পোশাকশ্রমিকদের ত্যাগ ভুলছে অন্তর্বর্তী সরকার
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ ছিল শ্রমজীবী মানুষেরও। আশা ছিল নয়া বন্দোবস্তের আলাপে ঠাঁই পাবে তাদের স্বার্থসুরক্ষার আলাপও। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুরনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শ্রমিক শোষণের ক্ষেত্র সম্প্রসারণেই বেশি মনোযোগী সরকার।
পোশাকশ্রমিক রাম প্রসাদ সিং (৪০) কাজ করতেন গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেডের কারখানায়। অবিবাহিত রাম প্রসাদ থাকতেন ভাই-বৌদির সংসারে। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ তুলে দিনে তাদের হাতে। কিন্তু অনেক দিন ধরে বেতন বন্ধ থাকায় ওই সংসারে অনেকটা গলগ্রহ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অবর্ণনীয় অভাব, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে তীব্র মানসিক চাপে ভুগছিলেন। এ অবস্থাতেই সহকর্মীদের সঙ্গে এসেছিলেন আন্দোলনে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীর বিজয় নগরস্থ শ্রমভবনের সামনে টানা অবস্থান নিয়েছেন শ্রমিকরা। সেখানে অবস্থানকালে গত ২৪ মার্চ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাম প্রসাদ।
রামপ্রসাদের মৃত্যুকে অনেকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, বেতন না পেয়ে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিকের মানসিক অবস্থা রাম প্রসাদের মতোই। রাম প্রসাদ হয়তো মরে বেঁচে গেছেন। আর যারা এখনো মরেননি, তারা ধুঁকে ধুঁকে মরবেন। বছরের পর বছর বেতনের জন্য আন্দোলন করে, পুলিশ ও মাস্তানদের লাঠিপেটা খেয়ে খেয়ে, গুলিতে প্রাণ দিয়ে দিয়ে পোশাকশ্রমিকরা একপ্রকার মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে আছেন। তার মধ্যে দিনের পর দিন অভাব-অনটনে থেকে, অপুষ্টিতে ভোগে এইসব শ্রমিকের জীবন নিঃশেষ হতে থাকে ধীরে ধীরে।
বাংলাদেশের পোশাক খাতে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিকের জীবনের গল্প মূলত একটাই। কাঙ্ক্ষিত বেতন না থাকা, অধিকাংশ কারখানায় বেতন নিয়ে টালবাহানা, মাসের পর মাস বেতন বকেয়া পড়ে যাওয়া, বিনা নোটিসে হুটহাট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিনা কারণে শ্রমিক ছাঁটাই, ওভারটাইম না দিয়ে বর্বর শ্রমশোষণ — এমন অবমাননাকর অনিশ্চিত জীবনই যাপন করেন বাংলাদেশের সিংহভাগ পোশাকশ্রমিক। নিজেদের প্রাপ্য বেতন-বোনাস চেয়ে রাস্তায় নামলে চলে পুলিশী নিপীড়ন ও হামলা-মামলা। সর্বশেষ গত ২৪ মার্চ বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা সচিবালয় ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ কী বর্বর কায়দায় শ্রমিক এবং আন্দোলনে সংহতি জানাতে আসা ছাত্র-জনতাকে পিটিয়েছে, তা তো গণমাধ্যমের কল্যাণে সবাই দেখেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনও বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড, অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেড ও টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকরা।
সরকার-শ্রমিক-মালিকপক্ষের যৌথ সভায় গত ৬ মার্চ সিদ্ধান্ত হয় ২০ রমজানের মধ্যে সকল শ্রমিকের বকেয়া ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করা হবে। কিন্তু মালিকপক্ষ ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সময়মতো তা বাস্তবায়ন না করায় ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পথে নেমে আসেন। আর চার-পাঁচদিন পরেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদের আগে বেতন-বোনাসের নিশ্চয়তা না পেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা। শ্রমভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া শ্রমিকদের আহাজারি পৌঁছাচ্ছে না প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’ পর্যন্ত। উপরন্তু এর মধ্যে শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে একদফা ঠেঙানোর ব্যবস্থা করেছে সরকার।
বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত জানতে পেরেছি, দাবির মুখে অ্যাপারেলস ইকো প্লাস লিমিটেডের শ্রমিকদের একাংশ এক মাসের বেতনের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ করে পেয়েছেন। বাকি রয়েছে গেছে দুই মাসের বেতন ও বোনাস । এছাড়া টিএনজেড অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা এক টাকাও পাননি। তাদের দুই মাসের বেতন ও বোনাস বকেয়া। অথচ সরকারের শ্রম উপদেষ্টা টেলিভিশনে বলেছেন, মালিকের গাড়ি বিক্রি করে শ্রমিকদের পূর্ণ বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে!
