ট্রাম্পের প্রতি ভারতের আনুগত্য বনাম চীনের লড়াই

দক্ষিণ এশিয়ার অভিজাতরা তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। তারা ন্যূনতম প্রতিবাদটুকু না জানিয়ে পরাজয় স্বীকার করেছে। তারা কি বুঝতে পারছে পৃথিবী বদলে গেছে?

ট্রাম্পের প্রতি ভারতের আনুগত্য বনাম চীনের লড়াই

ভারতীয় কূটনীতিকরা ঠিক কোন জগতে বাস করেন? আত্মসমর্পণকে তারা রীতিমতো শিল্পে রূপ দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকের সঙ্গে আলোচনার পর আমার মনে হলো যে, তারা সংহতির ধারণা পোষণ করেন না। মুখস্থ করা একেকটি লাইনের প্রতিধ্বনি করে চলেন মাত্র। তিনি চীনকে "বিচ্ছিন্ন অভিযাত্রী” বলে অভিযুক্ত করেন এবং ইঙ্গিত দেন যে ভারতের সবকিছু বোঝার জ্ঞান ছিল এবং এখনও আছে।

অথচ ইইউ এবং কানাডাও প্রতিক্রিয়ায় শুল্ক বাড়িয়ে অন্তত কিছু কার্ড টেবিলে রেখেছিল। চীন যদি একাকী অভিযাত্রী হয়, তাহলে উপমহাদেশের অভিজাতদের হাতির দাঁতের টাওয়ারের বাইরে যারা বাস করেন তারা কি তাদের প্রতিবেশীর দৃঢ়তার  প্রশংসা করবে, পাল্টা আঘাত করবে নাকি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নেতৃত্ব দেবে?

প্রকৃতপক্ষে, ভারত যখন গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, তখন সেখানে চীনই রয়েছে চালকের আসনে। সারা বিশ্বে (ভারত ছাড়া) তার বিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রোগ্রাম রয়েছে এবং অবশ্যই অবিচ্ছিন্নভাবে।  আর এখন তারা সম্মুখ সমরে প্রবেশ করেছে। যেখানে তারা প্রকৃত কূটনীতি বেছে নেবে।

কূটনীতির নামে প্রহসন

ট্রাম্প প্রকাশ্যে আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে "চীন সিদ্ধান্ত নেবে" অন্য ৭০ জন নেতার মতো। বেইজিং যখন প্রতিশোধ নেয় তখন তিনি শুল্ক বাড়িয়ে দেন, কারণ, "তারা সম্মান দেখায়নি।" 

মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ভাল পরামর্শ কেউ দিচ্ছেন না আর সম্ভবত তিনি খারাপ পরামর্শ শুনতেই স্বচ্ছন্দ।  পিটার নাভারো এবং গর্ডন চ্যাং চরম চীন-বিরোধী বিশেষজ্ঞ, নতুন প্রশাসনকে তারাই অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন। যদিও এলন মাস্ক এ ক্ষেত্রে বিরল, তিনি নাভারোকে আঘাত করার সময় এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন।

ট্রাম্প উইলিয়াম ম্যাককিনলেকে (১৮৯৭ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি) শুল্কের ক্ষেত্রে তার রোল মডেল হিসেবে দেখেন। সমস্যা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন আর সেই সময়ের মতো শক্তিশালী উৎপাদন শক্তি নেই। তাদের কাছে দক্ষ শিল্পকর্মী বাহিনী বা অবকাঠামো নেই।

চীন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেউ কেউ এটিকে বিপরীত নিক্সন মুহূর্ত (১৯৭২) বলে অভিহিত করছেন। কারণ তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাওবাদী চীনকে পূর্ণ অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

বর্তমান পারমাণবিক ক্ষমতাশালী নেতা বিরতির সময়কাল শেষ হয়ে গেলে (অথবা তার আগেও) পুরো শুল্কের বিষয়টি সহজেই বাতিল করতে পারতেন। তখন যদি ইরানের উপর পূর্ণাঙ্গ বিমান হামলা চালানো হয়, তাহলে আমাদের অবাক হতে হবে না এবং মিডিয়াই তার কভারেজ দেবে। বিকল্পভাবে, তারা মেক্সিকোকে সিকারিওর মতো করে দেখতে পারে (ট্রাম্প রেকর্ডে বলেছেন যে মেক্সিকানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাদক, ধর্ষণ এবং অপরাধ নিয়ে আসে)। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে যে কোনো কিছু সম্ভব।

ধূর্ত নাকি নীতিহীন?

