বাংলাদেশি হওয়ার মূল্য আমাকে চুকাতে হয়েছে
ছাত্র হিসেবে আমার অধিকার এবং মর্যাদা দাবি করার কারণে আমাকে অপমান করা হয়েছিল, চরমপন্থী ধর্মীয় রাজনীতির কাছে জিম্মি থাকা ব্যবস্থায় আমি ক্রমবর্ধমান প্রাতিষ্ঠানিক হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলাম।

আমি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত ভারতে পড়াশোনা করে আসা একজন বাংলাদেশি হিন্দু। একজন গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে আমি কখনো আমার জাতীয়তা গোপন করিনি। একজন ধার্মিক হিন্দু হিসেবে আমি কখনো আমার ধর্মকে আমার সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্ধারণ করতেও দেইনি। তবুও, ভারতে একজন ছাত্র হিসেবে আমার এই পরিচয়গুলোকে ব্যবহার করে আমার সাথে এমন ন্যাক্কারজনক জাতিবিদ্বেষী আচরণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার বলা চলে। বছরের পর বছর অনেক কষ্ট করে যে জীবন আমি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলাম সেটাও আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে নিপীড়নের শিকার হওয়া এবং ভারতে একজন বাংলাদেশি “উইপোকা” ও “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে দানবায়নের ফলে আমার ব্যক্তিপরিচয় মৌলবাদী রাজনীতির হাতে ভাগ হয়ে পড়েছে। আর আমার সত্তার এই দুটি অংশকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমার নিজের অস্তিত্ব ও দেশাত্ববোধ আমার থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।দিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (SAU) থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করার পর আমি পিএইচডি করার জন্য সেখানে থেকে যাই। সার্কের (SAARC) প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি নানান সুবিধার্থে ভারতে অবস্থিত হলেও প্রতিটি সদস্য দেশের অংশগ্রহণ ও মতামতের সুযোগ দেয়। এটা বেশ অন্যরকম একটা আন্তঃসরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতা, সংহতি ও সম্প্রীতির আদর্শের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার নিজেরও এই আদর্শগুলোর প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ আমাকে দেখিয়ে দিল যে, এই আদর্শগুলো আসলে আমাদের নিজেদেরকে বুঝ দেওয়ার জন্য বলা কিছু মিথ্যা কথা, যা শান্তি ও সমৃদ্ধির এক মিথ্যা বয়ান নির্মাণ করে এবং আড়াল করে রাখে সমস্ত বৈষম্য, বিভাজন ও অবক্ষয়ের বাস্তবতাকে।
মহামারির প্রথম ওয়েভের সময় যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসিক হল খালি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আমি ও হল কমিটির অন্য সদস্যরা উদ্যোগ নিয়ে ক্যাম্পাসে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় কিট সরবরাহে একটি ক্রাউডফান্ডিং কার্যক্রম গড়ে তুলি। সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বিমান চলাচল স্থগিত হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মতো আমারও ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
ছাত্রকল্যাণ ডিনের কাছ থেকে নিজের রুমে থাকতে পারার লিখিত অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও, সেই ডিনই পরে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনেন যে, আমি বরাদ্দ সময়ের চেয়ে বেশিদিন ধরে থাকছি। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সেটা আমার প্রাপ্য অধিকার ছিল। ২০২২ সালের ২ আগস্ট আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির কাছে আপিল জমা দিলে, তিনি আমার মামলার যথার্থতা স্বীকার করে সেটি নতুন ছাত্রকল্যাণ ডিনের কাছে পাঠান। নতুন ডিন মৌখিকভাবে আমাকে আশ্বাস দেন যে, আমার আপিলটি ন্যায্যভাবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু আদতে তিনি আমার আপিলটি আটকে রাখেন এবং তা বিবেচনার জন্য কখনো পাঠানোই হয়নি। ফলে, ইচ্ছামত আমার বৃত্তির পরিমাণ কমানোর শাস্তি বহাল থাকে।২০২২ সালের নভেম্বরে, আমি এই ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আয়োজিত এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেই। বহু শিক্ষার্থী, বিশেষত সার্কের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলা বৈষম্যমূলক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ ছিল এটা। পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ উপায়ে আমরা আমাদের ন্যায্য উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, প্রক্টর আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে আলাদা করে শাস্তি দেন, যার মধ্যে একজন ছিলাম আমি। আরো একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখানো হলো। কোনো তদন্ত বা শুনানি হয়নি, আমাদের দিকটা বলার কোনো সুযোগও দেওয়া হয়নি। সেই পাঁচজনের মধ্যে একমাত্র আমাকেই সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়, পরে জোর করে আমাকে দিয়ে একটা অনুশোচনাপত্র লিখিয়ে নেওয়ার পর তা কমিয়ে কেবল জরিমানা আদায় করা হয়। তার উপর, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আমাকে জানানো হয় যে, নতুন ডিন কোনো নোটিশ বা কারণ ছাড়াই ফাইন্যান্স অফিসকে নির্দেশ দিয়েছেন আমার বৃত্তির একটি বড় অংশ কেটে নিতে।
আমাদের ভারতীয় সহপাঠীরা পেলেও, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে কোনোপ্রকার অর্থায়নের সুযোগ পেত না। অথচ তাদের কাছ থেকেও একই ধরনের একাডেমিক ফলাফল ও উচ্চমানের আচরণ প্রত্যাশা করা হতো। যে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল সার্কের সকল সদস্যের জন্য সমতা নিশ্চিত করা, সেখানেই কার্যত ভারতীয় আধিপত্য ও বৈষম্যকে উসকে দেওয়া হচ্ছে, যাতে করে অভারতীয়দের জন্য এক স্থায়ী অনিরাপত্তার দশা নামিয়ে আনা যায়। সমতার দাবিতে যেকোনো উদ্যোগ অনুষ্ঠিত করতে গেলেই পদ্ধতিগতভাবে তা বাতিল ও দমন করা হতো। যেমন, ২০২২ সালের নভেম্বরে আমাদের প্রতিবাদের পর বিশ্ববিদ্যালয় আচরণবিধি পালটে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে, যেখানে ভবিষ্যতের যেকোনো ধরনের বিক্ষোভকে খারিজ করা হয়। যেসব শিক্ষক বা কর্মচারী প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাদেরকেও চুপিসারে এক কোণে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট জবাবদিহিতা চেয়ে ও ন্যায্য প্রক্রিয়া অনুসরণের অনুরোধ জানিয়ে একের পর এক চিঠি ও আবেদনপত্র পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাইনি। প্রতিবার উপেক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার আর্থিক দুরবস্থা তো আরো বেড়ে চলছিলই, সেইসাথে যে প্রতিষ্ঠানটিকে আমি একসময় গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম তার ওপর থেকে ধীরে ধীরে আস্থা হারিয়ে ফেলছিলাম। একটা শেষ মরিয়া চেষ্টা হিসেবে আমি ডিনের অফিসে যাই, কিন্তু তার প্রকাশ্য বিরূপ আচরণে আমি প্রচণ্ডভাবে অপদস্থ হই। এরপর আর কখনো সাহস করে সেখানে যাওয়ার শক্তি পাইনি।সেই সময়, ডিনের পক্ষের এক শিক্ষকদলের কিছু সদস্য ধারাবাহিকভাবে আমাকে হয়রানি ও হেনস্থা করতে শুরু করেন। আমার প্রতি তাদের বৈরিতা কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেই সীমিত ছিল না, বরং তাদের প্রভাবে কিছু শিক্ষার্থীও আশকারা পেয়ে যায়। আমি লক্ষ্য করলাম, নিয়মিত আমাকে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। এসব কিন্তু কোনো অসদাচরণের কারণে ঘটেনি, বরং ঘটেছিল কেবল অন্যায়ের মুখে নীরব থাকতে অস্বীকার করার কারণে। আমার এই স্বভাবটাই শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, মহাশিবরাত্রি উদযাপনের দিন আরএসএস-সম্পৃক্ত কিছু শিক্ষার্থী হুড়মুড়িয়ে মেস হলে ঢুকে অমিষ খাবার পরিবেশনের বিরুদ্ধে