সরকার এমন মিথ্যাচার, চাতুরিপূর্ণ আচরণ কেন করছে শ্রমিকদের সঙ্গে? শ্রমিকদের ব্যাপারে এই যদি সরকারের অবস্থান হয়, তাহলে মাত্র কয়েকমাস আগে এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারকে জনগণ ক্ষমতাচ্যুত করলো কেন? গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠন হওয়া সরকার কি গণঅভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের প্রাণদানের কথা সহসাই ভুলে যাচ্ছে?
বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পারি গণঅভ্যুত্থান চলাকালে অন্তত ১১২ শ্রমিক (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসাব) প্রাণ দিয়েছেন পুলিশের গুলিতে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। আহত-নিহত শ্রমজীবীদের অধিকাংশই পোশাকশ্রমিক। অথচ অভ্যুত্থানের পর জোরেসোরে ওঠা “রাষ্ট্র সংস্কারের” আলাপে কোথাও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য বদলের আলাপ নেই। বিশেষ করে পোশাক খাতের শ্রমিকদের অধিকার, তাদের কর্মক্ষেত্র, মজুরি কাঠামো সংস্কার এবং শ্রমশোষণ অবলুপ্ত করার কোনো পরিকল্পনার কথা সরকারের কাউকে জোর গলায় বলতে দেখা যাচ্ছে না।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় অংশীজন তো শ্রমিকরা। সে বছর জুলাইজুড়ে চলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কোন তাড়না ও দায় থেকে শ্রমিকরা যুক্ত হয়েছিলেন — সে বিষয়টা কি কেউ ভাবছেন? কী আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে ছাত্রদের পাশাপাশি এইসব শ্রমজীবী মানুষ অকাতরে র্যাব-পুলিশ-বিজিবির গুলির মুখে দাঁড়িয়েছিলো — সে কথা কি সরকারের কেউ উপলব্ধি করছেন?
জুলাইয়ে শ্রমিক সংহতি ও গাজীপুরের অভিজ্ঞতা
পুরো আওয়ামী লীগের শাসনামল ছিল পোশাক শ্রমিকদের নিপীড়ন, হত্যা, বঞ্চনা ও প্রতারণার আমল। পোশাকশ্রমিকদের এসব ক্ষোভ বারবারই প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাত্র সাত মাস আগে, ২০২৩ সালের ৮ ও ৯ নভেম্বর গাজীপুর ও সাভারে মজুরির দাবিতে আন্দোলন হয়েছিলো। সে আন্দোলনে সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে পোশাকশ্রমিক আঞ্জু আরা, রাসেল হাওলাদার, জালাল উদ্দিন ও মোহাম্মদ ইমরানকে। এসবের কোনো বিচার হয়নি। আগেরও অনেক হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। উপর্যপুরি হত্যা-নিপীড়নের শিকার শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছিলো। শ্রমিকরা ফুঁসছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, মিরপুরে মাঝে মাঝেই সে সব ক্ষোভের স্ফূরণ দেখা যাচ্ছিলো।
এর মধ্যেই ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সরকারদলীয় গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে যখন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনকে বর্বর কায়দায় দমন করতে চাইলো, ছাত্র হত্যার উৎসবে মেতে উঠলো, তখন শ্রমিকরা তা মেনে নিতে পারেননি। কারণ যারা মারা যাচ্ছেন তারা অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষের সন্তান। শ্রমিকের সন্তান, কৃষকের সন্তান, মজুর, মধ্যবিত্ত, কেরানী, সাধারণ চাকুরিজীবীর সন্তান। তারা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের ডাক দিয়ে সরকারি বাহিনীর বর্বরতার শিকার হচ্ছিলো, অকাতরে প্রাণ দিচ্ছিলো। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষও তাদের বৈষম্যপূর্ণ জীবন, বঞ্চনা ও ক্রোধকে উপলব্ধি করতে পেরেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর চলা নিপীড়নের জবাব দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে। ফলে ছাত্রদের দাবি ও শ্রমিকদের দাবি একাকার হয়ে গিয়ে জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়ে উঠেছিলো সকল প্রকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঠিকানা।
সাত মাস আগের চার শ্রমিক হত্যার পুঞ্জিভূত ক্ষোভও জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানাতে শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করেছে। চোখের সামনে ছাত্রদের উপরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিপীড়ন মেনে নিতে না পেরে তারাও যোগ দিয়েছেন অভ্যুত্থানে। ছাত্র-শ্রমিকের যৌথতাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গতিপথ পাল্টে দেয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দমন-পীড়ন গুড়িয়ে দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তার বড় অংশীদার শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে পোশাকশ্রমিকরা।
ঢাকার নিকটতম জেলাগুলোর মধ্যে সরকারের সতর্ক নজর ছিল গাজীপুরের দিকে। কারণ দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন ও শ্রমিক অঞ্চল এটা। জুলাইয়ে শুরুতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। তবে ১৬ জুলাই, বিশেষ করে রংপুরে আবু সাঈদকে হত্যার পর থেকে গাজীপুর, আশুলিয়া, কোনাবাড়ি টঙ্গীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠকদের নিয়ে আমরা কয়েক দফা বৈঠক করি। কখনো শালবনে, কখনো কোনো মাঠে গোপনে এসব বৈঠক করতে হয়েছে। এরপর ছাত্রদের আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পোশাকশ্রমিকরা।
১৬ তারিখ আমরা লিফলেট তৈরি করে বিভিন্ন কারখানায় বিলানোর পরিকল্পনা করি। তবে পুলিশের নজরদারির কারণে গাজীপুরের কোনো প্রেস সে লিফলেট ছাপাতে রাজি হচ্ছিলো না। পরে ফকিরাপুল থেকে প্রথমে দশ হাজার লিফলেট ছাপাই। ‘অভ্যুত্থানকারী ছাত্র শ্রমিক জনতা’র ব্যানারে আমরা গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সংহতি গড়ে তুলি। প্রথম দিকে গাজীপুরের ছাত্রদের পক্ষে প্রকাশ্যে খুব একটা অংশগ্রহণ লক্ষ করা যাচ্ছিলো না। মূলত সাহস সঞ্চার করতে পারছিলেন না অনেকে। কিন্তু ১৭ জুলাই শ্রমিকরা পথে নামার পর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সাহস ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গাজীপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ওইদিন মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ডুয়েট-এর বড় একটা অংশ সেদিন বিশেষ ভূমিকা রাখে। গাজীপুর চৌরাস্তায় দশ হাজারের মতো ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সমাবেশ হয় সেদিন।
তার পরের দিন থেকেই আন্দোলনকারীদের ধরপাকড় করতে সরকারদলীয় গুন্ডা, র্যাব-পুলিশ-বিজিবি বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারখানায় অভিযান চালাতে শুরু করে। এসব সরকারি তৎপরতা ছাত্র-শ্রমিকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির বদলে উল্টো ক্ষোভ ও ক্রোধ সৃষ্টি করে। গাজীপুরের প্রধান প্রধান সড়ক ও অলিগলি দখলে নেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনতা।
ওইদিন, অর্থাৎ ১৮ জুলাই গাজীপুর চৌরাস্তায় ভয়াবহ হামলা করে র্যাব-পুলিশ। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়া হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। নজরুল ইসলাম নামের আমাদের একজন পোশাক শ্রমিক সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অনেক শ্রমিক আহত হন। এরপর মানুষের মাঝে যেমন ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তেমনই সরকারের দমনপীড়নের মাত্রাও বেড়ে যায়। পাড়া-মহল্লায়, বাসাবাড়িতে ঢুকে ধরপাকড় করতে থাকে সরকারি বাহিনীর লোকজন। ওই কারণে আমরা ২৬ জন (আন্দোলনকারী শ্রমিকনেতা) বাসা ছেড়ে দেই। আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন এগিয়ে নিই।
২২ জুলাই জয়দেবপুর এলাকায় পুলিশের তাণ্ডব শুরু হয়। নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, টিয়ারগ্যাস, ছাত্রদের গ্রেফতার শুরু হলে আমরা কয়েকজন রাজেন্দ্রপুরে আশ্রয় নিই এক বন্ধুর স্কুলে। এরপর তো ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমরা শ্রমিক ও ছাত্রদের নিয়ে মানুষের মাঝে লিফলেট বিলাতে থাকি। বিভিন্ন কারখানা ও রিকশা গ্যারেজে ২৫ তারিখ থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত আমরা ‘অভ্যুত্থানকারী ছাত্র শ্রমিক জনতা’ চার দফা দাবিতে গাজীপুর এর বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিতরণ করি। দাবিগুলো ছিল —
১. ছাত্র জনতা হত্যার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাইতে হবে, সকল হত্যার বিচারসহ ছাত্রদের ৯ দফা মেনে নিতে হবে।
২. মজুরি আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিক হত্যার বিচার করতে হবে। ছাত্র-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ৩০ হাজার টাকা ঘোষণা দিতে হবে। কারখানাভিত্তিক মুনাফার হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
৪. শ্রমিক-ছাত্র-জনতার ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনে পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলি চালানো, হামলা-মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানি আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।
২ আগস্ট থেকে পোশাকশ্রমিক, ইজিবাইক শ্রমিক, হকার ও ছাত্রদের নিয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা, জয়দেবপুর, কোনাবাড়ি, সালনাতে আন্দোলন গড়ে তোলে ছাত্র-শ্রমিক জনতা। সরকারি বাহিনীর গুলির মুখে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার অভাবনীয় প্রতিরোধ-প্রতিবাদ বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি। সরকারি বাহিনীর বর্বরতা তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছ। গুলি করে হত্যার পর আশুলিয়ায় শ্রমিকদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কোনাবাড়ি ইজিবাইক শ্রমিক হৃদয়কে গুলি করে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। অসংখ্য শ্রমিক আহত-নিহত হয়েছে। অনেক লাশ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। গাজীপুর আশুলিয়া সাভারে এখনো অনেক শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন।
ইতিহাসে ছাত্র-শ্রমিক ঐক্য ও স্বপ্নভঙ্গ
ইতিহাস বলে, এদেশের প্রতিটি গণআন্দোলন সফল হয়েছে শ্রমিক ও ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফলে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা হলো — শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে শ্রমিকের দাবি এবং শ্রমিকের দাবি সঙ্গে যখন শিক্ষার্থীদের দাবি একাকার হয়ে গেছে তখনই এই দেশে বড় বড় অভ্যুত্থান হয়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারি বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে এ দেশের শ্রমিক-ছাত্রের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই ফ্যাসিবাদী দানবের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর শ্রমজীবী মানুষের লড়াই ও ত্যাগকে গণঅভ্যুত্থানের ‘বয়ান‘ ও অভ্যুত্থানপরবর্তী ‘নতুন বন্দোবস্ত’র আলাপ থেকে ‘নাই’ করে দেওয়া হয়েছে। যে স্বপ্ন নিয়ে শ্রমিকরা জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল, যে বৈষ্যম্যবিরোধী বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শ্রমিকরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছে, শ্রমিকদের সে আকাঙ্ক্ষা আজ পদদলিত করে অভ্যুত্থানপরবর্তী রাষ্ট্র পুরনো শোষণ ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকেই জারি রেখেছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কোন ধরনের সংস্কার দরকার — এরকম ইত্যাদি আলাপ যেভাবে উঠে আসছে সেভাবে কোনো সভা-সেমিনারে উঠে আসছে না — শ্রমিকদের জন্য কেমন কারখানা চাই, কেমন মজুরি ও মর্যাদা নিশ্চিত করা দরকার। উপরন্তু শ্রমিকদের আন্দোলনকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে তাদের উপর নিপীড়ন বৈধ করা হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পরপরই শ্রমিকরা মজুরির দাবি নিয়ে রাস্তায় নামলে পুলিশের গুলিতে কাওসার খান ও চম্পা আকতার নামের দুই পোশাকশ্রমিককে খুন হতে হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর ‘নতুন বন্দোবস্তের’ রাষ্ট্রে ফের শ্রমিক হত্যার ঘটনা শ্রমিকদের জন্য কতটা হতাশার ও ক্ষোভের তা বোঝার ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে নেই তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যে রিকশা শ্রমিকরা জুলাই আন্দোলনে রিকশাকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছিল, ৫ আগস্টের পর সেই রিকশা চলাচলের উপরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার।
