জাতীয় পার্টি কি ভারতের ক্রীড়নক?
আমি জাতীয় পার্টির একজন কার্ডধারী সদস্য ছিলাম এবং আত্মীয়তার বদৌলতে পেয়েছিলাম নেতৃস্থানীয় পদ। এই লেখাটি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, যেখানে দলটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

শৈশব থেকেই রাজনীতির প্রতি আমার গভীর আগ্রহ ছিল। তরুণ বয়সে যখন আমি একজন আইনজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করলাম, তখন রাজনীতির বিশ্লেষণকে বাস্তবে প্রয়োগ করার ইচ্ছে জাগলো। জাতীয় পার্টি বেছে নেওয়ার পেছনে কারণ ছিল এইচ. এম. এরশাদ এবং জি. এম. কাদের ছিলেন আমার বাবার মামা। আমার বাবা ছিলেন একজন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা এবং ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তিনি মারা যান। তিনি কখনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। আমি ভাবলাম, যদি রাজনীতিতে অবদান রাখতে হয়, তবে এই দলটিই হবে আমার জন্য স্বাভাবিক পছন্দ। শুধু যে আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি একটি পরিচিত পরিবেশ তৈরি করবে তা-ই নয়, আমার মনে হয়েছিলো দলটিকে ঢেলে সাজানোরও সুযোগ আছে।
২০১৯ সালে আমি প্রথম জি.এম কাদেরকে (যাকে আমি “দাদু” বলে সম্বোধন করি) আমার আগ্রহের কথা জানাই। আমার পেশাগত জীবনের কথা জেনে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী আমার জন্য উপযুক্ত হবে এবং বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের খালি পদে আবেদন করার পরামর্শ দেন। আমি আবেদন জমা দিলে তিনি প্রাথমিক অনুমোদন দেন এবং পরে এরশাদ— যিনি তখন দলের চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা— দলের সংবিধানের বিতর্কিত ধারা ২০(১)(১)(ক) ব্যবহার করে আমাকে নিয়োগ দেন। ধারাটিতে বলা আছে, চেয়ারম্যান ইচ্ছেমতো যে কোনো পদ সৃষ্টি বা বিলুপ্ত করতে পারেন, কাউকে নিয়োগ বা অপসারণ করতে পারেন এবং তিনি যোগ্য মনে করলে পদে যেকোনো পরিবর্তন আনতে পারেন। আমি আদর্শবাদী স্বপ্ন নিয়ে দলে যোগ দিই— দলকে সঠিক পথে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে এরশাদের মৃত্যুর পর ডিসেম্বর মাসে দলীয় কাউন্সিল হয়। এর ঠিক পরেই বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হয়। কাদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, আর আমার আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদও স্থায়ী হয়। সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর ২০২১ সালে আমি পূর্ণাঙ্গভাবে দলীয় কাজে নামি। আমার মূল দায়িত্ব ছিল দুইটি— বিদেশে জাতীয় পার্টির কমিটিগুলোর পুনর্গঠন এবং ঢাকার কূটনৈতিক মিশনের সঙ্গে দলের প্রতিনিধি হিসেবে যোগাযোগ রাখা।
বাংলাদেশের আইনে রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা থাকার অনুমতি নেই। কিন্তু সব বড় দলই বহুদিন ধরে মূলত প্রবাসী এবং অভিবাসীদের অনুদান পেয়ে আসছে। এসব অনুদানের লোভে আইন অমান্য করে দলগুলো “কমিটি” গঠন করে আসছিল। এরশাদের ঘনিষ্ঠ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা অনুদানের বিনিময়ে বিদেশে কমিটি অনুমোদন দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব অনুদান দলের অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি এবং এইসব কমিটির কথা কাদের জানতেনও না। ফলে কাদেরের একজন বিশ্বস্ত লোকের দরকার ছিল। এসব সমস্যার সমাধানে আমি নিশ্চিত করেছি, যেন কাদেরের সম্মতিতেই সবাই নিয়োগ পান। দলের নথির জন্য তার স্বাক্ষরও নিয়েছি, এবং যথাযথ কাগজপত্র সংরক্ষণ করেছি। এমনকি অফিসে বাড়তি একটি ফাইল রাখা হয়েছিল, যেখানে ওইসব কমিটি থেকে দলের পক্ষে দেওয়া রসিদ ও অর্থপ্রদানের প্রমাণ সযত্নে নথিবদ্ধ করা ছিল।
আমি জানতাম যে, আত্মীয়তার কারণে আমি এই পদ পেয়েছি এবং কাউন্সিলের লোক দেখানো অনুমোদনও ছিল। চেয়ারম্যানের আত্মীয় হওয়ায় আমার সঙ্গে তার সবসময় সরাসরি যোগাযোগ ছিল, যা অন্যদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তাই আমি মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে থাকি, যাতে কেউ মনে না করে আমি অযোগ্য।
২০২২ সালের মে মাসে আমি ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনারের বাসভবনে এক নৈশভোজে যোগ দিই। নিমন্ত্রণটি ছিল প্রধানত শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও সুশীল সমাজের সদস্যদের জন্য। আমি একদিকে শিক্ষাবিদ, অন্যদিকে দলীয় নেতা হিসেবে কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আমার দায়িত্ব ছিল। সেদিনের একটি ছবি, যেখানে আমি নিমন্ত্রণকারীর সঙ্গে ছিলাম— ভারতীয় রাষ্ট্রের জন্য সেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় হাইকমিশনের একজন প্রতিনিধি সরাসরি দলের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানান।
আমি তখন দলের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ নেতাদের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রচারের জন্য পরিচিত হচ্ছিলাম। হঠাৎ কাদের আমাকে জানালেন যে, ভারতীয় হাইকমিশনের রাজনৈতিক সচিব অনিমেষ (আইএফএস ২০১১ ব্যাচ) আমার পাকিস্তান হাইকমিশনারের সঙ্গে তোলা ছবিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ভারতীয় কূটনীতিকের পাকিস্তান-বিরাগ স্বাভাবিক, কিন্তু একটি বিদেশি কূটনীতিক কেন জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদককে নিয়ে দলের চেয়ারম্যানকে মন্তব্য করবেন? আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেন সেই মন্তব্য কাদের বা কোনো বাংলাদেশি দলের প্রধানের কাছে গুরুত্ব পাবে?
