ফেরদৌস আরা রুমী একজন কবি ও অধিকার কর্মী