ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করেছে হাসিনা, কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে ইউনূস
আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার ভাওতাবাজি এক গভীর ইসলামীকরণ প্রক্রিয়াকে আড়াল করে রেখেছিল এবং ইসলামপন্থীদের সুযোগ করে দিয়েছিল একটি মজলুম-বয়ান দাঁড় করানোর। ইসলামপন্থীদের সাথে সখ্য করার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুরোপুরি মুছে দিচ্ছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটা জোরালো বয়ান উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলো যে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি মোটাদাগে ইসলাম-বিরোধী ছিল। এই বয়ানের আওতায় আওয়ামী লীগের শাসনামলকে আখ্যায়িত করা হয় “সেক্যুলার ফ্যাসিজম” বলে। এই বয়ান চাউর করার পেছনে সবচেয়ে বড় হাত অতি-ডানপন্থী ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর হলেও, তার গ্রহণযোগ্যতা সেই পরিধির বাইরেও অনেকখানি ছড়িয়েছে। অতি-ডানপন্থীরা যে এই বয়ান ছড়ানোতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এটা তাদের একার নির্মাণ নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি হাসিনার পতনের আগে ও পরে বিভিন্ন মহলে ভালোই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে সম্পৃক্তদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ফরহাদ মজহার বহুবার দাবি করেছেন যে, আওয়ামী লীগ ও তার মতাদর্শ সরাসরি ইসলামের প্রতি বৈরি। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক পক্ষপাত এই ধারণা প্রচারের পেছনে ভূমিকা রেখে থাকলেও, প্রাথমিকভাবে তিনটি বস্তু-সাংস্কৃতিক নিয়ামকের কারণে এই দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচলিত হয়ে উঠেছে।
প্রথমত, আওয়ামী লীগের ভারতপন্থী ঝোঁক ছিল একটা গুরুতর নিয়ামক। দলটি নিজের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন বলিষ্ঠ করার ও চলমান রাখার জন্য ভীষণভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এতে করে নয়াদিল্লির সাথে ঢাকার একটা আনুগত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। এর ফলে, আওয়ামী লীগের শাসন যত লম্বা হতে থাকল, জনগণের মধ্যে ভারত-বিরোধী আবেগও তত বাড়তে থাকল। এর পাশাপাশি, ভারতে নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক মুসলমানদের নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশের ভারতমুখিতার সাথে ইসলাম-বিরোধিতার সরাসরি সম্পর্ক টানা আরো সহজ হয়ে উঠল। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ যখন জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার নামে জামাত-এ-ইসলামীর ওপর বলপ্রয়োগ করছিল, জামাত তখন সেই রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নকে চিত্রায়িত করলো ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হিসেবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক আবহের রক্ষণশীল স্বভাবের কারণে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম বলতে ভাবা হয় ধর্মহীনতা অথবা নাস্তিকতা, যার ফলে অনায়াসে একে ইসলামবিদ্বেষের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসন এতটা বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক ছিল বলেই এই তিনটি নিয়ামক জনমানসকে এতটা প্রভাবিত করতে পেরেছে।
এটা সত্য যে, আওয়ামী লীগ নিজেকে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বাতিঘর হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল। এটাও সত্য যে, বুদ্ধিজীবীশ্রেণি ও সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তি— যারা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি থেকে এই দলে যোগদান করেছিলেন— তারা দলের মধ্যেই একটা শক্তিশালী সেক্যুলার গোষ্ঠী ছিলেন। কিন্তু যত যা-ই হোক, সে দলের নিজের ব্যাপারে নিজের অভিমত অথবা ছোট একটা সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর উপস্থিতি কিছুতেই প্রমাণ করে না যে, আওয়ামী লীগ কার্যত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল ছিল। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক-বাহক— এই ধারণার বিপরীতে এখন অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ গড়ে উঠছে, যা প্রমাণ করে যে, এই দলের সাড়ে পনের বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিমাণে ইসলামীকরণ ঘটেছে, যা বিগত চল্লিশ বছর ধরে চলে আসা রাষ্ট্রীয় মদদে ইসলামিকরণের ধারাকেই চলমান রাখে।
