আদিবাসী নিধন!
খাগড়াছড়ি সদরের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম নরানখাইয়া। ২০২৪-এর ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর থেকেই সেখানে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। গ্রামবাসীর মধ্যে চাউর হয় আশেপাশের বাঙালি বাসিন্দারা যে কোনো সময় তাদের গ্রামে আক্রমণ করতে পারে। ওইদিন সকাল থেকেই দিঘীনালাসহ কয়েকটি আদিবাসী গ্রামে বাঙালিদের হামলা, অগ্নিসংযোগের ভিডিও দেখা যাচ্ছিল ফেসবুক ও ইউটিউবে। গ্রামের নারী-পুরুষকিশোর-যুবারা তখন নিজেদের বসতভিটা রক্ষার জন্য জড়ো হতে থাকেন রাস্তায়। সন্ধ্যার পরপরই উপজেলা কার্যালয়ের সামনের সড়ক দিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়িবহরকে তাদের গ্রামের দিকে এগুতে দেখেন। গ্রামবাসীর অবস্থান দেখে সেনাসদস্যরা অল্প দূরত্বে অস্ত্র তাক করে পজিশন নেন। একটু পরেই তারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় রাস্তায় অবস্থান নেওয়া জটলাটি। এরপরই সরাসরি গুলি করতে করতে সামনে এগুতে থাকেন সেনাসদস্যরা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নরানখাইয়ার বাসিন্দা কলেজছাত্রী সুস্মিতা চাকমার বর্ণনায় উঠে আসে এ চিত্র। তিনি নেত্র নিউজকে বলছিলেন, “ আর্মির সদস্যরা রাত ৯টার দিকে গুলি করতে করতে স্বনির্ভর এলাকার দিকে চলে আসে। তারা পাহাড়ি ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা।”
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় জুনান চাকমা পানছড়ি সরকারি কলেজ থেকে গত বছর এইচএসসি পাস করেন। জুনানের মা রূপসী চাকমা গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমার ছেলের জীবন সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। মাত্র ২০-২১ বছর বয়স ছিল ওর। আমার ছেলে কী দোষ করেছে যে সেনাবাহিনী এত অত্যাচার করে মারলো?”
বলেন, “আমার ছেলে শুনেছে দিঘীনালায় বাঙালি ও আর্মিরা ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, সে কারণে সে স্বনির্ভর গ্রামে ডিউটি দিতে গিয়েছিলো যাতে সেখানে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে না পারে। তাতে কী অপরাধ করেছে আমার ছেলে?”
আদিবাসী অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা বলছিলেন “ গত ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে চাকমা সম্প্রদায়ের ৩ জনকে (জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা, ধনঞ্জয় চাকমা) হত্যা করা হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ এসব ঘটনার সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত। এলাকাবাসীরও একই অভিযোগ। তারা যখন এলাকায় তাদের বাড়িঘর পাহারায় নামলো তখন সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি, বরং তাদের সাথে অবিচার করা হচ্ছে।’’
মাইকেল চাকমাকে ২০১৯-এর ৯ এপ্রিল থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা—ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটলে তিনি মুক্তি পান। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল মাইকেল চাকমার। নেত্র নিউজকে তিনি জানান, সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা তার সেই প্রত্যাশাকে নড়বড়ে করেছে।
ওই ঘটনায় ১৮ বছর বয়সী রুবেল ত্রিপুরার মৃত্যুর পর খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে তার পোস্টমর্টেম করা হয়। নেত্র নিউজের কাছে থাকা পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা-, “কনসিডারিং পোস্টমর্টেম ফাইন্ডিংস, ইন আওয়ার অপিনিয়ন কেস অফ ডেথ ওয়াজ ডিউ টু হেমোরেজিক শক অ্যাজ এ রেজাল্ট অফ অ্যাবোভ মেনশনড ইনজুরিস এন্ড ওয়াজ কনসিসটেন্ট উইথ গানশট ওন্ড।”
