হারিয়ে যাওয়া আধুনিকায়নবাদীরা কোথায়?

নতুন বাংলাদেশ কেবল নেতিবাচক অধিকার নিশ্চিত করার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষের জন্য ইতিবাচক অধিকার বাস্তবায়নের কোনো কৌশল নেই। এ দেশের দরকার আধুনিকায়ন ও শিল্পায়ন। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করবে কে?

হারিয়ে যাওয়া আধুনিকায়নবাদীরা কোথায়?

শহর ও গ্রামের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের জন্য পরিকল্পনা কোথায়, কৌশল কোথায়, রূপরেখা কোথায়? “নতুন বাংলাদেশ” কেবল কাগজে-কলমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাস্তবে তার টিকিটিও মিলছে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অনুরূপ অধিকারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারো তর্ক থাকার কথা নয়। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কমানোর উদারনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে এইসব স্বাধীনতার কথা আলোচনায় আসে। এগুলোকে বলা হয় নেতিবাচক অধিকার। কিন্তু ইতিবাচক অধিকার— যেমন খাদ্য, আবাসন, গণশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সচ্ছন্দ জীবনমানের কথা বললে, পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের ইতিহাস প্রমাণ করে রাষ্ট্র এখানে অপরিহার্য এবং কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকে। অথচ ঢাকা এবং এর বাইরে এ বিষয়ে কোনো আলোচনার খবর পাওয়া যায় না। আইন বইয়ে কেবল ইতিবাচক অধিকারের প্রতিশ্রুতি লিখে রাখাই যথেষ্ট নয়, বিশেষত যখন নেতৃত্বের কাছে তা বাস্তবায়নের কোনো ধারণা বা আগ্রহ কোনোটাই নেই।

আসুন, আমরা বাস্তবে ফিরে যাই।

সস্তা শ্রমিক— বিদেশে কাজ করা মানুষজন, শহরের নারীশ্রমিকেরা, আর গ্রামে অবহেলিত অথচ লড়াকু কৃষকরা— এই দেশকে টেনে তুলেছেন, এগিয়েও নিয়েছেন। এর সঙ্গে অগণিত অচেনা এনজিও কর্মীর অবদানও স্বীকার করতে হবে অকপটে। এটাই ছিল প্রথম ধাপের রকেট। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, রোবটিক্স আর ইন্টারনেট অব থিংসের এই যুগে তার ক্ষমতার সীমা আছে। আজকের দুনিয়ায়, যেখানে ট্রাম্পীয় বিশ্বাসঘাতকতায় মুক্তবাণিজ্য ভেঙে পড়ছে আর চীনের উত্থান নতুন দুনিয়া গড়ে তুলছে, সেখানে বাংলাদেশের জরুরি ভিত্তিতে দ্বিতীয় ধাপের রকেটের প্রয়োজন। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সেটা তৈরি করেনি, করবেও না। আসলে তারা জানেও না কীভাবে সেটা করতে হয়। হয়তো পরামর্শকরা এসব করতে তাদের নিষেধ করেন। তারা হয়তো ভাবেন, দিশাহীন কোনো ক্ষেপণাস্ত্র জাদুর মতো বাজার সামাল দেবে। অথচ, এটা তো পূর্ব এশিয়ার পথ নয়।

তাহলে কি এটা বিপ্লবী কোনো উত্থানের ডাক? পুরোনো ধাঁচে নয়, বরং এমন এক পরিকল্পিত রূপান্তরের আহ্বান, যা দেশকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাবে? বা আধুনিকতাবাদীদের নতুন জোট গড়ে তোলার? নতুন ভূরাজনৈতিক জোটে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার? এমন এক অঞ্চলের অংশ হয়ে ওঠার, যা চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে নাড়ির টানে বাঁধা?

সেই অধ্যায় এখনও লেখা বাকি। এখন প্রয়োজন এক ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টি। না, আরেকটা রাজনৈতিক দল নয়। বরং একেবারে নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা। এমন এক সাধারণ বোধ গড়ে তোলা, যা সব রাজনৈতিক শক্তিকে এক সূত্রে বাঁধবে। চীনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টি বলতে বোঝায় এমন এক মতাদর্শকে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পার্টি কমিটিগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে— যাতে চীন তার শিল্পের আধিপত্য ধরে রাখতে পারে এবং প্রযুক্তিগতভাবে আরও উন্নত হতে পারে। যেখানে চীন হয়ে উঠবে পনেরটা জার্মানি, আর একশোটা সিঙ্গাপুরের সমান। ট্রাম্প এত ব্যাকুল কেন? তিনি হয়তো বইপত্র পড়েন না, কিন্তু ছবির ভাষা ঠিকই বুঝতে পারেন।

যমুনার ‘স্পিনের সুলতান’ আর ঢাকার অভিজাত শ্রেণির বড় অংশ আসলে এই বৈশ্বিক শক্তির ভূমিকম্পসদৃশ পরিবর্তনটা ধরতেই পারেনি। তারা এখনো দু-একটা পশ্চিমা সাময়িকী পড়েন আর সেখান থেকে মুখস্ত করা বুলি আওড়ে চলেন। কোনগুলোর কথা বলছি আপনারা জানেন। তাই তারা আজ থেকে পনেরো বছর পিছিয়ে আছে— দিল্লির আত্মীয়দের মতো, যাদের স্বীকৃতির জন্য তারা এখনও হাপিত্যেশ করে।

দৌড়ানোর আগে হাঁটা শিখতে হয়। বাংলাদেশকে বাস্তবতার ভেতর থেকেই কিছুটা সংযত কিন্তু সাহসী লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। তার মানে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হবে। একইভাবে, কেবল আদুরে-আব্দারে ভরপুর সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বিজিএমইএ’র চেয়ে সবচেয়ে বেশি দরকার এমন এক জোট, যা আধুনিকায়ন, বহুমুখী শিল্পায়ন এবং রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক দিকনির্শনার মধ্য দিয়ে শক্তিশালী করবে, যাতে অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়া যায়। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন কৃষক, শহরের দরিদ্র আর নারীদের সঙ্গেও লাভের গুড় ভাগাভাগি করা যাবে, অর্থাৎ আরও বেশি সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

একটি পথ ভাবা যেতে পারে— ফেসবুক পোস্টের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি কমানো। বরং প্রকল্প বাস্তবায়ন, মান, কৌশল ও অঙ্গীকারের ওপর বিস্তারিত নজরদারি বাড়ানো। এতে প্রথম প্রতিক্রিয়া হতে পারে এ রকম— সবাই তো এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। সব স্পিন সুলতানরাই আকাশ-কুসুম প্রতিশ্রুতি দেন। যমুনার সুলতানরাও আলাদা নন। তাদের শেখার জন্য কোনো রেফারেন্স বা মডেল নেই। কোনো বাস্তব কর্মসূচি নেই। কোনো পরিবর্তনের ইচ্ছেও নেই। শুধু বলছেন, এবার তাদের পালা। 

নতুন রাজনীতিও এখনো পুরনো রাজনীতির মতোই সমান দোষে দুষ্ট। স্বচ্ছতাকে অবশ্যই নজরদারির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। মুহাম্মদ ইউনুস হয়তো অভিজাতদের ঐকমত্যই ব্যক্ত করেন, যখন তিনি চ্যাথাম হাউসের সভায় বাংলাদেশিদের সরলতা নিয়ে অবজ্ঞাভরে কথা বলেন। কিন্তু জনগণ যদি পরিবর্তনের বাস্তব প্রমাণ না দেখে, তবে বাধ্য হয়ে স্পিনের সুলতানদের কথাই বিশ্বাস করবে। পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চক্র আবারও দৃঢ় হবে।

অভিজ্ঞ গণমাধ্যমকর্মীরা মনে করেন, বিএনপি তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকবে। আমি সন্দেহ করি, জনগণ এত ধৈর্যশীল থাকবে কি না। আমি অবাক হবো, যদি পরের সরকার প্রথম মৌসুমের সব কিস্তি পার করতে পারে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তো দূরের কথা। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগকে স্থায়ীভাবে মুছে ফেলার পর, এখন যেমন এনজিও-ভিত্তিক টেকনোক্রেসি মিথ ভাঙা হচ্ছে, তেমনি কি বিএনপিকেও নিজেদের ফাঁসিতে ঝুলে পড়ার মতো দড়ি দেওয়া হবে? সবই খুব অল্প সময়ের মধ্যে? তবে এ অনুমান করা যায়, বিএনপি আসলেই অপ্রস্তুত ও সেকেলে রয়ে গেছে। অথচ, পাঁচ কোটি তরুণ আরও কিছু চায়। তারা শিগগিরই বুঝে যাবে, কথিত ‘নব্যউদার অর্থনীতি’ আসলে চাকরি তৈরি করে না। একই অবস্থা ভারত, পাকিস্তান আর দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলোরও।

শিল্প বহুমুখীকরণ কোনোদিনই ঘটবে না?

সবাই অভিযোগ করে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানির বাইরে শিল্পকে বহুমুখী করতে পারছে না। কেউ কেউ জানেন, এ শিল্পের উৎপত্তি বিশ্বব্যাংক, দাতা সংস্থা বা বড় এনজিও থেকে নয়। বরং মূলত দক্ষিণ কোরিয়া থেকে— তাদের ক্রেতা ও কারখানার মালিকদের কাছ থেকে। গল্প শুরু হয় দেশ গার্মেন্টস দিয়ে, তারপর আরও উদ্যোক্তা সিউলে গিয়ে শিল্পের কৌশল শিখে আসেন। কারখানাগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে। দৈনন্দিন নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও নারীরা সামাজিক মর্যাদায় উপরে ওঠে আসে (যদিও একে এনজিওসুলভ নারী ক্ষমতায়ন বলে ঢেকে দেওয়া হয়), ব্যাংকিং, শিপিং, পরিবহন, সেবাখাত— সবই গড়ে ওঠে। আধুনিকায়নের প্রাথমিক ধাপ।

তবে গল্পটি অসম্পূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়া কীভাবে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস থেকে শুরু করে দুই দশকেরও কম সময়ে অন্যান্য শিল্পে বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হলো? অথচ বাংলাদেশ ৪৫ বছরেও তা পারল না, হয়তো ৫০ বছরেও পারবে না। ইঙ্গিতটা হলো, সে সময় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ গোষ্ঠী সামরিক প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করেছিল। তারা বলেছিল, কোরিয়ার রাসায়নিক বা ভারী শিল্পে বিনিয়োগ করা উচিত নয়— “সস্তা পোশাকেই থাকুন, মি. প্রেসিডেন্ট।” জেনারেল ভদ্রভাবে হেসে রিপোর্টের দিকে তাকালেন। তারপর নিজের মতো করেই কাজ করলেন। তার হাতে ছিল পরিকল্পনা। রাষ্ট্র ছিল সক্রিয়। তিনি টাকাও জোগাড় করলেন। কীভাবে সেটা করেছিলেন, সে গল্প আমরা আরেকদিন বলব।

দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৭০-এর দশক এবং ১৯৮০-এর শুরুর দিকে শিল্পকে বহুমুখী করেছিল। তখন এটি হয়ে উঠেছিল শিল্পের দৈত্য। কিন্তু এ বিষয়ে বা অন্যান্য এশীয় উদাহরণের বিষয়ে সচেতন বিতর্ক কোথায়? এই কাজ শুধু (নব্যউদার) থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। এতে একটি জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু অত্যাবশ্যক প্রক্রিয়া মসৃণ ও নিরাপদ দেখানো হয়। পাশাপাশি ইতিহাসের বিকৃত চিত্র তৈরি হয়, যেখানে নব্যউদারসন্ধি দিয়ে সাজানো হয়। প্রকৃত, কিছুটা জটিল অভিজ্ঞতাগুলোই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। আর আজকের জন্য ২০২০ ও ২০৩০-এর দশকের পাঠ নেওয়ার জন্য রয়েছে চীন ও ভিয়েতনাম।

নতুন রাজনীতির বর্তমান (অস্থায়ী) নেতারা বুঝতে পারছেন না যে, ৫ কোটি তরুণ বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের সঙ্গেই জড়িত। চীন অদৃশ্য থেকে গেছে। সমান্তরালে, তাদের তরুণ-সংস্কৃতিকে স্বীকার করতে হবে নারীদের প্রতি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঋণ এবং জাতীয় সম্ভাবনাকে, যা ইচ্ছাকৃতভাবে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ এক হাতে বাঁধা অবস্থায় লড়ছে। সংস্কারের বদলে আমরা পশ্চাদপসরণতার দিকে যাচ্ছি। এটি বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা, যদি সরাসরি প্রতারণা না-ও হয়। এটি বিশ্বাসঘাতকতার মতো শোনায়, আর দৃষ্টিসীমাহীনতার মতো। হয়তো নতুন তরুণ নেতৃত্ব শিগগিরই আবির্ভূত হবে।

সব মিলিয়ে, একটি বৃহত্তর কৌশলগত-শিল্পায়ন-তরুণ জোট দরকার, যারা যুক্তি দেখাবে কীভাবে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হতে পারে, যখন তাকে একটি শিল্প-ভিত্তিক চীন-কেন্দ্রিক এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। স্পিনের সুলতানরা যতোই বলুন না কেন, এ এমন এক বাস্তবতা, যা দেশ আর উপেক্ষা করার সামর্থ্য রাখে না।

এখন নীরব থাকার সময় নয়, বিশেষ করে নারীদের জন্য। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল দৃষ্টিহীন রাজনৈতিক শ্রেণি বা রহস্যময় উপদেষ্টাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। বর্তমান আজগুবি কথাবার্তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি হয়তো এ যাত্রার আরেকটি ধাপ হয়ে উঠবে। স্বৈরতন্ত্র আপাতত শেষ। টেকনোক্রেসি অযোগ্যতা ও বোকামির ঝড়ে ভেসে গেছে। নির্বাচনী গণতন্ত্র কি সেই হারানো আধুনিকায়নবাদীদের ফিরিয়ে দিতে পারবে?●

ফরিদ এরকিজিয়া বখত একজন লেখক ও বিশ্লেষক।