মাফিয়াতন্ত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক স্বপ্নভূমি
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের ১১তারিখ। ঢাকার দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে সিটি ক্লাব মাঠে মুখোমুখি হয়েছিল লালমাটিয়া ক্লাব ও এক্সিওম ক্রিকেটার্স। অন্য শত শত ম্যাচের মতোই দর্শকবিহীন, প্রায় সকলের অগোচরে নিয়মরক্ষার এক ম্যাচ ছিল সেটি। ঢাকার ক্রিকেট কালচারের ওপেন সিক্রেট মেনে ম্যাচের ফলাফল আগে থেকেই প্রস্তুত। অদৃষ্টের মতো এই ফলাফল অনেক উপর থেকে ঠিক করা। যারা ক্রিকেটের কলকাঠি নাড়ান, সেই ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতার সমীকরণ মেলাতে, নিজেদের স্বার্থের ব্যালেন্সশিট আরো সমৃদ্ধ করতে অংকের মতো ছক কষে রাখেন। বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো হতভাগা ক্রিকেটাররা স্রেফ দাবার বোর্ডের মতো সাজানো চালে নড়াচড়া করেন।
কিন্তু ইতিহাসের স্পার্টাকাসের মতো সেদিন এক তরুণ অসম্ভব ক্রোধে জ্বলে উঠেছিলেন। এক অকিঞ্চিতকর যুবক ইতিহাসের ফুটনোট থেকে ফুঁড়ে এসে দেবালয়ে আগুন জ্বালানোর কাজটা করেছিলেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজখবর যারা রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন সুজন মাহমুদ নামের এক ক্রিকেটার সেদিন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ইচ্ছাকৃত ওয়াইড আর নো বলের পসরা সাজিয়ে ৪ বলে ৯২ রান দিয়েছিলেন। সবার অগোচরে থাকা একটা ম্যাচকে কেবল বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বের সামনে বিস্ময় হিসেবে হাজির করেছিলেন। ম্যাচ পাতানো, রাজনীতি, ক্ষমতাশালীদের স্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া ক্রিকেটকে ক্রমাগত জবাই হওয়া দেখতে দেখতে সেদিন মুহূর্তের জন্য রাগ, ক্ষোভ আর অভিমানের আগ্নেয়গিরি যেন ফুঁসে উঠেছিল সুজন মাহমুদের মধ্যে।
মানুষের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ের মতোই, ক্ষমতাশালীদের প্রবল শাস্তির মুখে পড়েন সুজন। নিষিদ্ধ হন ১০ বছরের জন্য। শেষ হয়ে যায় তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার। কিন্তু, সুজনের সেই আগুনে অন্ধকারাচ্ছন্ন ক্রিকেটের ভয়ংকর ছবি কিছুটা হলেও উন্মোচিত হয়েছিল।
প্রবল ফ্যাসিবাদের সময়ে সব কিছু ধংসের কবলে যাওয়ার মত ক্রিকেট খেলাটাও ক্ষয়ে গেছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অলিগার্কির প্রবল কামড়ে। সুজনের উপক্রমনিকা দিয়ে আমরা সেই গল্পের কিছুটা খুঁজতে চেষ্টা করেছি। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটকে কীভাবে তিলে তিলে ধংস করে দেওয়া হয়েছে, সেই চিত্র উঠে এসেছে কয়েকজন প্রতিবাদী খেলোয়াড়, আম্পায়ার ও সংগঠকের সঙ্গে আলাপাচারিতায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ক্রিকেট সিরিজকে বলা হয় এশেজ বা ছাইভস্ম। আর আমাদের আজকের গল্প স্বৈরতন্ত্রের আগুনে পুড়ে যাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের ছাইভস্ম নিয়ে।
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেলেও এই দেশের এক নম্বর খেলা হয়ে ওঠা ক্রিকেট কেন ঢাকার বাইরে কোন কাঠামোই গড়ে তুলতে পারেনি তা একটা বড় প্রশ্ন। এ নিয়ে পরে কোনো এক দিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। সেখানে ওঠে আসবে কেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়ে বগুড়ার মতো টেস্ট ম্যাচ ভেন্যু প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিভাবে ঢাকার বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের সাফল্যর সিঁড়ি বাইতে হলে পদে পদে রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী ও কর্তাব্যক্তিদের মন যুগিয়ে চলতে হয়।