আওয়ামী লীগের অধীনে ইসলামিকরণ
২০১৮ সালে জার্মান রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাসমিন লর্চ “Islamisation by Secular Ruling Parties” (ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদলের আওতায় ইসলামীকরণ) শিরোনামে একটি চমৎকার প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এতে তিনি যুক্তি দেন যে, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও, ২০০৮ সালের পর থেকে দলটির দীর্ঘমেয়াদী শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনীতি এক গভীর ইসলামীকরণের মধ্য দিয়ে গেছে। একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমে তিনি এই প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেন, যেখানে তিনটি শর্তকে চিহ্নিত করা হয়, যেগুলোর উপস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষ শাসক দল নিজেরাই ইসলামিকরণকে এগিয়ে নেয়: ১. ইসলামপন্থী সামাজিক আন্দোলনের উত্থান, ২. তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং ৩. আধা-স্বৈরাচারী শাসন। তার মতে, এই তিনটি শর্তই সেই সময়ে বাংলাদেশে বিদ্যমান ছিল।
প্রথমত, ২০১৩ সাল থেকে দেশটি হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ইসলামপন্থী আন্দোলনের সাক্ষী হয়, যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রকে শরিয়তের আইনের কাছাকাছি নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, ১৯৯০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার নিষ্ফল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। ফলে, তীব্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও তখন বিদ্যমান ছিল। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের শাসন যত এগোতে থাকে, ততই ক্রমশ তা স্বৈরাচারী রূপ নিতে থাকে।
বাস্তব তথ্যের সঙ্গে তার বিশ্লেষণ মিলে যায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ ২০১৪ সাল থেকে হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করতে শুরু করে। ২০১৬ সালে, হেফাজতের চাপের মুখে পড়ে সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম থেকে ১৬টি সাহিত্যকর্ম বাদ দেয়, যার মধ্যে ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন আজাদ এবং ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের কবিতা ও ছোটগল্প। অভিযোগ ছিল যে সেগুলো ‘ইসলামবিরোধী’ ও ‘হিন্দুত্ববাদী’। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, মুক্তচিন্তক ও এলজিবিটিকিউ+ কর্মীদের ওপর জিহাদি ইসলামপন্থীদের হামলার ঘটনায় রাষ্ট্রের যে উদাসীন প্রতিক্রিয়া, তা এক তিক্ত সত্য প্রকাশ করে।
ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ আক্রান্ত হলে স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ দল আওয়ামী লীগ তাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তাদেরকেই দমন করবে। তার উপর, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার বদলে সরকার দলের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে মুক্তচিন্তকদের সতর্ক করেন, যেন তারা আল্লাহ বা নবী মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্য না করেন, যা আওয়ামী লীগের ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে বেজায় বেমানান। আদতে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী মহলের তথাকথিত উদারপন্থী মুখপাত্ররা বৌদ্ধিক অসততার সাথে সাধারণ জনগণকে বোঝাতে থাকে যে, ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ‘চরমপন্থী’, আর ইসলামপন্থীরাই নাকি ‘ধর্ম ও নৈতিকতার রক্ষক’।
খোদ শেখ হাসিনাও রাষ্ট্রীয় বয়ানের ইসলামীকরণে অংশগ্রহণ করেন, ঘোষণা দেন যে, তিনি ‘মদিনা সনদ’-এর আলোকে দেশ পরিচালনা করবেন। আওয়ামী লীগের শাসন যত এগোতে থাকে, দলটির সঙ্গে রক্ষণশীল ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক তত ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ২০১৭ সালে, মাসব্যাপী ইসলামপন্থী বিক্ষোভের পর সরকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে “লেডি জাস্টিস” নামের মূর্তিটি অপসারণে সম্মত হয়, যা ছিল শাড়ি পরা, চোখ বাঁধা, গ্রিক দেবী থেমিসের বাংলাদেশি রূপ। শেখ হাসিনা মূর্তিটি অপরাসরণ করেন এবং প্রশ্ন তোলেন কীভাবে ‘একটি গ্রিক প্রতিমা’ দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রাঙ্গণে স্থাপিত হলো।
ভিন্ন ভিন্ন ইসলামিক মতাদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিপূর্ণ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন একটি রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল বলয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ বা সংস্কারের বদলে হাসিনা মাদ্রাসাগুলোতে প্রদত্ত ডিগ্রিকে উচ্চশিক্ষার সমমান স্বীকৃতি দেন। ফলে কার্যত তিনি বাংলাদেশের ধ্বজভঙ্গ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে মতাদর্শিক ও ধর্মতান্ত্রিক গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেন। তখনই অনেকে আশঙ্কা করতে শুরু করেন যে, ইসলামপন্থীদের তুষ্ট করার এই নীতি প্রশাসনের ইসলামীকরণকে ত্বরান্বিত করবে এবং সেই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে, যেখানে ধর্মদ্রোহের ব্যাপারে কঠোর ধারা যুক্ত হয়, যা পরবর্তীতে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ করার অভিযোগে সুফি গায়িকা রিতা দেওয়ান ও শরীয়ত সরকারসহ অনেককে গ্রেপ্তার করতে ব্যবহার করা হয়।
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন আসতে আসতে ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাত পুরোপুরি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় ৯০ শতাংশ ইসলামপন্থী দল সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত না হলেও তাদের প্রধান মিত্রদল জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। ইসলামীকরণের বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগ বরং সেটিকে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ বানিয়ে নেয়। এই সব ঘটনা সম্মিলিতভাবে প্রমাণ করে যে দলটি ইসলামী প্রতিক্রিয়া বা রাজনৈতিক ইসলামপন্থার প্রভাবের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়াকে আরও গভীর করে তুলেছে।
মজলুম-দশাই যখন হাতিয়ার
হাসিনার আওয়ামী লীগ যে ইসলামবিরোধী ছিল, এই দাবি থেকে বাংলাদেশের রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলগুলোই সুবিধা পায়। এই কথা উল্লেখ করার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে একমাত্র মজলুম হিসেবে হাজির করে। যেন কেবল তারাই বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে সকল রাজনৈতিক ও আইনি সুরক্ষা-বলয়ের বাইরে ছিল। কিন্তু এই চিত্রায়ণ একটা প্রধান বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখে। আওয়ামী লীগের গত দুই শাসনকালে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী সকল দলকেই কাঠামোগত ও পদ্ধতিগতভাবে দমন করা হয়েছে। সে শাসনব্যবস্থায় বিরুদ্ধমত ও বিরুদ্ধদলের মধ্যে আচরণের কোনো তফাত করা হয়নি।
বলে রাখা ভালো যে, মজলুম-দশা নিছক কোনো অভিজ্ঞতার বর্ণনা নয়। একইসাথে এটা একটা রাজনৈতিক অবস্থান যা সহিংস অবস্থা থেকে উত্তরণের সময় মানুষের ন্যায্যতা ও যোগ্যতার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা ও ধ্যান-ধারণাকে আকার দিয়ে থাকে। যারা সবচেয়ে বেশি জুলুমের শিকার হয় আমরা তাদের জন্যই আমাদের গভীরতম সমবেদনা মজুদ করে রাখি। যাদেরকে আমরা কোনো এক নিপীড়নমূলক শাসনের প্রধান মজলুম বলে ভাবি, তারা কিছু বৈধতা পেয়ে যায়। যার ফলে তাদের মূল্যবোধ ও রাজনীতি জনগণের মধ্যে আরো সহজে ছড়ানোর সুযোগ পায়।
ফলে, আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের প্রধান মজলুম হওয়ার কৃতিত্ব ধারণ করার মানে হলো নিজেদের পক্ষে বিপুল পরিমাণে নৈতিক এবং রাজনৈতিক পুঁজি জমা করা। ইসলামপন্থী দলগুলো এটা ভালোই বোঝে। আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নকে সেক্যুলার সহিংসতা এবং নিজেদেরকে তার একচ্ছত্র শিকার হিসেবে হাজির করার মধ্য দিয়ে তারা জনপরিসরে নিজেদের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রচার ও বৈধতা আদায় করে নিচ্ছে।
এই ধারা মোটেই কেবল বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। পুরো বিশ্বজুড়ে, অতি-ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মজলুম-দশাকে হাতিয়ার বানিয়ে নেওয়ার শিল্পটাকে ভালোই রপ্ত করেছে। “এ যুগ হলো মজলুমদের যুগ”— ২০১৪ সালের সিনেটে নিজের বক্তব্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন কলম্বিয়ার শান্তি বিষয়ক উচ্চকমিশনার। মজলুম হওয়ার সাথে এখন আর ক্ষমতা-চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবিক কোনো সম্পর্ক নেই; যে কেউ এখন নিজেকে মজলুম বলে দাবি করার সুযোগ লুফে নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ প্রোটেস্ট্যান্ট পুরুষেরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী নেতাদের নেতৃত্বে, নিজেদেরকে উদারপন্থী “ওয়োক” সংস্কৃতির শিকার হিসেবে দাবি করে। তাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণ হিসেবে তারা পুঁজিবাদী শোষণকে নয়, বরং অভিবাসী ও পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিকে দায়ী করেন। এই স্ববিরোধটা খুব স্পষ্ট: ট্রাম্প ও মাস্কের মতো অতি ধনী, আখেরি-পুঁজিবাদের সুবিধাভোগী ব্যক্তিরাই নিজেদেরকে নিপীড়িতদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের ক্ষোভকে পুঁজিবাদ থেকে সরিয়ে প্রগতিশীল রাজনীতি ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর দিকে ঘুরিয়ে দেয়। “ম্যানোস্ফিয়ার” বা পুরুষ অধিকারের পক্ষের আন্দোলনকারীরাও একই যুক্তি ব্যবহার করে। তাদের বয়ানে নারীবাদ হলো একটি অভিজাত মতবাদ, যা কি না অন্যায়ভাবে নারীদের বাড়তি সুবিধা দেয় এবং পুরুষদের বঞ্চিত করে। ফলে পুরুষরাই ভুক্তভোগী হয়ে ওঠে। কিন্তু ন্যায্যভাবে বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে, যেকোনো মানদণ্ডে, তা হোক অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, আইনি সুরক্ষা, স্বাস্থ্য বা সামাজিক স্বাধীনতা—পুরুষেরা নারীদের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। অন্যদিকে নারীরা এখনও প্রতিনিয়ত কাঠামোগত বৈষম্যের কারণে বিশ্বের নানা প্রান্তে ভুক্তভোগী হয়ে চলেছে।
সীমান্তের ওপারেও একই চিত্র দেখা যায়। বিজেপির অধীনে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান সেই একই ভিত্তির ওপর বেড়ে উঠছে, যার মূল্য দিতে হচ্ছে সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের লোকেদের। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরাও ভিন্ন নয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যের মানুষসহ প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর ক্ষতি করার দীর্ঘ নজির থাকা সত্ত্বেও, তারা নিজেদেরকে ওই সরকারের ‘চিরকালীন মজলুম’ হিসেবে উপস্থাপন করে, যাতে করে তাদের রাজনৈতিক পুঁজি অর্জন ও সম্প্রসারণ সম্ভব হয়।
ইতিহাস পুনর্লিখনের এক বিকৃত রূপ
বলা হয় যে, যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য। এই প্রবাদটা সব ক্ষেত্রে সত্য নয়। আফগান যুদ্ধ এবং ভিনদেশি হস্তক্ষেপের ফলাফল (তালেবানের উত্থান) সম্পর্কে সবাই জানত, তারপরও তো ইরাক যুদ্ধ হলো। ইতিহাসবোধ হয়তো কোনো পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারে না। কিন্তু তা অতীতের ওপর আলোকপাত করে আমাদেরকে আরো স্পষ্ট বোঝাপড়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এক রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের বর্ষাকালে বাংলাদেশ এক হিংস্র স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। সেই সংগ্রামের সমষ্টিগত প্রত্যাশা ছিল স্পষ্ট— আর কক্ষনো না। এই কারণেই আওয়ামী লীগ শাসনের একটি সৎ ও যুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন এখন অপরিহার্য। সচেতনভাবেই আমি “সৎ” ও “যুক্তিনির্ভর” শব্দ দুটি ব্যবহার করেছি এবং বহুল প্রচলিত “নিরপেক্ষ” শব্দটা এড়িয়ে গেছি মূলত দুই কারণে। প্রথমত, ইতিহাসসহ যেকোনো বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়া ব্যক্তি ও সমাজ হিসেবে আমাদের নিজস্ব আদর্শ ও পক্ষপাত দ্বারা নির্মিত হয়। দ্বিতীয়ত, কোনো বিশ্লেষণই পুরোপুরি পক্ষপাতমুক্ত হতে পারে না। তবে অন্ততপক্ষে গণ-ইতিহাস ও সাম্প্রতিক অতীত বিষয়ক আলোচনাগুলোতে সততা ও যুক্তিবোধ থাকা উচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ছিল বা ইসলামপন্থীরাই কেবল তার শিকার ছিল— এমন দাবি করা পুরোপুরি অসৎ ও অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের জন্য ইতিহাস বিকৃত করার এক স্ববিরোধী প্রয়াস। এই কারণেই ইসলামপন্থীদের মজলুমিয়তের এই খারেজি বয়ানকে অপ্রতিহত রাখা চলবে না।
যদি বলি যে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা এখন ১৯৭১ সালের পর থেকে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে তাহলে তা বাড়িয়ে বলা হবে না। তারা যতখানি নিপীড়িত হওয়ার দাবি করে, তা যদি আসলেই হতো, তাহলে আজ কীভাবে তারা এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠল? তাদের এই বর্তমান ক্ষমতার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের বিপজ্জনক তোষণনীতি, যার ফলে হেফাজতসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর প্রতি তাদের নরম মনোভাব দেখা যায়; এবং তাদের স্বৈরাচারী শাসনের বৈধতা অর্জনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক পরিসরকে ইসলামীকরণের সচেতন প্রচেষ্টা। তবে ইসলামপন্থী পুনরুত্থানের দায় শুধু আওয়ামী লীগের ঘাড়েই বর্তায় না। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারও প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের চাপে নতি স্বীকার করেছে, অনেক সময় নিজ উদ্যোগে তাদের উৎসাহ ও আশ্রয়ও দিয়েছে।
পাঁচ আগস্টের পর থেকে তৌহিদি জনতা প্রায় ১৮০টি মাজার ধ্বংস ও ভাঙচুর করেছে। হিন্দু উপাসনালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে হামলা চলছে; ইতোমধ্যেই অন্তত আটটি স্থানে দুর্গাপূজার জন্য তৈরি করা প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়েছে। নারীদের সমান উত্তরাধিকারের পক্ষে লেখা প্রকাশের কারণে নরসিংদীর এক সরকারি কলেজের অধ্যাপককে হেফাজতের দাবিতে বদলি করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফাকে ইসলামপন্থীদের দাবিতে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হয়রানির অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও দঙ্গলের দাবিতে তাকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এদিকে, কারামুক্ত সালাফি জিহাদি মতাদর্শী জসিমউদ্দিন রহমানীর মতো জ্যেষ্ঠ ইসলামপন্থী নেতারা আবারও উগ্র রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসবের প্রতিক্রিয়ায় সরকার মবের কাছে নতি স্বীকার করে এবং এসব বিষয়ে যেকোনো উদ্বেগকে ভারতীয় অপপ্রচার হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যত ইসলামপন্থীদের কথা ও কার্যকলাপকে অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ—বরফখণ্ডের চূড়াটুকু। ইসলামপন্থীদের এই বেহিসাবি প্রভাব যদি এখনই মোকাবিলা না করা হয়, তবে যা ঘটছে, তা আরো বিপজ্জনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করছে।
যেকোনো সরকারের মৌলিক কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, তা লকের দর্শনে অধিকার রক্ষার তাগিদেই হোক, আর হবসীয় দৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলা দমনের লক্ষ্যেই হোক। এই ক্ষেত্রে ইউনূসের সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ, যার ফলে ফাঁকা ময়দান পেয়ে ইসলামপন্থী মবগুলো রাষ্ট্রের ওপর দিকদারি করে চলেছে।●
আব্দুল্লাহ হেল বুবুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডন ল্যাভিয়ে ফেলো।