জুনান চাকমার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা লিখেছেন, “পোস্টমর্টেম ফলাফল বিবেচনা করে, আমাদের মতে মৃত্যুর ঘটনাটি উল্লিখিত আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ এবং বন্দুকের গুলির আঘাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
ভুক্তভোগীর পরিবার ও আদিবাসী অধিকার কর্মীদের অভিযোগ, ধনঞ্জয় চাকমাকে প্রথমে সেনাসদস্যরা রাস্তা থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। এরপর সেনা হেফাজতে নির্যাতন করা হয়। বেয়োনেট দিয়ে পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছিল ধনঞ্জয়ের। এরপর তাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়।
নেত্র নিউজের কাছে থাকা ধনঞ্জয় চাকমার মৃত্যু সনদটিতে মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে ‘হত্যা’।
২০২৪-এর সেপ্টেম্বরের এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৪ অক্টোবর বিবৃতি দেয় জাতিসংঘ। আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের চেয়ারপারসন ও বিশেষ প্রতিনিধির সেই বিবৃতিতে বলা হয়, “সেপ্টেম্বরের সিরিজ সহিংস ঘটনাগুলো যুগ যুগ ধরে পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক শাসনের অধীনে আদিবাসী জুম্ম মানুষদের জোরপূর্বক উৎখাত ও বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি।”
বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোতে আদিবাসী বিদ্বেষ, অপ্রচার ও গুজব-সংক্রান্ত কনটেন্ট সরিয়ে নিতে এবং সরেজমিনে পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে সহযোগিতা করতে অন্তবর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।
রুবেল ত্রিপুরা, জুনান চাকমা ও ধনঞ্জয় চাকমাকে হত্যার বিষয়ে জানতে চেয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)—এর সঙ্গে ইমেইলে যোগযোগ করা হলে নেত্রনিউজকে কোন জবাব দেওয়া হয়নি।
সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়িতে এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০২৫—এর ১৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় আদিবাসী শিক্ষার্থী ও অধিকারকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ থেকে আদিবাসী সম্পর্কিত গ্রাফিতি সরানোর প্রতিবাদে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনের সামনে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতা ও সমমনা বাঙালিদের মিছিলে এ হামলায় অন্তত ১৭ জন আহত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চ্যগা তাদের একজন।
মাথায় ডজনখানেক সদ্য সেলাই নিয়ে শ্রেষ্ঠা ওইদিন রাজধানীর স্পেশালাইজড হাসপাতালের বেডে কারতরাচ্ছিলেন। ডান হাতের আঙ্গুলের নখ উঠে গেছে, আঙ্গুল ব্যান্ডেজে মোড়ানো। আঘাতের চিহ্ন পাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট।
তিনি বলছিলেন, “ওরা আমাদের মিছিলে হামলা করে। প্রথম আঘাতটা আসে অনন্ত বিকাশ ধামাই দা ও আরও একজন দাদার ওপর। আমরা ওই জায়গাতেই বসে পড়ি। তারপর ওরা এতটা উগ্র হয়ে যায় যে, আবারও হামলা করে। আমার মাথায় দুইবার আঘাত করে। আমি যখন মাটিতে পড়ে যাই তখনও আমার মাথাকে টার্গেট করে আঘাত করতে থাকে। ওই সময় আমার অনিক চাকমার কথা মনে পড়ে। আমাদের পাহাড়ে এরকম হামলা প্রায়ই হয়। অনেক বছর ধরে প্রায় প্রতিবছরই এ রকম হামলা হয়ে আসছে। আমরা মাইর খাই, কিন্তু পেপারে আসে যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ।”
স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামের একটি সংগঠনের ওই হামলায় রুপাইয়াসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ৯ শিক্ষার্থী সেদিন আঘাতপ্রাপ্ত হন। যার ছবি ও ভিডিও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিনের হামলায় আহত হন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি ডন যেত্রা। ডনের পিঠে অসংখ্য লাঠির আঘাত, কালশিটে দাগ, গলায় এবং দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজ, পায়েও মারের চিহ্ন ছিল। “ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে একদল বর্ণবাদী, উগ্র মব আমাদের ওপর হামলা করলো। আমরা অস্তিত্ব সংকটে ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি”--বলছিলেন তিনি।
১৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় আদিবাসী শিক্ষার্থী ও অধিকারকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় আহত রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চ্যগা এবং ডন যেত্রা। ছবি: নেত্র নিউজ
একই হাসপাতালে মাথায় ও নাকে গুরুতর আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ডিবিসির সিনিয়র রিপোর্টার জুয়েল মারাক।
এসব বিষয়ে নেত্র নিউজের সঙ্গে কথা বলেন আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ। “পুলিশের সামনেই আমাদেরকে প্রথম দফায় হামলা করে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি। স্ট্যাম্প, হকিস্টিক এবং লাঠি দিয়ে তারা আমাদের ওপর আক্রমণ করে। পরবর্তীতে আমরা রাস্তায় বসে পড়ি। সেখানেই দ্বিতীয় দফায় হামলা করা হয়।”
হামলার বিষয়টি নিয়ে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির যুগ্ম আহ্বায়ক মুহম্মদ ইয়াকুব মজুমদারে কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন- “আমাদের লাঠি ছিল, কারণ আমাদের প্রতিরক্ষার অধিকার আছে। এ সিচুয়েশনটা তো হতোই না যদি উনারা পুলিশের কথা শুনতেন। ওখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী। আর উনাদের যে অঙ্গভঙ্গি, সেটা হামলা করবে করবে এইরকম। পুলিশ তো সবসময় আমাদের সাথে ছিল।”
এ হামলার প্রতিবাদে ১৬ জানুয়ারি মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি দেয় সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা। সেদিন সকালেও প্রতিবাদকারীদের ওপর বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারুফ হাসান বলেন- “মিছিলটা শিক্ষা ভবনের যাওয়ার পরপরই পুলিশ বাধা দেয়। ব্যারিকেড এড়াতে গেলে জলকামান, লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নেবুলা আহত হন। গুরুতর আহত হন একজন পথচারীও।”
আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সাবেক সমন্বয়ক হানা শামস আহমেদ নেত্র নিউজকে বলেন, “ ১৫ জানুয়ারির সহিংস ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই সংগঠনের (স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি) সদস্যরা তাদের লাঠির সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে আদিবাসী ছাত্রদের উপর আক্রমণ করে, যেটি উগ্র জাতীয়তাবাদের হিংসাত্মক রূপকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে জানান দেয়, যারা পুলিশ এবং গণমাধ্যমের সামনে নির্দ্বিধায় সহিংসতা করতে পারে। গ্রুপটি এতটাই ক্ষমতাবান যে, এনসিটিবি কারও সাথে পরামর্শ ছাড়াই রাতারাতি তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির কার্যকলাপ থেকে এটা স্পষ্ট যে, তাদের পেছনে সামরিক এবং গোয়েন্দা এজেন্টদের শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে এবং তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো দেশের আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সহিংস জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে উস্কে দেওয়া।”
মাইকেল চাকমা বলছিলেন, “ঢাবির হামলার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। পাহাড়ে অহরহ ঘটছে। লংগদু গণহত্যা, কলমপতি গণহত্যা, নানিয়ারচর গণহত্যাসহ আজ পর্যন্ত যা ঘটেছে আদিবাসী পল্লীগুলোতে, একটা ঘটনারও বিচার আমরা পাইনি। কল্পনা চাকমাকে যারা গুম করেছে তাদের নামে তো মামলা হয়েছিলো, চিহ্নিত ছিলো তারা, অথচ মামলাটাও শেষ করে দিয়েছে। যা হচ্ছে তা জাতিগত নিপীড়ন।”
“শেখ হাসিনা রেজিমে আদিবাসীদের ওপর যে জাতিগত নিপীড়ন হয়েছে তা এখনও চলছে। এমনকি সমতলের কোনো বাঙালি বন্ধু যখন আমাদের অধিকারের কথা বলেন তখন তাদেরও টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছ ”— যোগ করেন মাইকেল চাকমা।
আদিবাসী পরিচয় ও গ্রাফিতি ইস্যুতে ঢাকার রাজপথ যখন রক্তাক্ত, তখন তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলার সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর। হামলার প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি প্ল্যাকার্ড হাতে সত্তরোর্ধ আদিবাসী নারী থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী-তরুণ ও অধিকারকর্মীরা সমবেত হন টাঙ্গাইলের মধুপুরে।
মধুপুরের গাইরা গ্রামের বাসিন্দা অনিতা চাম্বুগং বলেন, “আদিবাসী কথাটা থাকলে কি সমস্যাটা হয় সরকারের বা বাঙালিদের? আমি আদিবাসী, আদিবাসী বলার কারণে আজ এতটা লাঞ্ছিত হতে হয়। আমাকে মেরে ফেলুক, কেটে ফেলুক, যাই হোক, আমি তো আদিবাসী।”
গ্রামটির আরেক বাসিন্দা সুমা মৃ বলেন, “ঢাকায় আদিবাসীদের ওপর হামলা হচ্ছে, এখানে এলাকার বাঙালিরা আমাদের ব্যঙ্গ করে, বলে—চ্যাং চুং। ওরা জানে যে আমাদের আলাদা ভাষা আছে। তারপরও এ রকম করে।”
মধুপুরের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের অভিযোগ, বিশাল বনভূমি কেটে সামাজিক বনায়ন ও কৃত্রিম লেক স্থাপনের মতো উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে সমতলের আদিবাসীদের জমি দখল চলছে। মধুপুরের বাসিন্দা এলভিনা রিছিলের কথায়—“জায়গাগুনা উচ্ছেদ করবার চায়। এইহানে নাকি থাকতে দিবে না। আমরা জানি যে আমরা এহানেই থাকমু, এহানেই মরমু। এ জায়গা আমরা কোনোহানে ছাইড়া যামু না।’
ভূমির মালিকানা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। আদিবাসী অধ্যুষিত গাইরা গ্রামের বাসিন্দা ডেভিড চিরান বলেন, “এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের এই গ্রামটা ছাড়া আশপাশের কোথাও শাল গাছের বন দেখতে পাবেন না। অংশীদারিত্বের নামে বনবিভাগ যে প্রকল্পগুলো আনছে তাতে বন উজাড় করে আবার নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে লিজ দিয়ে প্রকৃত বন কেটে ওখানে চাষবাষ করা হচ্ছে।”
মামলা দিয়ে আদিবাসীদের হেনস্তা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন চিরান। বলেন, “১৯৬১ সনের, মার্চ মাসে আমার জন্ম। তারও আগে থেকে আমার বাপ-দাদারা, আমাদের জায়গাগুলোতে বসবাস করে আসছে। আমাদের দাবি-- জমি যেটুকু দখলে আছে সেটা সরকার বন্দোবস্ত করে দিক।”
২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে ইকোপার্ক নির্মাণের লক্ষে বনবিভাগ প্রাচীর তুলতে গেলে তার প্রতিবাদ করে স্থানীয় গারো অধিবাসীরা। এসময় বনরক্ষীদের গুলিতে নিহত হন আদিবাসী যুবক পীরেন স্নাল। এ ঘটনার পর পীরেনের বাবা নেজেন নকরেক একটি হত্যা মামলা করলেও আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ভূমিরক্ষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মারডি ও রমেশ টুডু নামের তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। তার আগে পুলিশ উচ্ছেদের লক্ষে সাঁওতালপল্লীতে আগুনও দেয়, যার ভিডিও তখন সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
সমতলের পাশাপাশি পাহাড়েও নেওয়া অপরিকল্পিত প্রকল্প সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনকে বিপন্ন করছে বলে অভিযোগ করেন জয় চাকমা নামের এক ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট। তিনি বলেন, “আমার বাড়ি রাঙ্গামাটি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে চিরচেনা পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে উন্নয়ন হলো শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা। অথচ দুঃখজনক হলো স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল না হয়ে সেখানে হচ্ছে টুরিস্ট স্পট, রিসোর্ট।”
পাহাড়ে ধর্ষণ, গুম
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন আদিবাসী নারী অধিকারকর্মীরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভানেত্রী কণিকা দেওয়ানের ভাষ্য– “২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি, রাঙ্গামাটিতে মারমা দুই বোন আর্মি সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত হন। তল্লাশির নামে নারীদের ওপর অত্যাচার চলে। প্রায়শ এসব ঘটলেও এগুলো গণমাধ্যম বা অন্য কোনো পত্রপত্রিকায় খুব কমই আসে। আর আমরা যারা অধিকারকর্মী তাদের ওপরও নিপীড়ন নেমে আসে। মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়, অপহরণ করা হয়।”
কণিকা দেওয়ান যে ঘটনার কথা বলছিলেন তা ঘটেছিলো রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে। মধ্যরাতে ওরাছড়ি গ্রামে সেনাতল্লাশির এক পর্যায়ে গ্রামটির মারমা সম্প্রদায়ের একটি বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ১৮ বছরের মারমা কিশোরীকে ধর্ষণ ও তার ১৩ বছর বয়সী বোনকে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, ফারুয়া সেনা ক্যাম্পের কয়েকজন সদস্য এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চাইলে মামলা না নিয়ে শুধুমাত্র জিডি নেয় স্থানীয় থানা।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাতে পাহাড়ে সেনাসদস্যের হাতে সবশেষ ধর্ষণচেষ্টার খবর জানা যায়। রাঙ্গামাটি জেলার সাজেকের লক্ষীছড়ি সেনাক্যাম্প কমাণ্ডার ওয়ারেন্ট অফিসার (সুবেদার) মো. আওয়ালের বিরুদ্ধে এক প্রতিবন্ধী আদিবাসী নারীকে ধর্ষণ-চেষ্টার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী নারী ও পরিবারের সদস্যরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার পর সেনাসদস্যরা ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হয়রানি করে। একইসঙ্গে ক্যাম্প কমাণ্ডার ভুক্তভোগীর বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন বলেও অভিযোগ করেন আদিবাসী অধিকারকর্মীরা।
এর আগে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কাপ্তাই সেনা জোনের ৫৬ বেঙ্গলের অধীন রাইখালীর মিতিঙ্গাছড়ি সেনা ক্যাম্পের সাদা পোশাক পরিহিত ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে মিতিঙ্গাছড়ির এসএসসি পরীক্ষার্থী এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। এমনকি ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ ভুক্তভোগীর পরিবার ও গ্রামপ্রধানকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে মুখ খুললে পরিবারটিকে চরম পরিণতির মুখোমুখী হতে হবে বলে হুমকি দেয় বলে নেত্র নিউজকে জানায় হিল উইমেন ফেডারেশন।
সংগঠনটির সাবেক সভানেত্রী কল্পনা দেওয়ান মনে করেন, অতীতের ঘটনাগুলোর কোনো জবাবদিহিতা ও বিচার না হওয়ায় বারবার অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি বলেন-, “১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনায় প্রত্যক্ষ অপহরণকারী লেফটেন্যন্ট ফেরদৌসের এখন পর্যন্ত বিচার করা হয়নি। এখানে গভীর রাতে প্রতিনিয়ত আমাদের আদিবাসীদের ঘর-বাড়িগুলো তল্লাশি করা হয়। রাত ২টা-৩টায় বিনা কারণে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদের মতো করে যদি দিতে না পারি, তাহলে মারধর করা হয়। জোরপূর্বক তুলে নেওয়া হয়। অনেক মানুষকে খুজেঁ পাওয়া যায়নি, যাদেরকে গুম করা হয়েছে।”
দুই আদিবাসী তরুণীর ধর্ষণ ও যৌননিপীড়নের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে আইএসপিআর–এর সঙ্গে ইমেইলে যোগযোগ করা হয়। নেত্রনিউজ কোনো জবাব পায়নি।
২৮ বছরেও খোঁজ মেলেনি কল্পনা চাকমার
১৯৯৬ সালের ১১ জুনের মধ্যরাত। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি লাইল্যাঘোনায় নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয় হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে। কল্পনার পরিবারের অভিযোগ, কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল লোক চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় কল্পনাকে। পরদিন তার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদি হয়ে বাঘাইছড়ি থানায় অপহরণের মামলা করেন এবং তার জবানবন্দিতেও একই অভিযোগ করেন। দীর্ঘ ২৮ বছর ঝুলে থাকার পর ২০২৪ সালের ২৩ এপ্রিল কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজ করে দেয় রাঙ্গামাটির আদালত। কল্পনাকে যখন বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয় তখন তার মা এবং দুই ভাই বাড়িতে ছিলেন। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই জানিয়ে মামলাটির যবনিকাপাত ঘটে।
নির্যাতন করে হত্যা
রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার পূর্ব হাতিমারা গ্রামের বাসিন্দা রমেল চাকমা ছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের অভিযোগ, ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল উপজেলা পরিষদ এলাকা থেকে নানিয়ারচর জোনের একদল সেনাসদস্য তাকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর তার উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ এপ্রিল মারা যান রমেল। রমেল নানিয়ারচর উপজেলা শাখার পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সে সময় সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান জানান, একটি ট্রাক পোড়ানো ও দুটি বাস লুটের মামলার রমেলকে ৫ এপ্রিল আটক করা হয়। ওই দিনই তাকে নানিয়ারচর থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। পুলিশের হেফাজতেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেনাবাহিনীর নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।
তবে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তৎকালীন নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ ডয়চে ভেলেকে জানান, রমেলকে তারা আটক করেনি এবং হাসপাতালেও ভর্তি করেনি৷ তার নামে কোনো মামলা নেই৷ তাকে কারা আটক করেছে সেটা আর্মি অফিসাররা বলতে পারবেন৷
রমেলকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা হাসপাতালে ভর্তি করেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
সেনা ক্যাম্পে নির্যাতন করে পাহাড়ি যুবকদের হত্যার অভিযোগ নতুন নয়। ২০২২ সালের ১৫ মার্চ তুলে নিয়ে যাওয়া হয় খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সদস্য নবায়ন চাকমা মিলনকে। মনিভদ্র পাড়া থেকে দীঘিনালা সেনা জোনের একদল সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে তাকে আটক ও নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ উঠে। প্রত্যক্ষদর্শী পরিবার ও দলের অভিযোগ, মুমূর্ষু অবস্থায় নবায়নকে দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ৩০ মার্চ “বাংলাদেশে সেনা হেফাজতে আদিবাসী অধিকারকর্মীর মৃত্যু” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। প্রতিবেদনটিতে নবায়ন চাকমা মিলনকে নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত সেনাসদস্যদের বিচারের আওতায় আনা উচিৎ বলে জানায় সংস্থাটি।
সবশেষ গত ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা ইউনিয়নের বড়কলক গ্রামে বিমল চাকমা নামের এক ব্যক্তিকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, ৩২ বীর দীঘলছড়ি জোনের শহীদ আতিয়ার ক্যাম্পের (বড়কলক) সুবেদার মোহাম্মদ সাইদের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য বড়কলক বাজারে বিমল চাকমাকে মারধর করে। তারা সুর্য্যসেন চাকমা নামে গ্রামটির আরেক বাসিন্দার বাড়ির ঠিকানা ও তার বিষয়ে জানতে চায়। জবাবে ‘না’ বলায় বিমলকে বেধড়ক পেটায় সেনাসদস্যরা।
২০২৪-এর ২২ মে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযানে বম সম্প্রদায়ের মানুষদের গণগ্রেফতার বন্ধের আহ্বান জানায়।
এর আগে “বাংলাদেশ পারসেকিউটেড ইনডাইজিনিয়াস পিপল” শিরোনামে ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে সেনা হেফাজতে আদিবাসী অধিকারকর্মী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মাটিরাঙ্গা উপজেলা সংগঠক তিমির বরণ চাকমার মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে তুলে ধরা হয়। ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট মাটিরাঙ্গা উপজেলার বাইল্যাছড়ির ইন্দ্রমুনি কারবারিপাড়া থেকে তুলে নিয়ে সেনা ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয় তিমিরের ওপর। অসুস্থ তিমিরকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তিনি সেখানেই মারা যান।
সেনা হেফাজতে বিগত বছরগুলোতে আদিবাসী অধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় বক্তব্য জানতে চেয়ে আইএসপিআরের সঙ্গে ইমেইলে যোগযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
কলমপতি গণহত্যা
১৯৮১ সালের ২৭ মার্চ রাঙ্গামাটি থেকে ডিজিএফআইয়ের হাতে অপহৃত হন জেষ্ঠ্য সাংবাদিক সালিম সামাদ। ৫ দিন পর ডিজেএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা ‘খান বাড়ি’ থেকে মুক্তি পান তিনি। পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী-সেনা সমীকরণ নিয়ে সালিম সামাদ নেত্র নিউজকে বলেন, ‘‘কাউখালী উপজেলার কলমপতিতে ৮০ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা হয়। ২৮ মার্চ পার্বত্য তিন জেলার একজন সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাকমা, যিনি সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে গণহত্যার বিষয়টি তুলতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পয়েন্ট অব অর্ডারে তাকে আলোচনা করতে দেওয়া হয়নি। তখন বাইরে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে ব্যাটালিয়নের নাম, অফিসারের নামসহ বলেছিলেন।”
প্রত্যক্ষদর্শী এক থানার পুলিশ অফিসার কলমপতি গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন জানিয়ে সালিম সামাদ বলছিলেন, “এরপর আমি সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার, যার নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডটা ঘটে, উনার সঙ্গে দেখা করি। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করি, এতবড় ঘটনা কীভাবে ঘটলো। নিহতদের গণকবর দেওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন—‘আমরা করিনি, স্থানীয়রা করেছে।’ আমাকে উপেন্দ্র লাল চাকমা জানান ৩০০ জন মারা গেছে। অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত রিপোর্টে লেখা হয় ১০০ থেকে ২০০-এর মতো মানুষ। নিউ নেশনে আমার রিপোর্ট ও বিবিসিতে সংবাদ প্রচারের পর সংসদ থেকে একটা দল পরিদর্শনে যায় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংয়ে। তাদের ফাইন্ডিংস ছিল নিহত মোটমাট ১০০। নিউ নেশনের প্রথম পাতায় আমার রিপোর্টটা যখন ছাপা হলো তখন সেনাবাহিনীর একজন অফিসার আমাকে খুঁজতে শুরু করল। আমাকে বলল যে আপনার রিপোর্টের মধ্যে অনেক ত্রুটি আছে।”
ওই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫ সাংবাদিকের রহস্যজনক মৃত্যুর কথা জানান সালিম সামাদ। বলেন, “তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ওই সময় গণমাধ্যমকে সেনাবাহিনী খুব সাপ্রেস করতো। আমার প্রতিবেদনে আমি দুষ্কৃতিকারী লিখতাম না, আমি লিখতাম ‘শান্তিবাহিনী’, যারা স্বায়ত্তশাসন চায়। এ বিষয়টি সেনাবাহিনীর একটা অংশ পছন্দ করত না। বিশেষ করে গোয়েন্দারা। ডিজিএফআই, এফআইইউ, ডিএমআই—তিন ধরনের ইন্টেলিজেন্স ওখানে কাজ করতো “