আজ ঢাকার ক্রিকেট– বিশেষত ৫০ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। কারণ বাংলাদেশই একমাত্র ক্রিকেট-সংস্কৃতি, যেখানে দেশের একটি বড় শহরের ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট নির্ধারণ করে দেয়— কোন দিকে যাবে দেশের ক্রিকেট। টুর্নামেন্টটা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। ১২টি ক্লাবের এই লিগ বাংলাদেশের একমাত্র লিস্ট ‘এ’ স্বীকৃত টুর্নামেন্ট।
যদিও, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল ক্রিকেটে এশীয় তথা উপমহাদেশের শক্তি। এর বাইরে অন্যতম ব্যাপার হচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে ক্রিকেট উন্মাদনা। তবে সে সময় ঢাকা লিগও ছিল জমজমাট। আশির দশকের শেষে আর পুরো নব্বই দশকজুড়ে উপমহাদেশের সেরা খেলোয়াড়রা প্রায়শই এই টুর্নামেন্টে অংশ নিতেন। ফুটবল তখন দেশের জনপ্রিয় খেলা হলেও ওয়াসিম আকরাম, অরবিন্দ ডি সিলভাদের সামনাসামনি দেখে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খানরাও প্রবল দর্শকপ্রিয় দেশি তারকা হয়ে ওঠেন। সে সময় আবাহনী-মোহামেডানের মতো বড় ম্যচে ৩০ হাজার দর্শক হতো, অন্য ম্যাচগুলো নিয়েও থাকতো উত্তেজনা। কোনো ক্লাব প্রিয় খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াবে, সেজন্য জমি বিক্রি করে দর্শকদের কেউ কেউ টাকা যোগাড় করে দিয়েছিলেন, এমনও নজির আছে। অথচ, বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরেই সবখানে শুরু হয় ভাটার টান। রাজনৈতিক বিবেচনায়, জাতীয় দলের উন্মাদনাকে জাতীয়তাবাদের সাথে মিশিয়ে ফায়দা নেওয়ার প্রভাব তো ছিলই, কিন্তু এর চেয়েও বেশি ছিল সোনার হাঁস হয়ে যাওয়া ক্রিকেটের লাভ চেটেপুটে খাওয়ার লক্ষে গড়ে ওঠা সংগঠকদের মাফিয়াতন্ত্র। জমি বেচে প্রিয় ক্লাবকে সহায়তা করা দূরস্থান, ক্লাব হয়ে উঠল ক্ষমতা আর অর্থের হাতিয়ার। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় বিগত আওয়ামী লীগ আমলে। পুরো দেশের মতো এইসময় ক্রিকেটও ক্ষমতাসীনদের কাছে হয়ে পড়ে কুক্ষিগত।
কুক্ষিগত করার প্রধান হাতিয়ার ছিল কাউন্সিলরশিপ। প্রিমিয়ার লিগের ১২টি দলের নিচে আছে আরো তিনটি বিভাগ– প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়। প্রমোশন, রেলিগেশন সিস্টেমের এই ৪ লিগের চূড়ায় অবশ্যই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। প্রিমিয়ার লিগের ১২টি ক্লাবসহ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে মোট ৭৬টি ক্লাব অংশ নেয়। প্রতিটি ক্লাবের একজন করে কাউন্সিলর থাকেন। এছাড়াও সারা দেশের বিভাগ, জেলা, বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক ক্রিকেটার, সাবেক অধিনায়ক ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাউন্সিলরশিপ আছেন।
২০২১ সালের তালিকা অনুযায়ী বিসিবির কাউন্সিলর সংখ্যা ১৭৪ জন। এর মধ্যে ৭৬ জনই ঢাকার ক্লাবের। তাদের ভোটই নির্ধারণ করে কে হবেন বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। আর পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হন বিসিবি সভাপতি। ২০২১ সালে বিসিবির সর্বশেষ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। এর আগে ২০১৭ ও ২০১৩ সালের নির্বাচনেও তিনিই ছিলেন অপরাজেয়। বলাই বাহুল্য, আওয়ামী লীগের এই নেতা, দেশের সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি জিল্লুর রহমান ও একুশে আগস্টের বোমা হামলায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়া আওয়ামী লীগনেত্রী আইভি রহমানের ছেলে। তিনি ওই নির্বাচনগুলোতে জিতেছিলেন দেশের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনগুলোর মতো একই কায়দায়।