যে পোশাকশ্রমিকরা জীবন বাজি রেখে অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে সে শ্রমিকদের মজুরির আন্দোলনকে “সরকারবিরোধী তৎপরতা” বলে প্রচার করা হয়েছে। তাদের “আওয়ামী দোসর” বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে, যেমনটা বিগত সরকার তাদের সময়ের সব আন্দোলনকে বিএনপি-জামাতের আন্দোলন বলে প্রচার করতো।
৫ আগস্টের পরে গাজীপুরে ৫১ টা কারখানা বন্ধ করে দেয় মালিক পক্ষ। বেকার হয়ে যায় লাখো শ্রমিক। ওই সময় যদি সরকার উদ্যোগ নিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করতো, কারখানাগুলো সচল রাখার উদ্যোগ নিতো, তাহলে কি শ্রমিকরা রাস্তায় নামতো? কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার সুযোগ থাকলে কি দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায় প্রায় আন্দোলনের মানতে হতো শ্রমিকদের? ৫ আগস্টের পর সরকারের সংস্কার পরিকল্পনায় কি পোশাক কারখানাগুলোতে ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ গঠনের প্রস্তাবনা স্থান পেয়েছে? এসব ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই মূলত সরকার তাদের নিয়ত ও চরিত্র স্পষ্ট করেছে।
সর্বশেষ ২৪ মার্চ বকেয়া বেতনের দাবিতে মিছিলকারী পোশাকশ্রমিকদের উপর পুলিশি হামলা ও বর্বর লাঠিপেটার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরো একবার প্রমাণ করেছে তারা শ্রমিকদের অবদান ও আত্মত্যাগের কথা ভুলে গেছে। তারা স্পষ্টতই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
সরকারি বাহিনীর নিপীড়নবাদী চরিত্র বদলাচ্ছে না
গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা ভেবেছিলাম, ১৬ বছরের দুঃশাসন থেকে আমাদের মুক্তি মিলেছে। ভেবেছিলাম কথা বলার স্বাধীনতা, বিরোধিতা করার স্বাধীনতা পেয়েছি। ভেবেছিলাম, শ্রমশোষণ বন্ধ হবে, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে, বন্ধ কারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের কর্সংস্থান বাড়ানো হবে। ভেবেছিলাম, যে বৈষম্যের মধ্যে শ্রমিকদের পতিত করা হয়েছে সেখান থেকে তাদের মুক্তির আলাপগুলো রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে করবে। রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে করতে ব্যর্থ হলে শ্রমিক কমিউনিটি থেকে সেসব আলাপ উঠলে তাকে স্বাগত জানাবে, তাদের আলাপ দরদের সঙ্গে আমলে নেবে। কিন্তু তা না। আগের ব্যবস্থাকে বলবৎ রেখে শ্র্রমিক শোষণ ও নিপীড়নের দিকেই দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রের মনোযোগ বেশি। সেইসঙ্গে পূর্বেকার মতো ভীতির পরিবেশ জারি রেখে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকে দমনের পথেই রয়েছে রাষ্ট্র। শ্রমিকদের সম্পর্কে রাষ্ট্র ও তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি একদমই বদলায়নি, বদলানোর কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৯ নভেম্বর ‘অভ্যুত্থানকারী ছাত্র শ্রমিক জনতা’র ব্যানারে গাজীপুর বাসন থানায় একটি শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন হয়। আয়োজকদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। শ্রমিক সমাবেশের দিন সকালে আমাকে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সিভিল পোশাকে তিন ব্যক্তি এসে হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। কারণ সমাবেশের দাবিনামাগুলো তাদের পছন্দ হয়নি।