সেলিম সামাদ বলেন, “রাঙ্গামাটিতে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আমাকে ওরা কিডন্যাপ করে। পট্টি দিয়ে চোখ বাঁধা হয়। তখনকার ‘খান বাড়ি’তে আমাকে নেওয়া হয়েছিলো। ৫ দিন ওরা আমাকে বন্দি করে রাখে। খাওয়া-দাওয়া দূরে থাক, পানি পর্যন্ত দেয়নি। রুমটার ভেতর কোনো টয়লেটও ছিল না। ডিজিএফআই ও এফআইইউ—এ দুটি ইউনিট সক্রিয়ভাবে আমার অপহরণের পেছনে জড়িত ছিল।”
“আমাকে কিডন্যাপের পর মুহূর্তের মধ্যে চেয়ারম্যান ফোন করে ইত্তেফাকের সাংবাদিক মুকসুদ– তখনকার প্রেসক্লাব প্রেসিডেন্টকে ফোন করে জানান। ৫দিন পর চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় একটা জিপে করে কাপ্তাই-চিটাগাং রোডে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। এরপর হাতের বাঁধন খুলে, চোখে থাকা ডিজিএফআইয়ের ফরম্যাল পট্টির ওপর গামছা দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা-আটটার দিকে অন্ধকার একটা জায়গায় ফেলে দিয়ে যায়’’—যোগ করেন সালিম।
‘খান বাড়ি’ নামে গোপন বন্দিশালার বিশাল পুরানো ভবনটি সিক্রেট প্রিজন হিসেবে ডিজিএফআই ব্যবহার করতো বলে জানান সালিম সামাদ। বলেন, “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অনেকেই খান বাড়িতে ছিল। ওদের ব্যাপকভাবে টর্চার করা হতো। ৫ আগস্টের পর অনেকেই মুক্তি পেয়েছে। তাদের মধ্যে ইউপিডিএফের কয়েকজন কর্মী ছিল। ’’
কাউখালীতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলের তিন সদস্য শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন ও উপেন্দ্র লাল চাকমা। ফিরে এসে ২১ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছিলেন, “কাউখালীর ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পোয়াপারা বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনার জন্য উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ও গ্রামবাসীকে বাজারে একটি সভায় আসতে বলেন। এরপর হঠাৎ করেই সেনাসদস্যরা বাজারে আসে এবং উপস্থিত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে গুলি করা শুরু করে।”
কাউখালীর কলমপতি ইস্যুতে ১৯৮৬ সালে “বাংলাদেশ: আন ল্য ফুল কিলিংস অ্যান্ড টর্চার ইন দ্য চিটাগং হিল ট্র্যাক” শিরোনামে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনায় সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ফোর্স ও আর্মড পুলিশ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে তা তদন্ত ও প্রতিরোধে তৎকালীন সরকার ব্যর্থ বলে মন্তব্য করা হয়।
শান্তিচুক্তি ও অধরা শান্তি
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। যার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি ঘটে। আদিবাসী অধিকারকর্মীরা বলছেন, শান্তিচুক্তির ২৭ বছর হলেও চুক্তির মৌলিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে এখনও শান্তি আসেনি। তারা বলছেন, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ২৫টি। আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে ১৮টি। বাকি ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত। তবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ৭২টির মধ্যে ৬৫টি ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং নেত্র নিউজকে বলেন- “আদিবাসীদের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার, তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করবে। সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করবে। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মন্ত্রিসভায় (উপদেষ্টার সভা) আদিবাসীদের স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন মধুপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অজয় চিসিম আশা করেন– “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমের আজকে যে নতুন বাংলাদেশ হয়েছে, আমি চাই সেখানে বাঙালি-আদিবাসী কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।”●