কাউন্সিলরশিপ নিশ্চিত করতে ক্লাবগুলো দখল করতে শুরু করেন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। এক সময়ের স্থানীয় সংগঠকদের হটিয়ে, ক্লাবের সাথে স্থানীয় কমিউনিটির যোগসূত্র ছিন্ন করে স্রেফ ক্ষমতা বাড়ানোর কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয় ক্লাবগুলোকে। এর মধ্য দিয়ে বেশিরভাগ ক্লাব পরিণত হয় জুয়া খেলার ক্যাসিনোতে। দুনিয়ার নানা দেশে দেখা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলে একেকটা ক্লাব নিজেদের কমিউনিটির প্রতীক হয়ে ওঠে। লিভারপুল শহরের একাংশ সমর্থন করে লিভারপুল, আরেক অংশ এভারটন। স্পেনের মাদ্রিদ শহরে রিয়াল মাদ্রিদ, এথলেটিকো মাদ্রিদ, রায়ো ভায়োকানো। আমাদেরও এমনটা ছিল এক সময়। গোপীবাগের বাসিন্দা হিসেবে দেখেছি ছোটবেলায় আমাদের মহল্লার ক্লাব ‘বাংলাদেশ বয়েজ’র প্রতি এলাকার মানুষের আবেগ। যদিও গোপীবাগেরই আরেকটা বড় ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছিল। বাংলাদেশ বয়েজের খেলায় আমাদের মা-খালারা পর্যন্ত উৎসাহ দিতে স্টেডিয়ামে যেতেন। পাড়ায় ধনীর ছেলে হোক, বাড়িতে কাজ করা বা রিকশা টানা কিশোর হোক, সকলেই স্বপ্ন দেখতেন এই ক্লাবে খেলবেন। একই ঘটনা আরামবাগ আর মোহামেডান কিংবা ধানমন্ডি ক্লাব ও আবাহনীকে নিয়েও ঘটতো। ক্লাবগুলো থেকে স্থানীয় জনগণকে বিযুক্ত করে সেই সংস্কৃতি ধংস করা হয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে। জনগণের মধ্যে কমিউনিটি বোধ না থাকলে অবশ্য স্বৈরাচারদের খুব লাভ হয়। আর ক্লাবকে নিজেদের হাতিয়ার বানানোর ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বরাবরই বেশি।
এই কারণে, একেবারেই আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল লিগ। প্রতি বছর অক্টোবরে শুরু হয় ক্লাব ক্রিকেটের মৌসুম। চলে এপ্রিল-মে মাসের প্রচণ্ড গরম পর্যন্ত। ক্লাব ও সংশ্লিষ্টদের জন্য এখনো বছরের এই সময়টা মহাগুরুত্বপূর্ণ। নিজের ক্লাবটাকে তৃতীয় বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে নেওয়া, এরপর প্রথম বিভাগ থেকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ পর্যন্ত নেওয়ার লক্ষ্য থাকে সবার।
সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রিকেটাররা এ সময়টা ঢাকার ক্লাবের টেন্টে এসে উঠেন। যেখানে একই রুমে ৩-৪ জন ক্রিকেটারকে জড়োসড়ো করে থাকতে হয়। তাদের রাত কাটে কাঠের নড়বড়ে বিছানায়। অনেককে ঘুমাতে হয় নিজেদের কিট ব্যাগের ওপর। ঢাকা শহরে চলার মতো হাতখরচও তাদের থাকে না। লিগ শেষ হলে কিছু টাকা পাবে, এ আশায় বুক বেঁধে সময়টা কাটে তাদের। মফস্বল থেকে আসা এসব ছেলেরা সব কষ্ট সয়ে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে মন দেয়, তাদের স্বপ্ন থাকে একটাই— ক্লাব ক্রিকেটের সিঁড়ি বেয়ে যদি ওপরে ওঠা যায়! ওপরে মানে জাতীয় দলে।