দিল্লির কূটনীতিক, নেতা এবং মিডিয়া মোঘলরা এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ব্যাখ্যা করেছেন— "আমরা ইতিহাসের এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে ভারত বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি সুযোগে রূপান্তরিত করার জন্য প্রস্তুত...জীবনকালের একটি সুযোগ।"

ট্রাম্পকে দোষারোপ করার পরিবর্তে, বিশ্বের অন্যান্য অংশ যেমন করছিল, তিনি দাবি করেছেন, "এই [অস্থিরতার] সূচনা আসলে ২০০০ সালের শুরুতে যখন চীনকে ডাব্লিউটিও (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার)-এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।"  ভারত ১৯৯৫ সালে এ সংস্থায় যোগ দেয়।

পীযূষ গোয়েল ট্রাম্পের সমস্ত কিছুর জন্য চীনকে দোষারোপ করার যুক্তিকে সমর্থন করেন। তারপরে ট্রাম্প পিছু হটলে এবং ৯০ দিনের বিরতি দিলে তাকে বেশ বিভ্রান্ত দেখায়।

দ্য প্রিন্ট পত্রিকার সম্পাদক ও চেয়ারম্যান শেখর গুপ্ত ভারতের (চীনের জন্য) সঙ্কটকে কীভাবে নষ্ট হতে দেওয়া উচিত নয়, তা তুলে ধরেন।  তিনি আমেরিকান কৃষিক্ষেত্রের দরজা খুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেন, ট্রাম্পকে সমর্থন দান করেন যাতে তিনি চীনের উপর তার আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করতে পারেন। এটি একটি সূক্ষ্ম, সুনির্দিষ্ট কৌশল এবং একইসঙ্গে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের ক্ষমতাশালীদের ঐকমত্যের  নজির।

যদি তাদের সহযোগী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে গভীর সংলাপ করা যায়, তারা তা কেন করবেন না? কেন আসিয়ানের আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং ৬০ কোটি শক্তিশালী ব্লকের সাথে উপমহাদেশের সংহতি প্রকাশ করবেন না? সমন্বিত প্রতিক্রিয়া প্রকাশেই বা বাধা কোথায়, কিংবা চীনের কাছে যাওয়ার প্রশ্নে সঙ্কটই বা কি যেটাকে একেবারে অপছন্দ করা হচ্ছে? 

ট্রাম্প ইতোমধ্যেই চীনের প্রশ্নে আংশিকভাবে পিছু হটেছেন। স্মার্ট ফোন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্সকে ১২৫ শতাংশের অযৌক্তিক হার থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তামিলনাড়ু ভারতের অ্যাপল আইফোন অ্যাসেম্বলিতে নেতৃত্ব দেয় কিন্তু চীনে অ্যাপল উৎপাদন প্রতিস্থাপন করতে বছরের পর বছর সময় লাগবে, যা এখনও মোট আউটসোর্সড আউটপুটের ৮০ শতাংশ।

এখানে ভারতীয় "সুযোগ" কী হবে? সাময়িক সুবিধা স্থায়ী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

একটি উপমহাদেশীয় অবহেলা

স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল বাজার হঠাৎ করে হারানোর সামর্থ্য রাখে না।  তারা তাদের নেতাদের কাছ থেকে ওয়াশিংটনের সাথে কিছু যোগাযোগ আশা করে। কিন্তু তাই বলে  চীনের সাথে কথা বলার কী হবে? মধ্যমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সমানভাবে কথা বলা।

দিল্লির উচিত ছিল বিমসটেক সম্মেলনে তার নিকটতম প্রতিবেশীদের একত্রিত করা। মোদি তখন আসিয়ান বা আরও ভালভাবে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য ব্লক আরসিইপি’র সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন। তারপর শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলো একই সাথে ওয়াশিংটনকে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য বার্তা দিতে পারতো এবং ইঙ্গিত দিতে পারতো যে প্রকৃত আলোচনার জন্য (আত্মসমর্পণ নয়) দরজা খোলা রয়েছে।

তারপর ব্রিকস আছে, যেখানে ভারত, চীন, ব্রাজিল এবং অন্যান্য সদস্যদের সাথে (রাশিয়া বাদে, যারা শুল্কের আওতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল) যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতো।

কিন্তু দেখা গেল, ৩ এপ্রিল, রাহুল গান্ধী মোদী এবং জয়শঙ্করের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, চীন যখন ভারতের ৪০০০ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড হিমালয়ে দখল করে আছে তখন ভারতের বিদেশ সচিব চীনা রাষ্ট্রদূতের সাথে চা খেতে বসেছেন।

তিনি কি লক্ষ্য করেছেন যে ৮০ কোটি ভারতীয় “বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ” ছাড়া বাঁচতে পারবেন না? এমনকি মোদীও বুঝতে পেরেছেন যে ভারত যদি শিল্পায়ন করতে চায়, তাহলে তার জন্য চীনা প্রযুক্তিবিদ, উপাদান এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন। মোদীর এই শিক্ষা নিতে দশ বছর সময় লেগেছে। মনে রাখবেন, "মেক ইন ইন্ডিয়া" প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থতার জন্য তিনি নীরবে প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ (পিএলআই) ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রামটি বাতিল করে দিয়েছিলেন।

এরপর যা-ই ঘটুক না কেন, এমনকি যদি নাভারোকে অসম্মানজনকভাবে গুলাগে পাঠানো হয়, দক্ষিণ এশিয়াকে বুঝতে হবে, যেমন ভিয়েতনাম বেদনাদায়কভাবে বুঝতে পারে যে মার্কিন বাজার আর নিরাপদ নয়। ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকের বেশিরভাগ সময়ে এটা বিস্তৃত ও নিরাপদ ছিল। এটি এখনও বৃহত্তম একক বাজার। কিন্তু উদাহরণ হিসেবে স্মরণে রাখা উচিৎ যে , বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনেক বেশি পোশাক বিক্রি করে। যদিও আমেরিকান বাজার রাজনীতির দাপটে বিষয়টা প্রায় অনুল্লেখিত থাকছে। এখন, ইউরেশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকায় সে সম্ভাবনা তীব্র হয়ে উঠছে।

চীনারা সক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক কূটনীতি পরিচালনা করছে। শি জিনপিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর করছেন। তার বাণিজ্যমন্ত্রীও একই কাজ করছেন এবং অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি ঢাকায় অবতরণ করবেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তী নেতার সাম্প্রতিক সফর ছিলো বিনিয়োগের জন্য যা অন্য কিছুর দিকেও ধাবিত হবে। 

বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে

গত সপ্তাহে, শি জিনপিং প্রতিবেশীর উপর জোর দিয়েছিলেন। আগামী দশকটি হবে চীনের কারখানাগুলোর কতটা এশিয়ার দরিদ্রতম অংশে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থানান্তরিত হবে তা নিয়ে। এখন যেহেতু ট্রাম্প বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে রাজনীতিকরণ করেছেন, বেইজিং বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোকেও চিহ্নিত করবে যেখানে তার কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ করা উচিত।

দিল্লির "কৌশলগত অস্পষ্টতার" অভিনন্দনমূলক ভঙ্গি, যা তার সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো অনুকরণ করে, আর তা করবে না। ক্রমবর্ধমান দ্বিখণ্ডিত বিশ্বে, নেতাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। তাদের অন্যতম কাজ হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের জন্য তাদের প্রাথমিক মিত্র নির্বাচন করা।

জেনারেশন জেড পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দেশে বিশাল বিক্ষোভ করেছে, একটি বৈশ্বিক ইস্যুতে সংহতি প্রকাশ করেছে। তারা (পুরাতন রাজনীতির সাথে) শুল্ক এবং দ্রুত বিকশিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে বিন্দুমাত্র মিলিত হয়নি।

এই বিষয়ে জেনারেশন জেডের বর্তমান নেতারা কি চীনের সাথে যোগাযোগের বাইরে? নতুন রাজনীতি স্থায়ীভাবে পশ্চিমমুখী পুরাতন রাজনীতির ছায়ায় রয়ে গেছে। তারা কেবল অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলছে। বিশ্বব্যাপী সংস্কার এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে যোগদানের বিষয়ে তা কী ভাবছে?●

ফরিদ এরকিজিয়া বখত একজন লেখক ও বিশ্লেষক।