তারা প্রথমে আমাকে বাসন থানায় নিয়ে গিয়ে নাম-ধাম জিজ্ঞেস করে এবং আমার ফোন কেড়ে নেয়। এরপর গারদে পাঠিয়ে দেয়। তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন আমি গারদে যাবো, আমার অপরাধ কি? বলেছিলাম, “পুলিশের আচরণ আগের মতোই রয়ে গেছে। আগের আচরণ পাল্টান।” এই কথা বলায় দায়িত্বরত এক এসআই আমার কলার ধরে বলেন যে, “আমি পুলিশ কি ধইঞ্চা, শু…র বাচ্চা এই পোশাক এখন খুলে ফেলবো, পোশাক খুলে তোরে খাইছি…। দরকার হলে চাকরি করবো না।”
এরপর গারদে ঘণ্টাখানেক থাকার পর ওসি তার রুমে আমাকে ডেকে পাঠান। আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে তার টেবিলের সামনে নেওয়া হয়। আমি বসতে চাইলে আমার কলার টেনে ধরে বলেন, “টোকাইর বাচ্চাদের আবার কিসের রাজনীতি, শু…র বাচ্চা…।”
এভাবে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের মধ্য দিয়ে পুলিশ তার আসল রূপ প্রকাশ করতে থাকে। সকাল থেকে আমাকে কোনো খাবার পানি দেওয়া হয়নি। ওসির টেবিলে থাকা পানির বোতলে হাত দিলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। ওসি বলেন… “মাদারচো…রে ভিতরে নে।”
ওসি উচ্চস্বরে আমাকে বলতে থাকেন — “আওয়ামী দোসর, বল কারা টাকা দেয়?” তখন অন্য পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তারা আমার রুগ্ন শরীর, আমার শিক্ষাদীক্ষার স্বল্পতা নিয়ে খিল্লি করতে থাকেন। আমার মতো একজন শীর্ণকায় অশিক্ষিত মানুষ কীভাবে শ্রমিক প্রতিনিধি হয় সে প্রশ্ন করতে থাকেন।
সেদিন ছয়জন পুলিশ আমার প্রতি যে অবজ্ঞা, যে শ্রেণীঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন তা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের অবস্থান আসলে কোথায়?
ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সেদিন থানা ঘেরাও করলে পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
গণঅভ্যুত্থানের আট মাস শেষ হতে চলেছে। যে অভ্যুত্থানে শ্রমজীবী মানুষের বড় অংশগ্রহণ ছিল, সে অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশ কি শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবছে? এই প্রশ্নই আমি বারবার করতে চাই। আহত শ্রমিকরা এখনো ঠিকঠাক চিকিৎসা পাননি। শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। মজুরি ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখা ছাড়া তো আমাদের কোনো পথ নেই ।
কারণ, ৫ আগস্টের আগে থেকে শ্রমিকরা বকেয়া বেতন চাইলে শেখ হাসিনার পুলিশ যেমন লাঠিপেটা করতো, গুলি চালাতো, শেখ হাসিনার পতনের পর এখন একইভাবে ইউনুস সরকারের পুলিশও আমাদের লাঠিটেটা করছে, বুকে গুলি চালাচ্ছে।
বিকল্প কাজের ব্যবস্থা না করে একের পর এক শ্রমিকবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এই সরকারও। এক দিকে নিয়োগবৈষম্যের কারণে অসংখ্য বেকার, আরেকদিকে যারা চাকরি পেয়েছেন তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি। পোশাকশ্রমিকরা হাজিরা, বোনাস, টিফিন বিল, নাইট বিল দাবি করলে বলা হচ্ছে এগুলো “আওয়ামী ষড়যন্ত্র”।
শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়াগুলোকে দমিয়ে রাখতে সব সরকারকেই দেখা গেছে শক্তিপ্রয়োগ করতে। শ্রমিকরা যাতে তাদের দাবি আদায়ের জন্য একত্র হতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্র তো আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছে “ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ’। শ্রমিকদের ঐক্য বিনষ্ট এবং পোশাকখাতে সুবিধামতো যে কোনো পরিস্থিতি তৈরির জন্য তৈরি করে রেখেছে অনেকগুলো দালাল শ্রমিক নেতা ও তথাকথিত শ্রমিক ফেডারেশন। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে শ্রম আইন সংস্কারের কথা উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সংক্রান্ত একটি কমিশনও করেছে। কিন্তু ক্ষমতাবান মালিকদের স্বার্থ রক্ষা যখন রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ত হয়ে দাঁড়ায় তখন ওই কমিশনের প্রস্তাবনা যথাযথ বিবেচনায় নেওয়া হবে কি না তা-ই বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দেয়।●
আরমান হোসাইন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী একজন পোশাকশ্রমিক।