এই ব্যাপারটা অবশ্য এক ধরনের ফাঁদই বলা চলে। লাখে একজনের লটারি পাওয়ার মতো কেউ কেউ সর্বোচ্চ স্তরে যেতে পারে, বাকিরা ঝরে যায়। তবে, পুঁজিবাদের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই, সেই গুটিকয়েকের উদাহরণকে আলোকিত করেই এই ফাঁদের ঔজ্জ্বল্য অব্যহত থাকে। ক্যাসিনোতে যেমন জুয়া খেলে গুটিকয়েক মানুষ লাভের মুখ দেখে আর বেশিরভাগ স্বর্বস্বান্ত হয়, এমনটা ক্লাব ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ঘটে না। যা কিছুই হোক লাভের টাকা নিশ্চিতভাবে পকেটে যায় আয়োজকদের। বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাঠামোটাই এ রকম।
ভোটের স্বার্থে অর্থ, পেশিশক্তি, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং আর পাতানো ম্যাচে তথাকথিত ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট ধীরে ধীরে হয়ে পড়েছে চূড়ান্ত অভদ্র, অভব্য। ক্লাব ক্রিকেটের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়া এই রোগে আক্রান্ত ক্লাব কর্মকর্তা, আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি, স্কোরার, এমনকি খেলোয়াড়েরাও। বিবেক, মর্যাদাবোধ বিলিয়ে দিয়ে দিনের আলোয় হুমকি-ধমকি, গালাগাল, টাকার গরম দেখিয়ে এক দল আরেক দলকে হারাচ্ছে, হেরে যাচ্ছে। ২০১৬-১৭ মৌসুমের দিকে এসব অনিয়মই হয়ে উঠেছিল নিয়ম। বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে ক্লাব ক্রিকেটের ‘ওপেন সিক্রেট’ চিত্রটা সবার সামনে আসে।
২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে দুর্নীতির কালো থাবার পেছনে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকদের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরা হয়। সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘প্রিমিয়ার লিগ এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট মিলিয়ে ৭৬টি ক্লাবের প্রায় ৬০টি ক্লাবই আছে একই ছাতার নিচে। ক্লাবের কমিটিতে যারাই থাকুক না কেন, এসব ক্লাব চলে বিসিবির ১৩-১৪ জন পরিচালকের যৌথ অর্থায়নে। বিসিবির বিভিন্ন সাব-কমিটির লোকজনও আছেন সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোর সঙ্গে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক স্বীকার করেন, ‘যা-ই হচ্ছে, এই ১৩-১৪ জন পরিচালকের সম্মতি ও সমর্থন ছাড়া হচ্ছে না।’
একেকজন পরিচালক ১০-১২টি ক্লাবের সঙ্গে আর্থিকভাবে জড়িত থাকার কারণ একটাই— লিগে সেই পরিচালকদের ক্লাবের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ক্রিকেট বোর্ডে তাদের আসন ধরে রাখার বিষয়টি। বোর্ড পরিচালকের পদ ‘অনারারি পোস্ট’ হলেও ক্রিকেট বোর্ডে থাকতে পারাটা সমাজে অন্যরকম অবস্থান অর্জন করা, যা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা-চর্চার জন্য সুবিধাজনক। মুখে ক্রিকেটের সেবক হলেও তারাই ক্রিকেটের ভক্ষক। তাদের কাছে মাঠের খেলার চেয়ে বড় ভোটের স্বার্থ।
বিশেষ ক্লাবকে অন্যায় সুবিধা দিয়ে বহু আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি এমনকি মাঠের কিউরেটররাও সুবিধাভোগী হয়েছেন। আর তাদের সাহায্যে অন্যায়ভাবে ম্যাচ জিতে ‘সরকারি ক্লাবগুলো’ ধরে রেখেছে ঢাকা লিগের শীর্ষ অবস্থান, যা পরবর্তীতে বিসিবির নির্বাচনে পরিচালকদের জয়ী হতে সাহায্য করেছে। এসব দেখে বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। ‘সরকারি ক্লাবের’ বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন থেকেই হারের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে আসতেন তারা। হারতেই যেহেতু হবে, দলগুলো তাদের সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়াই একাদশ সাজাতো। অনেক ক্রিকেটার নিজ থেকেই সরে দাঁড়াতেন।
পয়েন্টের হিসাব মেলাতে অনেক সময় খেলা ছাড়তেও বাধ্য করা হতো। ভোর বেলা বড় কর্তার ফোনে কিউরেটরের উইকেটের কাভার ফুটো করে রাখার ঘটনাও ঘটে ঢাকা লিগে। বৃষ্টিতে উইকেট ভিজে গেছে— এই অজুহাতে কতো ম্যাচই যে পণ্ড হয়েছে সেই হিসাব নেই। কখনো উইকেট ভিজিয়ে, কখনো বোলারের রান আপের জায়গা ‘আনফিট’ রেখে সময় নষ্ট করে ম্যাচের গতিপথ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
একজন কিউরেটরকে জিজ্ঞেস করায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই লেখককে বলেন, “এমন ঘটনা কতবার হয়েছে ভুলেই গিয়েছি। প্রথম প্রথম আমি এসব করতে রাজি হতাম না। পরে আমাকে এক ভেন্যু থেকে অন্য ভেন্যুতে ট্রান্সফার করা হয়। চাকরির হুমকি তো দিতোই। একটা সময় পর আপনি ওই নোংরা সিস্টেমের অংশ হতে বাধ্য হবেন। কারণ দিন শেষে এটা আপনার পেশা। আপনি কাজ করেন বেতনের জন্য, পরিবারের জন্য।”
এ কিউরেটরের মতো ক্রিকেট কাঠামোর নিম্নতর অবস্থান ও বেতনে থাকা এক আম্পায়ারও প্রায় একই কথা বলেন, “আম্পায়াররাও তো চাকরি করেন। তাদেরও তো ঘর চালাতে হবে। সে জন্য ম্যাচ পেতে হবে। ম্যাচ পেতে হলে তাদের কথামতো কাজ করতে হবে। আগের বোর্ডের অধীনে অনেকেই সেটা করেছেন। নিজের জন্যই নিজেদের বিক্রি হতে হয়েছে।”
আরেক আম্পায়ার তো সরাসরিই বলেছেন, “আপনি কি মনে করেন, কেউ খেলোয়াড়, ক্লাব অফিসিয়াল বা আপনাদের কাছে অসম্মানিত হতে চান? আপনি যেসব প্রশ্ন করছেন এসব প্রশ্নের মুখোমুখি তো কেউই হতে চান না। কিন্তু হতে হয়।”
সুজন মাহমুদের আলাপটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। লালমাটিয়া ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সুজন এই কাণ্ড করেছেন। একই বছর ইন্দিরা রোড ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষে ফিয়ার ফাইটার্স নামের এক ক্লাবের বোলার তাসনিম আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে ১ ওভার ১ বলে ওয়াইড আর নো বল করে ৬৯ রান দেন। অবিশ্বাস্য এই কীর্তির পর এক তদন্ত কমিটি গঠন করে বিসিবি। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দুই ক্লাব এবং অভিযুক্ত দুই বোলার, কোচ, অধিনায়ক এবং দুই আম্পায়ারের বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণা করা হয়। বোলার সুজন মাহমুদ এবং তাসনিমকে ক্রিকেট থেকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। লালমাটিয়া ক্লাব এবং ফিয়ার ফাইটার্সকে করা হয় আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ। ওই দুই ক্লাবের ম্যানেজার, কোচ এবং অধিনায়ক নিষিদ্ধ হন পাঁচ বছরের জন্য।
কিন্তু যে আম্পায়ারদের নিয়ে এত অভিযোগ, সেই বিতর্কিত দুই ম্যাচের আম্পায়াররা নিষিদ্ধ হয়েছেন মাত্র ৬ মাসের জন্য।
শাস্তির একটা অদ্ভুত ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও সাবেক বোর্ড পরিচালক শেখ সোহেল। বলেছিলেন, “আমরা প্রতিটি খেলোয়াড় এবং মাঠে উপস্থিত ছিলেন এমন অনেকের সাথে কথা বলেছি। কথা বলে দেখেছি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে হেয় প্রতিপন্ন করতেই এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দিত হয়েছে।”
“আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারেন যে, যদি টিম ম্যানেজমেন্ট আদেশ না দেয়, তাহলে কোনো বোলার এ জাতীয় কাজ করার সাহস পায় না। দুই ম্যাচেই ফিক্সিংয়ের কোনো ব্যাপার ছিল না। বোলার টাকা পেয়েছেন বা এ ধরনের কিছু নয়। কিংবা এই দুই দল হেরে গেলে রেলিগেশনে যাবে বা জিতলে সেমি-ফাইনালে উঠবে, এ ধরনেরও কিছু ছিল না। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভাবমুর্তি নষ্ট করতেই এই কাজ করা হয়েছে”—ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন শেখ সোহেল।
