৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে অনিয়ম-বর্জন
অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের অভিযোগে একাধিক প্যানেলের বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত জাকসু নির্বাচন। নেত্র নিউজের প্রতিবেদকের ভাষ্যে উঠে এসেছে নির্বাচনের হাল-হকিকত।
তিন দশকেরও বেশি সময় পর রাজধানী ঢাকার অদূরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। নির্বাচনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এই নির্বাচনকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, যার রেশ ছিল নির্বাচনের দিনেও।
নির্বাচনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল ১১ সেপ্টেম্বর সকাল নয়টায়। তবে সকাল আটটা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে দেখা যায় শত শত পুলিশ, এপিবিএন ও আনসার সদস্যদের উপস্থিতি। কেবল নিরাপত্তা পাস ও পরিচয়পত্রধারীরাই প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার পেরিয়ে শহীদ রফিক-জব্বার হলে ঢুকতে দেখা গেল হলে স্থাপিত ১২টি বুথে ভোটার শূন্য। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় পর, ৯টা ৩২ মিনিটে হলে প্রথম ভোট দেন একজন শিক্ষার্থী।
তবে পাশেই শহীদ তাজউদ্দীন হলে ছিল ভিন্ন চিত্র। সেখানে সকাল থেকেই ছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি। পাশেই চলছিল প্রার্থীদের কুশল বিনিময়। তবে কেন্দ্রে লিফলেট, স্লিপ নিয়ে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের জোরাজুরি দেখা যায়নি। ১০টা ৫০ মিনিটে বেগম খালেদা জিয়া হলে গিয়েও দেখা যায় একই দৃশ্য। পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা আর নিরাপত্তা দেখে ছাত্রীরা উচ্ছসিত ছিলেন। তারা জানান, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পেরে আনন্দিত।
১১টার দিকে আকাশ ভেঙে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। তবে হলের অভ্যন্তরে ভোটকেন্দ্র হওয়ায় ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তেমন সমস্যা হয়নি।
নারী শিক্ষার্থীদের হলগুলো ছিল কিছুটা নীরব। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত হলগুলোর হল সংসদের ১৫০টি পদের অধিকাংশ পদেই প্রার্থীর অভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন প্রার্থীরা। কারণ হিসেবে ছাত্রীরা জানান ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের সামনের সারির নারীদের যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে তাতে নারী শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে আসতে অনুৎসাহিত বোধ করেছেন। এছাড়া যাদের ছাত্রলীগের সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল তারাও পুনরায় রাজনীতিতে আসতে সাহস পাননি।
বৃষ্টি একটু কমলে দুপুর ১২টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ নম্বর ছাত্রী হলে ভোট বন্ধ রাখাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় হট্টগোল। হলটির প্রভোস্ট যদিও দাবি করেন যে অমোচনীয় কালির অভাবে ভোট বন্ধ রাখা হয়েছিল, কারচুপির অভিযোগ তুলে বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত একজন শিক্ষক এবং ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী, একাধিক সাংবাদিকসহ হলটির কেন্দ্র পরিদর্শনে ঢুকে পড়েন। এসময় সতর্কতার জন্য ঘণ্টা বাজানো হয় এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে পুরুষদের কেন্দ্র থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়, যার জেরে প্রায় এক ঘণ্টা ভোট স্থগিত থাকে।
শিক্ষার্থীদের পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু আবাসিক হলের কেন্দ্রে সমস্যা দেখা দেয়। যদিও অধিকাংশ হলে ছবি ও পরিচয় যাচাই করা হচ্ছিল ওয়েবসাইট থেকে বা ছবিযুক্ত তালিকা থেকে, অন্তত একটি হলে তালিকার সাথে ছবি না থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়।
অধিকাংশ হলেই ছাত্রদল, শিবির ও বাগছাস-সমর্থিত প্যানেলের এবং কিছু হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেলের পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি ছিলো। ভোটের আগের রাতে ঘোষণা দেওয়ায় অনেক প্রার্থী পোলিং এজেন্ট দিতে পারেননি এবং এজেন্টদের কোনো পরিচিতি পত্র দেওয়া হয়নি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি এবং জাহানারা ইমাম হলে ভোটার তালিকার সঙ্গে ছবি ও পরিচয় মিলিয়ে ব্যালট পেপার দিচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ
বিকেল ৪টার দিকে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। তারা দাবি করে যে বেশ কিছু কেন্দ্রে ব্যালট পেপার মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে, অমোচনীয় কালি উঠে যাচ্ছিল, কেন্দ্রে প্রার্থীদের ঢুকতে বাঁধা দেয়া হচ্ছিল, এবং ভোটার তালিকায় ছবি ছিল না।
ছাত্রদলের ঘোষনার পর নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন শিক্ষক — অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ও অধ্যাপক নাহরিন আই খান — দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। তারা বিএনপি সমর্থক হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন কেন্দ্রে অমোচনীয় কালি ব্যবহার না করা কিংবা নিম্নমানের কালি ব্যবহার করা, অনেক শিক্ষার্থীর নাম ভোটারদের তালিকায় না থাকাসহ বেশ কিছু অভিযোগ তোলের তারা।
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা নামতেই একই ধরণের অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন ও পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানায় সম্প্রীতির ঐক্য, সংশপ্তক পর্ষদ, স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্যানেল। বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
ছাত্রশিবির সমর্থিত জোট অবশ্য নির্বাচনে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুললেও নির্বাচন বর্জন থেকে বিরত থাকেন। বরং তারা কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করার অভিযোগ তোলেন ছাত্রদলের বিরুদ্ধে।
নির্বাচনে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ সত্ত্বেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে দেখা গেছে।●