তথাকথিত ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে শুরু করে। অথচ তারা নিজেরা যে খুব ধর্মভক্ত ছিল তা না। তারা উপবাসও করছিল না, এবং এসব করার কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমতিও তাদের ছিল না। ডিনের প্রত্যক্ষ আশ্রয়ে তারা হুমকিধামকি দিয়ে মেস সেক্রেটারি এক নারী শিক্ষার্থীকে ঘিরে সশরীরে তেড়ে আসে। আমি হস্তক্ষেপ করি এবং এই উসকানিদাতাদের পালের গোদাটাকে সরিয়ে দেই। একজন মানুষ হিসেবে নিজের চোখের সামনে আরেকজন মানুষকে হামলার মুখে পড়তে দেখে সহজাতভাবেই আমি এমনটা করি। এজন্য দলটা আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারা আমাদের যে নোংরা গালিগালাজ এবং মারধর করেছিল, তা ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়।
এরপর যখন প্রক্টরিয়াল তদন্ত চালু হলো, তখন আমি কোনো অনুকম্পা চাইনি, চেয়েছিলাম ন্যায়বিচার। ঘটনার মূল হোতা যিনি ছিলেন তার আদর্শিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সবারই জানা ছিল। তিনি স্বীকার করেন যে, খাবার সরানোর দাবি তোলার মতো কোনো লিখিত অধিকার তার বা তার দলের কারোই ছিল না। তিনি আরো স্বীকার করেন যে, ডিনের সঙ্গে মৌখিক যোগাযোগের ভরসাতেই তিনি এ কাজ করছিলেন। কিন্তু ডিন বা তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের তদন্ত চালানোর বদলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু আমাকে বাদ দিয়ে সব শিক্ষার্থীকেই পুনর্বহাল করে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, আমি নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছি এবং সহিংসতা উসকে দিয়েছি। ২০২২ সালে আমি যে অনুশোচনাপত্র লিখেছিলাম, সেটিকে তারা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে দাবি করে যে, আমি ঝামেলা বাঁধিয়ে বেড়াই। এবং আক্রমণকারীরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, আমি প্রশাসনবিরোধী, বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী এবং ভারতবিরোধী, ফলে আমাকে যেন বহিষ্কার করা হয়।
আমাকে আমার শিক্ষার অধিকার, আর তার সঙ্গে জীবিকা অর্জনের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আপিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আসছি, কিন্তু কোনো জবাব পাইনি। আমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক, ভারতের বাংলাদেশ হাইকমিশন, এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছেও লিখেছি, কিন্তু কোনো হেলদোল দেখতে পাইনি। মুহাম্মদ ইউনূস যতই দেশীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বার্থে সার্ককে নতুন করে প্রাণ দেওয়ার কথা বলুন, কিংবা তার সরকার যতই ভারতের প্রতি অবিশ্বাস দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক মাতামাতি করুক, আমার প্রতি তারা সামান্য সহানুভূতিও দেখাননি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা তো দূরের কথা। একটি বাংলাদেশি গণমাধ্যম, যারা ভারতবিরোধী বক্তব্য দিতে কখনোই পিছপা হয় না, তারাও ভারতে এক বাংলাদেশির নির্যাতনের খবর পেয়ে চুপ থেকেছে। একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে অন্যায় হলে তা জাতীয় ইস্যু হয়ে ওঠে। কিন্তু একজন হিন্দুর প্রতি অন্যায় হলে তা সেই হিন্দুকে জাতীয় লজ্জায় পরিণত করে। ভারত ও বাংলাদেশের নেতারা যখন রাজনৈতিক পরিচয়ে একে অপরকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত, তখন গোঁড়া ও বিদ্বেষী মনোভাব জনগণের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসছে, যা মানুষকে জাতীয়তাবাদের নামে বে-আইনি কাজ করার সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। এই দায়মুক্তি থেকে জন্ম নেওয়া অন্যায়ের ফলেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন এবং ভুগছেন।●
সুদীপ্ত দাস অর্থনীতি বিভাগের একজন ছাত্র।