যারা দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে ওয়াকবিহাল, তারা এই ধরনের ব্যাখ্যায় মোটেই বিস্মিত হননি। কারণ, গোটা আওয়ামী লীগ আমলে সর্বত্রই চলেছে এই আত্মঘাতী রীতি। যারা দেশকে লুটেপুটে শেষ করেছে তাদের বিরুদ্ধে বলতে গেলেই দেশবিরোধী, চেতনাবিরোধী, ষড়যন্ত্রকারীর তকমা জুটেছে। যে ক্রিকেট বোর্ডে এফডিআর বাবদ ৯০০ কোটি টাকা জমা আছে বলা হয়, সেখানে লুটপাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে একই রকম ব্যাপার ঘটবে, সেটাই স্বাভাবিক।
অবশ্য ‘দোষী’ ক্লাব দু’টির পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়েছিল, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদেই তারা অমন করেছে। এমনকি বোলার বল করার আগেই আম্পায়ার নো বলের সঙ্কেত দিয়েছিলেন, এমন দাবিও করেছে ফিয়ার ফাইটার্সের ক্রিকেটাররা। ক্লাবগুলোর অভিযোগের আঙুল ছিল যাদের দিকে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্য দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মতো গুরুতর অপরাধ খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি। খেলা ঠিকমতো পরিচালনা করতে না পারায় মাত্র ৬ মাস নিষিদ্ধ হন দুই আম্পায়ার।
সুজন মাহমুদের মতো ‘অসহায়’ খেলোয়াড়, অল্প বেতনের কিউরেটর বা আম্পয়ারই শুধু নন, ঠিকঠাক সঙ্গত দিতে না পারলে ক্লাব পর্যায়ের বড় কর্মকর্তা এবং ক্লাবগুলোকেও উৎখাত করেছেন বিসিবির মাফিয়ারা। আওয়ামী লীগ আমলের প্রথা মেনে, প্রতিবাদী কর্মকর্তা ও ক্লাবগুলোকে নিষেধাজ্ঞা, মামলার জালে ফেলার ঘটনাও আছে অনেক। ২০১৪ সালে বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও বিসিবি পরিচালকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সব ধরনের ক্রিকেটীয় কার্যক্রম থেকে আজীবনের জন্যে নিষিদ্ধ হন প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের মালিক লুৎফর রহমান বাদল। ক্লাবটির যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম টিটুকে ৫ বছরের জন্য এবং সাব্বির আহমেদ রুবেলকে ৩ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। পরে রুবেলের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া হয়। বোর্ড কর্তাদের চাপে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় রুবেলকে। দেশ ছাড়া হন লুৎফর রহমান বাদলও।
প্রিমিয়ার লিগের পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে লুৎফর রহমান বাদল সংবাদ মাধ্যমে নাজমুল হাসান পাপনের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। সাবেক বোর্ড প্রধানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে তিনি বলেছিলেন, “উনি মুখে অনেক কথাই বলেন কিন্তু উনার অনুগত চাকুরে দিয়ে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করান। ওই যে মল্লিক (বোর্ড পরিচালক ইসমাইল হায়দার) আছে না, তার চাকর, সে-ই সব ঠিক করে, কে আম্পায়ার হবে আর খেলা কোথায় হবে।”
বিসিবির পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কলঙ্ক বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান বাদল। প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের বিরুদ্ধে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ তোলেন বাদল। বলেন, ‘ও (খালেদ মাহমুদ) কোথায় নেই? বিসিবি পরিচালকের পদ থেকে শুরু করে ক্লাব কর্মকর্তা, কোচ, সবখানে আছে। নেই শুধু বিসিবির অফিস সহকারী রুস্তমের পদে।’●