অনেকদিন ধরেই গুঞ্জন ছিল যে, ভারত জাতীয় পার্টি ও দলটির চেয়ারম্যানের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষ করে যখন দলটি স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের সর্ববৃহৎ জোটসঙ্গী বা সংসদের বিরোধীদল ছিল। কাদের কখনো ভারত সফরে তার সঙ্গে ভারতীয় প্রতিনিধিদের বৈঠকের বিবরণ আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করেননি। তবুও আমি অবাক হলাম যে, অনিমেষের হস্তক্ষেপে কাদেরের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অনিমেষ তাকে একটি বার্তা পাঠান, যা কাদের আমাকে ফরোয়ার্ড করেন— “স্যার, ব্যাপারটি আমাদের দেশে গুরুতরভাবে নোট করা হয়েছে। বাকিটা আপনার সিদ্ধান্ত। শুভেচ্ছা।”
কাদের আমাকে জানান, তাকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আমাকে সরাতে হবে।
আমাকে শুধু আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ থেকেই নয়, দলের আইটি সিস্টেম ও ওয়েবসাইট থেকেও মুছে ফেলা হয়। আমার সাধারণ সদস্যপদও বাতিল হয়। কাদের আমাকে বলেন কিছুদিন কূটনীতিকদের থেকে দূরে থাকতে, পরে আবার ফেরাবেন। কিন্তু আমার বরখাস্তের আনুষ্ঠানিক চিঠি কখনো আমি দেখিনি। যদিও অনিমেষ তা দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ভারতীয় কূটনীতিক বরখাস্তের কাগজ দেখেছেন, কিন্তু আমি বা বাংলাদেশি জনগণ কেউই তা দেখিনি।
২০২৩ সালের মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ আমি লজ্জা ও অনর্থক কাজে নিজের সময় নষ্ট করছি, এই হতাশায় দল থেকে দূরে সরে আসি। তখন আমাকে বরখাস্তের দশ মাস পরে কাদের আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ফোন করে জানান যে ভারতীয় হাইকমিশনের আপত্তি আছে। দলের সঙ্গে ভারতের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো কাদেরের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে ছিল, আমি কোনোটি দেখিনি বা জানতামও না। হয়তো তা জানলেই বুঝতাম, কেন কাদের দিল্লির প্রতি এত অনুগত। শেষ পর্যন্ত, এই অবিচল,অদৃশ্য, অদম্য ভারত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের শক্তির কাছে হেরে আমি ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় পার্টি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা দিই। বিজ্ঞপ্তিটি দি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়। এরপর আমি আর জাতীয় পার্টিতে ফিরে যাইনি, যাওয়ার ইচ্ছেও নেই।
এই দায় স্বীকার আমার পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশের চেষ্টা। আমার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনে আমি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু অন্যায়ভাবে বরখাস্ত হয়েছি, যা আমি এখন জনসম্মুখে প্রকাশ করছি। এই অন্যায় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানে। যদিও আমি কয়েকজনের দিকে আঙুল তুলতে পারি, যারা আমার অপসারণে ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল কাদেরের। তিনি নিখুঁতভাবে এক দালালের ভূমিকা পালন করেছেন। আমার বরখাস্তের সময় আমি বুঝেছি, এই দল কখনোই নিজের পরিচয় বহন করেনি। এটি আওয়ামী লীগ ও দিল্লির স্বার্থ বাস্তবায়নের হাতিয়ার ছিল। আমি আশা করি, একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় রাজনৈতিক দল ও এর চেয়ারম্যানের অভ্যন্তরীণ কর্মপরিচালনার এই তথ্য প্রকাশ হলে তা জনগণের কাজে আসবে। এই ব্যাপারটি জানার পর কাদের ও জাতীয় পার্টিকে বাংলাদেশের জনগণ কিভাবে দেখবে, তা পুরোপুরি তাদের ওপর নির্ভর করছে।●
সাকিব রহমান একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রগ্রেস ম্যাগাজিন-এর সম্পাদক এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার।