বিচ্ছিন্নতাবাদী হলে তো বারবার সংবিধানের দ্বারস্থ হতাম না: রানী ইয়ান ইয়ান
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ লড়াই নিয়ে “মুখোমুখি” হয়েছিলেন রানী ইয়ান ইয়ান।
সম্প্রতি নেত্র নিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন আদিবাসী ও নারী অধিকারকর্মী রানী ইয়ান ইয়ান। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ লড়াই, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি আধিপত্যবাদী রাজনীতির চেনা চরিত্র, সেখানকার সেনানিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের গড়িমসি— এইসব আলাপ উঠে এসেছে তার বক্তব্যে। উঠে এসেছে সঙ্কটের সমাধান প্রস্তাবও। নেত্র নিউজের পক্ষে ইয়ান ইয়ানের সঙ্গে ছিলেন সুরাইয়া সুলতানা বীথি।
বীথি: আদিবাসী শব্দের যে রাজনীতি, রাষ্ট্র আদিবাসী বলতে চায় না, রাষ্ট্রের নাগরিকেরা আদিবাসী শব্দটিকে মানতে চায় না; ঠিক কী কারণে?
ইয়ান ইয়ান: আদিবাসী ইস্যুতে বেশ কয়েকটি ন্যারেটিভ প্রচলিত আছে এবং প্রচার করা হয়েছে বিভিন্নভাবেই। কোনো কোনো সময় সেটি রাষ্ট্রীয় মদদে বা পৃষ্ঠপোষকতায়। কোনো কোনো সময়, যারা আসলেই বিশ্বাস করেন যে, আদিবাসী বলে বাংলাদেশে আলাদা কোনো জাতি নেই, তারা সেটিকে খুব স্বপ্রণোদিতভাবে প্রচার করেন।
তো একটা বিষয় কি, আমরা যখন নিজেদেরকে আদিবাসী বলে পরিচয় দিচ্ছি ,তখন কয়েকটি কথা বলা হয় যে, আদিবাসী পরিচয়টি দেওয়া মানেই এটি সংবিধানবিরোধী। এবং যেহেতু সংবিধানবিরোধী একটি পরিচয় আমরা দিচ্ছি, সে কারণে সেটি রাষ্ট্রবিরোধী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী। আমার মনে হয় যে, সংবিধানবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী— এই কথাগুলো দিয়ে যে একটা মিথ, একটা ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে, সেটি একটুখানি ভাঙা দরকার এবং ভাঙার জন্য একটু আলাপ দরকার। তো আমি কয়েকটি কথা যদি বলতে পারি এই বিষয়টি নিয়ে— আমরা যখন আমাদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিচ্ছি, এটি কোনোভাবেই আসলে সংবিধানবিরোধী না। কারণ, আমরা দেখি যে, সংবিধানে লেখা আছে রাষ্ট্র উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, সম্প্রদায়, তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিকাশে এবং সংরক্ষণে কাজ করবে। এ কথাটি লেখা আছে সংবিধানে। কিন্তু কোনো জায়গাতে এই কথাটি লেখা নাই যে, বাংলাদেশে বাঙালি বাদে অন্যান্য যে জাতিগোষ্ঠী আছে তারা নিজেদেরকে আদিবাসী বলে পরিচিত দিতে পারবে না।
বীথি: সবসময় বলা হয় যে, আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী তারা নিজেদের জন্য আলাদা একটা রাষ্ট্র কায়েম করতে চান এবং যে কারণে পাহাড়ে আমাদের সামরিক শাসন দরকার— এই ধরনের বিভিন্ন কথা আমরা শুনতে পাই। আমি আপনার কাছে জানতে চাইবো, এই মুহূর্তে ঠিক কোন কোন অধিকার দেওয়ার ভয়ে রাষ্ট্র আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না?
ইয়ান ইয়ান: সংবিধানে কিন্তু কোনোভাবেই বলা নেই যে, আদিবাসী বলা যাবে না। কিন্তু আবার একইসাথে আমরা যদি এই কথাটা চিন্তা করি যে, সংবিধানে যে কথাগুলো বলা নেই সেই কথাগুলোর বিরোধিতা করার অধিকার আমাদের নেই? আমাদের কিন্তু সেই অধিকার সংবিধানেই দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে এই স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে যে— বিরোধিতা করা, ভিন্নমত প্রকাশ, ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা… এই স্বাধীনতাগুলো আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস যদি আমরা দেখি যে, সংবিধানবিরোধী কথা বললেই রাষ্ট্রবিরোধী বলা হয়, সেটার কিন্তু আসলে কোনো ভিত্তি নেই। কারণ যদি আমরা ধরে নিই যে, যারা সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তারাই রাষ্ট্রবিরোধী, তাহলে গত ৫০ বছরে যেসব সরকার সংবিধানে সংশোধনী এনেছেন তাদের সবাইকেই আমরা রাষ্ট্রবিরোধী বলে তর্ক করতে পারি। কারণ সংবিধানে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, সে কথাগুলো নিয়ে ওনারা খুশি নন, তাই তাদের মনে হয়েছে যে, সংবিধান পরিবর্তন করা দরকার, সে কারণে সংবিধানে সংশোধনী এসেছে। তো সেই হিসেবে আমরা যদি দেখি, জিয়ার আমল থেকে শুরু করে এরশাদ, আওয়ামী লীগ-বিএনপি ১৭ বার বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধন করেছে। তাহলে তো সবাইকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে তকমা দেওয়া দেওয়া যায়। কিন্তু একটা বিষয় যদি আমরা খেয়াল করি যে, সংবিধান বিরোধিতার সাথে রাষ্ট্রবিরোধিতার সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আদিবাসী ইস্যুতেই দেখা যায়, সবাই একই সুরের গলা মেলান এবং সেটার তো পলিটিক্স আছে। এই যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পলিটিক্স, আধিপত্যবাদের পলিটিক্স। সেটা নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকরা।
বীথি: আদিবাসী বললে কোন কোন অধিকার দিতে হবে, যেটার সামর্থ রাষ্ট্রের নাই? বা এই মুহূর্তে আদিবাসীদের কী কী অধিকার নাই?
ইয়ান ইয়ান: আদিবাসীদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে অধিকারগুলো আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক সনদে আছে, আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এ আছে, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে আছে, সেখানে যে অধিকারগুলোর কথা বলা হয়েছে, সে অধিকারগুলো প্রত্যেকটাই সামষ্টিক অধিকার। তো, সেখানে স্পষ্ট করে এই কথাটা বলা হয়েছে যে, আদিবাসীদের সামষ্টিক অধিকারগুলো সংরক্ষিত হলেই, বাংলাদেশে অন্যান্য যে নাগরিকেরা আছেন তাদের সমপর্যায়ে গিয়ে আদিবাসীরা তাদের মানবাধিকার এনজয় করতে পারবেন। তো সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে স্বায়ত্বশাসনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে ভূমির উপর আদিবাসীদের যে সামষ্টিক অধিকার আছে, সে কথাগুলো বলা হয়েছে। এবং আমরা যদি বাংলাদেশের লিগ্যাল ল্যান্ড স্কিমটা দেখি, সেখানেও একইভাবে আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য সেফগার্ডগুলো অলরেডি ছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন হওয়ার আগ থেকেই ছিল।
সিএইচটি রেগুলেশন-১৯০০ (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা-১৯০০) অর্থাৎ ১৯০০ সালে, ব্রিটিশ আমলে যে আইনটি পাস করা হয়েছিল, সেখানেও স্বায়ত্তশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভূমির উপর অধিকার এবং আমরা যে স্বতন্ত্র একটি ভৌগলিক এলাকায় আছি, সেই অধিকারগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এবং সেটির উপর ভিত্তি করে ১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে যে চুক্তি করা হয়েছে, পার্বত্যচুক্তি, সেখানেও এই অধিকারগুলোর আলোকে অনেকগুলো প্রভিশন তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্রের পালন করতে হবে। আমরা বাংলাদেশে ডিগনিটি নিয়ে, অধিকার নিয়ে থাকতে চাই, বেঁচে থাকতে চাই বলেই বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বারস্থ হয়েছি। এখন আমাদের যে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয়, আমরা আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি করতে চাই— এই কথাগুলো যে বলা হয়, সেটি যদি আমরা চাইতাম তাহলে আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। গত ২৭ বছর ধরে পার্বত্যচুক্তি যে বাস্তবায়ন হয়নি, সেটিকে নিয়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে তাদের সাথে নেগোসিয়েশন করা, তাদের সাথে ডিসকাশন করা, তাদের কাছে দাবিগুলো তুলে ধরার আসলে আমাদের প্রয়োজন ছিল না।
বীথি: পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি নিয়ে যেহেতু আপনি কথা বলছেন, সে প্রসঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, চুক্তির যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেমন, ভূমি নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন— এখন সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন চাইলে কিভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে যাওয়া যায় বা সংবিধানে যদি উল্লেখ করা থাকে বা রাষ্ট্রের সাথে যদি চুক্তি থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ভূমি নিরাপত্তা ও স্বায়ত্তশাসন— সেগুলো চাইলে আপনাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আসলে কেন বলা হয়, মানে আপনারা ঠিক কী করেন, যার কারণে আপনাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয়?
ইয়ান ইয়ান: আমরা যেটা দেখে আসছি সেটি হচ্ছে, স্বায়ত্তশাসন এবং সার্বভৌমত্ব এই দুটো কনসেপ্টের মধ্যে যে অনেক বিশাল পার্থক্য আছে, জনগণের মধ্যে যে পার্সপেক্টিভ আছে, সেটিকে ঘোচানোর জন্য কোনো রকমের কোন ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়নি।
এখন স্বায়ত্তশাসনের যে দাবিটি আমরা করছি এবং যে স্বায়ত্তশাসন ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের ছিল এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ আমলে এসে সেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন যে এখন সেমি অটোনোমাস স্টেট-এ পরিণত হয়েছে, সে কথাটুকু যখন আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করি, তখন আমাদেরকে দেখানো হয় যে, আমরা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী। সেটির আসলেই কোনো রকমের ভিত্তিতে নেই। এবং আমি একটু আগে বলেছি যে, আমরা যদি আসলেই বিচ্ছিন্নতাবাদী হতাম এবং একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগুচ্ছি— সে রকম যদি আমাদের চিন্তা ভাবনা থাকতো, তাহলে গত ২৭ বছর ধরে আমাদের এই যে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন, সেটি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবিরও প্রয়োজন ছিল না। স্বায়ত্তশাসন মানে এটি না যে, বাংলাদেশের যে রুলস ও ল আছে সেগুলো বাইরে আমরা স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছি।
স্বায়ত্ত শাসনের অর্থ হচ্ছে এটাই যে, আমরা আমাদের যে স্বকীয়তা আছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে থেকে আমাদের যে প্রথা আছে, রীতিনীতি আছে, আমাদের প্রথাগত প্রতিষ্ঠান আছে, যে রীতিনীতির মাধ্যমে আমাদের সমাজ পরিচালিত হয়ে আসছে, আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে, বৈচিত্র্য আছে, আমাদের যে অধিকারটুকু আছে, আমাদের সমাজে আমরা কীভাবে প্রোগ্রেসড হচ্ছি, আমরা কীভাবে আমাদের উন্নয়ন নির্ধারণ করতে পারছি, সেটি হচ্ছে আমাদের স্বায়ত্তশাসন।
বীথি: তাহলে এই যে চুক্তিটি হলো, মূল উদ্দেশ্যগুলোর উপর ভিত্তি করে, এই চুক্তির আসলে কার্যকারিতা কতটুকু সেক্ষেত্রে?
ইয়ান ইয়ান: যখন ১৯৯৭ সালে এই চুক্তিটি করা হয়েছিল তখন ডেফিনেটলি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি গুডউইল ছিল। এবং আমাদের ইন্ডিজেনাস যে দলের সাথে, পলিটিক্যাল গ্রুপের সাথে চুক্তি করা হয়েছিল, সেখানে একটা গুডউইল ছিল এবং বিভিন্ন কারণে সেই চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। পূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এই চুক্তিতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি কথাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে আদিবাসীদের অধিকারের যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, সেটির ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করে। তো এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে আমি বলব যে, সরকারের আসলেই সদিচ্ছার অভাব। এবং একই সাথে আমরা যেটা দেখতে পাই যে, চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য যা কিছু ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়েছে, বিভিন্নভাবে, নট অনলি সরকার (বা শাসকগোষ্ঠী) ফোরফ্রন্টে গিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, ব্যাপারটি তো সেটি নয়। বিভিন্ন কারণ আছে, বিভিন্ন জিওপলিটিক্যাল রিসার্চ আছে, তারা বিভিন্ন সময় ন্যাশনাল সিকিউরিটির কথা বলে, কিন্তু যে কথাই বলা হোক না কেন, আমাদের যে মানবাধিকার, আমাদের যে আদিবাসী অধিকার সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিনশেষে রাষ্ট্রের, দিনশেষে সেটি সরকারের। এবং সেটি আসলে এখনো করা হয়নি।
বীথি: এই পর্যায়ে এসে আমি জানতে চাই, বলা হয়, পাহাড়ে সামরিক শাসন জারি রাখতে হবে, আমি একটু আসলে বুঝতে চাই, আমাদের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন তো মূলত সীমান্তবর্তী এলাকায়। তাহলে পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনও নাই, কিন্তু সেখানে আসলে সামরিক শাসনের প্রয়োজনীয়তা কেন, কতটুকু? বা অনেকেই যখন পাহাড়ের কথা আসলে বলেন যে, পাহাড়ে গেলে তো অবশ্যই সেনাবাহিনীর যতক্ষণ প্রটোকল থাকবে সেই টাইমটা মেনে তারপরে যেতে হবে…
ইয়ান ইয়ান: দেখুন বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬১টি জেলায় যে সরকার আছে সেটিকে ডেমোক্রেটিক সরকার বলবেন, ভোটের সরকার বলবেন… কারণ অনেক সময় ডেমোক্রেটিক গভর্মেন্ট আর ভোটের গভর্মেন্টের মধ্যে পার্থক্য থাকে। কিন্তু, অন্তত খানিকটা হলেও ডেমোক্রেসির একটা ভাইব আছে ৬১টি জেলার মধ্যে, যারা আছে তারা সিভিলিয়ান গভর্মেন্ট। এবং বাকি তিনটি জেলার মধ্যে আমরা যেটা দেখি, সেটা হচ্ছে সামরিক শাসন, এখানে জারি আছে।
আমরা সবসময় কিন্তু এই কথাটা দাবি করে এসেছি যে, পুরো বাংলাদেশে যখন সিভিলিয়ান গভর্মেন্ট আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামেও সিভিলিয়ান গভর্মেন্ট থাকা উচিত। এবং সেখানে যদি কোনো রকমের কোনো ইন্টারাপশন হয় বা ন্যাশনাল সিকিউরিটির যদি কোনো সমস্যা হয়, আমাদের সিভিলিয়ান ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি যারা আছে, তাদেরকে সে দায়িত্বটা দেওয়া উচিত।
কারণ, দিন শেষে আমরা যেটা দেখি, সিভিলিয়ান গভর্মেন্ট যেভাবে একটি সমস্যাকে ডিল করবে, সেখানে মিলিটারি শাসন শুরু হলে তারা যে কোনো পলিটিক্যাল সমস্যাকে সামরিক কায়দায় সমাধানের চেষ্টা করবে। তো, সেভাবে তো আসলে সম্ভব না। এটা যেহেতু পলিটিক্যাল সমস্যা, এখানে আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা, আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক সমস্যা, সেটিকে আপনি মিলিটারাইজেশনের মাধ্যমে তো আসলে সমাধান করতে পারবেন না।
তো, যে কথাটি একটু আগে বলছেন যে, একটা ফলস, একটা সেন্স অফ ফিয়ার তৈরি করা করে রাখা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, এখন আমি যদি আমার নিজের বাসায় কাউকে দাওয়াত দিয়ে আনতে চাই এবং দুর্ভাগ্যবশত আমার বন্ধু, আমার আত্মীয় বা আমার কেউ একজন যদি (ডিগ্রেশন) নাগরিক হন তাকে তো আসতে দেওয়া হবে না। বা উনি যদি আসেনও তাকে অনেক রকমের সিকিউরিটির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এবং অনেক হয়রানির শিকার হতে হবে।
যদিও আমরা এই কথাটা বলি যে, তাদের সিকিউরিটির ভয়-ভীতি তৈরি করে রাখা হয়েছে, যারা বাইরে থেকে আসবেন তাদের এবডাক্ট (অপহরণ) হওয়ার একটা ভয় থাকে, একটা ফিয়ার থাকে, এভাবে করেই সবসময় বলা হয় যে, তাদের আসতে দেওয়াটা ঠিক হবে না, বা যারা আসেন তাদের উপর অনেক নজরদারি থাকে। লোকাল মানুষ যারা আছেন, কমিউনিটি যারা আছেন, তাদের সাথে ফ্রিলি কথা বলতে পারবেন না। তারা কোন কথাগুলো বলছেন সেই কথাগুলো তারা দেখবেন। এগুলো তো আসলে রাষ্ট্রের সার্ভেইলেন্স, যেটি আমরা গত ১৫ বছর দেখেছি, শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম না, পুরো বাংলাদেশেই আমরা দেখেছি। সেটি এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে জারি রাখা হয়েছে।
বীথি: আমি একটু জানতে চাই যে, আমরা তো সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন জীবন কেমন সেটা জানি, আমাদের এই নাগরিক জীবন কেমন সেটা জানি বা গ্রাম্য জীবন কেমন সেটা জানি, কিন্তু পাহাড়ের দৈনন্দিন জীবন আসলে কেমন? আপনাদের যেহেতু কোনো ধরনের… আমাদের মতন… যেমন বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ পাবলিক সার্ভিস যারা করেন বা আমাদের নিয়ম কানুন, রেগুলেশনস যেমন, আমাদের এখানে কোনো মানুষকে সন্ধ্যার পরে বের হলে বা তিনটার পরে বের হলে কেউ প্রোটোকল দিয়ে পৌঁছে দেয় না। বা যে ধরনের দমনপীড়নগুলো এত বছর ধরে ছিল, সেগুলো তো ছিলই। কিন্তু পাহাড়ের বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। সেদিক থেকে আমি একটু জানতে চাই যে, পাহাড়ের দৈনন্দিন জীবন কেমন?
ইয়ান ইয়ান: পাহাড়ের দৈনন্দিন জীবন কী রকম, সেটি বলার জন্য তো আপনাকে আরেকটু সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে যে, একদম গ্রামের দিকে যারা আছেন তাদের দৈনন্দিন জীবন, নাকি উপজেলা লেভেলে যারা আছেন, নাকি একদম শহরের দিকে যারা আছেন… একেকজনের ক্ষেত্রে বাস্তবতা একেক রকম।
বীথি: আমি ঠিক শহরের বলবো না, কারণ শহরের বাস্তবতা আর সাধারণ মধ্যবিত্তের বাস্তবতার ভেতরে যে ফারাক থাকে সেখানে আমি যদি পাহাড়ের কথা বলি, পাহাড় তো আরো দুর্গম এলাকা। পাহাড়ের মানুষকে একটু পানি খাওয়ার জন্য অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। স্কুলে যাওয়ার জন্য অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয়। সেখানে আমি যদি বলি যে, একটু মফসলের দিকে তাদের বাস্তবতা কেমন, তাদের সংগ্রামটা কেমন? তাদেরকে ঠিক কোন কোন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়?
ইয়ান ইয়ান: আমি কি আদিবাসী নারী এবং মেয়ে শিশুদের চ্যালেঞ্জগুলো বলবো?
বীথি: অবশ্যই অবশ্যই
ইয়ান ইয়ান: আচ্ছা, যদি আমি পাহাড়ের রিমোট এরিয়ায় যারা থাকেন বা খানিকটা মফস্বলের দিকে, মফস্বল বলতে খানিকটা হেঁটে যেতে হয় টাউনশিপে… সেই আদিবাসী নারী এবং শিশুদের কথা যদি আমি বলি, আদিবাসী নারী এবং শিশুদের তো সবসময় একটা ফ্রিলি মুভ করার প্রচলন ছিল… সবাই সব জায়গায় যাচ্ছি, বাসা থেকে, গ্রাম থেকে বা বাড়ি থেকে জুমে তারা যাচ্ছেন… সেই জুম্মায় তো, মানে যেখানে উনারা ক্ষেত করছেন, চাষবাস করছেন সেটি হয়তো এক ঘন্টা, দেড় ঘন্টার দূরত্বে আছে। তো, তারা নিজেদের মত করে যাচ্ছেন। যেখানে পানি আনতে যাচ্ছেন, হ্যাঁ, অনেক কষ্ট আছে। পাহাড়ে পানি সমস্যা প্রকট হচ্ছে দিন দিন। কিন্তু তারপরও তারা পানি আনতে যাচ্ছেন দেড় ঘন্টা, দুই ঘন্টা দূরে। কিন্তু আগে যে সেন্স অফ সিকিউরিটি ছিল সেই সেন্স অফ সিকিউরিটি এখন আর অন্তত আদিবাসী নারীদের মধ্যে নাই। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। সেই ভয়টা আছে এবং আমি যেটা দেখতে পাই যে, আমাদের আদিবাসী শিশুরা যারা আছেন, মেয়ে শিশু বিশেষ করে, তাদের মধ্যে সেই ভীতিটা চলে এসেছে আস্তে আস্তে। তারা যদি হাঁটে তাহলে একসাথে হাঁটতে হবে। আলাদা করে, একা একা স্কুলে যেতে পারবে না। এবং আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, পাহাড়ে এক একটা স্কুল… যদি আমি রিমোট এরিয়ার কথা বলি… অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটতে হয়। কিন্তু সেই সেন্স অফ সিকিউরিটিটা আসলে আমি দেখতে পাই যে, আদিবাসী নারীদের মধ্যে অনেক কমে গেছে।
সেন্স অফ সিকিউরিটি যদি কমে যায়, আমাদের মুভমেন্টের উপর যে রেস্ট্রিকশন, সেটা আমরা তো সেলফ ইমপোজ করছি। আমরা বুঝতে পারছি, যদি কোনো কিছু হয়, সেটার কোনো প্রতিকার যেহেতু আমরা পাবো না, তাহলে আমরা মুভমেন্টটা নিজেরাই সেলফ রেস্ট্রিকশনের আওতা নিয়ে আসি।
তো সেই কারণে, আমরা যেভাবে জীবনটাকে চর্চা করতাম, আমাদের যে কাজগুলো ছিল, যে চর্চাগুলো ছিল, সেগুলোকে আমরা ঠিকমতো পালন করতে পারছি না। এবং এই যে আমাদের ইন্টেগ্রিটি, সোশ্যাল ইন্টেগ্রিটি, আমাদের যে কমিউনিটি সেগুলো কিন্তু ধীরে-ধীরে আসলে ক্ষয় হয়ে গেছে।
জাস্ট বিকজ বাস্তবতার সাথে এডাপ্ট করতে গিয়ে আমরা আমাদের আদিবাসী সত্তা আদিবাসীদের যে চর্চাগুলো আছে সেগুলোকে আমরা বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছি।
বীথি: যেহেতু আমরা নারী নিয়ে কথা বলছি, আপনি নিজেও একজন নারী, আপনি নিজে একজন আদিবাসীও এবং আপনি আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, অনেক সরব থাকেন, আপনার উপর তো আসলে বহুমুখী চাপ থাকার কথা… যেহেতু আমরা সকলেই এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল যে, একটা রাষ্ট্র কীভাবে তার নাগরিককে, যে নাগরিক আসলে তার অধিকার নিয়ে সচেতন বা সরব থাকে, কোন ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাকে যেতে বাধ্য করে। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি ইয়ান ইয়ান কেমন, তার জীবনটা কেমন, কী ধরনের হুমকি, কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তাকে মোকাবেলা করতে হয়?
ইয়ান ইয়ান: ব্যক্তি ইয়ান ইয়ান কে? এরকম অনেক ইয়ান ইয়ান আছে আসলে, পাহাড়ে। আদিবাসী অধিকার যখন হরণ করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মদদে হরণ করা হয়, তখন তারা কিন্তু অনেক সরব থাকে। আমি এখানে কেবল একা না, এরকম অনেকজন আছেন। এবং এই যে, আমাদের মানবাধিকার, আমাদের আদিবাসী অধিকার হরণ করা হয়, এই কথাগুলো নিয়ে যখন আমরা কথা বলি তখন, ওই যে ট্যাগিংয়ের যে একটা রাজনীতি আছে, ট্যাগ করে দিলে… যে ন্যারেটিভগুলো আদিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রচলন হয়ে আসছে, সেই ন্যারেটিভের মধ্যে আমাদেরকে ফেলে খুব সহজে ট্যাগ করা সম্ভব হয় যে, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী এবং আমরা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তো, এই ধরনের ট্যাগিংয়ের যে রাজনীতি, সেটি কিন্তু আছে। এবং এটি আমার উপরেই হচ্ছে সেরকম না। অনেকে যারা কাজ করছেন তারাও এই সমস্যা (ট্যাগিং), এই চ্যালেঞ্জের শিকার হচ্ছেন। আমরা তো মনে করি যে, ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার। এই তথ্য-প্রবাহটাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তারা জনমত গঠন করতে পারবেন, সেই ন্যারেটিভের মধ্য দিয়ে।
তো, এই যে আমরা যারা ব্যক্তিগতভাবে বা সামষ্টিকভাবে আদিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি, আমাদের তো সেই প্লাটফর্মটা নাই বা মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার কথাটা যদি আমি বলি, তারা তো আমরা কোন কথাগুলো বলতে চাই সেটি কখনো তুলে ধরতে চান না বা পারেন না। এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে যদি আমরা দেখি, এখানে একটা বটবাহিনী আছে, রাষ্ট্রীয় যে প্রপাগান্ডাগুলো আছে, যে নারেটিভগুলো আছে, সেগুলো প্রচার করার জন্য তারা আছেন।
তো, এই তথ্যের অবাধ প্রচার, সেটিকে আমার মনে হয় নিশ্চিত করা দরকার যে, আমরা যে অধিকারের কথা বলছি, মানবাধিকারের কথা বলছি এবং আমরা ডেমোক্রেটিক ভ্যালুর কথা বলছি, ডেমোক্রেটিক প্রিন্সিপালের কথা বলছি, অন্য কোনো কথা বলছি না, এভরিথিং ইজ টু ডু উইথ ডেমোক্রেটিক ভ্যালুস এন্ড প্রিন্সিপালস।
তো, এগুলো যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমি ইয়ান ইয়ান হই, বা আরেকজন যিনি আদিবাসী রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট আছেন, আমাদের সবার উপরেই একই রকমের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, বিভিন্নভাবে তারা করতে পারে, সে কাজগুলো অব্যাহত থাকবে।
বীথি: এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে। পাহাড়ে, আওয়ামী লীগের বেশ ভালো সংখ্যক ভোট ছিল, ডেফিনেটলি তার কারণ ছিল বা এখনো আছে, কিন্তু এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ নাই, এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং আমরা আশা করছি যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে সেখানে বিএনপির একটা ভালো রকমের অংশগ্রহণ থাকবে। নতুন রাজনৈতিক দল আছে, এনসিপি আছে, আরো অনেকগুলো নতুন নতুন দল তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাহাড়ে কোন রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা কতটুকু এবং সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা কার?
ইয়ান ইয়ান: আমি তো আসলে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারছি না এবং যেভাবে প্রতি মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট… (পরিবর্তন হচ্ছে), যে প্রেক্ষাপটের মধ্যে আমরা আছি, কয়েকদিন পরপর নতুন একটি আলোচনা আসছে, পরিস্থিতি অনুকূলে যাচ্ছে আবার প্রতিকূলে যাচ্ছে, সেই হিসেবে আসলে বলাটা কঠিন যে, কারা ক্ষমতায় আসতে পারেন, নির্বাচন হলে। আপনি যে কথাটা বলছেন যে, পাহাড়ে আওয়ামী লীগের স্ট্রং হোল ছিল, সেটা কিন্তু আপনি দেখবেন পুরো বাংলাদেশেই, মাইনোরিটি যারা আছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, এটা তো আসলে মোটামুটি সবাই বিশ্বাস করেন… যদিও আমার মনে হয় সে নিয়ে প্রশ্ন আছে যে, আওয়ামীলীগ সরকার মাত্রই হচ্ছে মাইনোরিটিদের অধিকার নিশ্চিত করার সরকার ছিল… এই কারণেই আওয়ামীলীগকে ভোট দেওয়ার দরকার… কিন্তু গত বছরের অভ্যুত্থানের পর অনেকে আবার বুঝতে পারছেন, অনেকে আবার ফেরত যাচ্ছেন যে, না, আওয়ামীলীগ সরকারই ভালো ছিল মাইনোরিটির জন্য।
আবার অনেকে বলছেন যে, না, আওয়ামীলীগ সরকার থাকার সময়েও মাইনোরিটিরা যে নিপীড়নের শিকার হয়েছে… বর্তমান ইন্টেরিম গভর্মেন্টের সময়েও একই রকমের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তাহলে হয়তো এটা পলিটিক্যাল দলের এন্ডোর্সমেন্টের বিষয় না। এটা হচ্ছে জাস্ট কে কীভাবে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, সেটার রাজনীতি। এখন এনসিপির কথাটা যেহেতু বললেন, নতুন দল হিসেবে আমার মনে হয় যে, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশে তাদের জনসমর্থন আদায় করা খানিকটা কঠিন হবে। কারণ, আমরা গত ৫০ বছর ধরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত পলিটিক্যাল পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তো, এনসিপি যদি গ্রাউন্ডব্রেকিং কোনো কিছু করে দেখাতে না পারে… বরং তারা অনেক বেশি কন্ট্রোভার্সি তৈরি করেছে এর মধ্যে। সেই কন্ট্রোভার্সিগুলো যদি তৈরি করতে থাকে এবং একটুখানি প্রোগ্রেসিভ মাইন্ডের রাজনীতির দিকে না যায় বরং জনতুষ্ঠির রাজনীতি তারা বেছে নেয়, তাহলে আমার মনে হয় না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা আসলে কোনো কিছু করতে পারবে।
বীথি: এই মুহূর্তে আসলে পাহাড়ের রাজনীতিটা কেমন এবং সরকার বদল হলে কি পাহাড়ের কোনো কিছু পরিবর্তন হবে? আপনি কি প্রত্যাশা করেন?
ইয়ান ইয়ান: আমি প্রথমদিকে এই কথাটি বলেছি যে, পাহাড়ের পলিটিক্স হচ্ছে আসলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আধিপত্যবাদের পলিটিক্স। এবং পাহাড়ে যে মিলিটারি শাসন জারি করে রাখা হয়েছে ১৯৭৬ সাল থেকে, সেটা তাদের পলিটিক্স। সেখানে যে সিভিলিয়ান সরকারই আসুক না কেন, পাহাড়ের পলিসি নিয়ে আসলে খুব একটা বেশি পরিবর্তন আমরা দেখি না, আমরা খুব একটা আশাও করি না। এখন ইন্টারিম গভর্মেন্ট এসেছে গত বছর। এরপরও কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত পাহাড়ে যেভাবে নিপীড়ন চলেছে সেটিরও আমরা ধারাবাহিকতা দেখি ইন্টেরিম গভর্মেন্টের সময়। আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিতে পারি— যখন একটা সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে, গত বছরের আগ পর্যন্তও অনেকগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, এবং ইন্টেরিম গভর্মেন্ট আসার পরও, গত বছর সেপ্টেম্বরে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে, যখন এসব সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, আমরা কিন্তু স্ক্রিন বাই স্ক্রিন বলে দিতে পারি, এরপর কী হবে, সরকার কোন ব্যবস্থা নেবে এবং এরপর আমরা বিচার পাব কি পাব না।
সবাই মিলে দল বেঁধে একটা গুজব ছড়ানোর পরে আদিবাসীদের উপর একটা সাম্প্রদায়িক হামলা হবে, আদিবাসীরা হতাহত হবেন, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে, এরপর সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে, তদন্ত কমিটি যে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে সবার সাথে কথা বলছেন সেটা মিডিয়ায় প্রচার করা হবে এবং একদম শেষের দিকে যেটা দেখা যাবে, সে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে একটা সময় বেঁধে দেওয়া হয়, সেই রিপোর্টে কী আছে সেটা আমরা কেউ জানবো না এবং রিপোর্টটি আদৌ প্রডিউস করা হয়েছে কি না সেটাও আমরা জানবো না। এবং এটি সবসময় হয়ে আসছে। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়েছে, বিএনপি সরকারের আমলে হয়েছে এবং বর্তমানে ইন্টেরিম গভর্মেন্টের আমলেও হয়েছে।
তো, সেই আশাটা আসলে করাটা খুব কঠিন, এই যে ন্যারেটিভগুলো আমাদের বিরুদ্ধে জারি রাখা হয়েছে এবং আমরা যে বাংলাদেশের আসলে সেকেন্ড ক্লাস নাগরিক, এই কনসেপ্টটা যদি বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা যদি সেটা বুঝতে না পারেন, একনলেজ করতে না পারেন বা একনলেজ করতে না চান, তাহলে এই ঘটনাগুলো ঘটেই যাবে।
বীথি: পাহাড়ে ইউপিডিএফ-এর মতো আরো বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ রয়েছে। আমি একটু জানতে চাই, এই গ্রুপগুলোর আসলে কাজ কী বা তারা কী চায়।
ইয়ান ইয়ান: পাহাড়ে ইউপিডিএফ তো কেবল একটা গ্রুপ না। পাহাড়ে তো অনেকগুলো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল আছে, দলের মধ্যে বিভেদ তৈরি হওয়ার কারণে বিভিন্ন দলে তারা বিভক্ত হয়ে গেছেন।
অবশ্যই সেই দলগুলোতে যারা আছেন, আমি কেবলমাত্র ইউপিডিএফকে আলাদা করে বলতে চাই না, জেএসএসকে আলাদা করে বলতে চাই না বা কোনো একটি আঞ্চলিক দলের নাম আমি বলতে চাচ্ছি না। তো, প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে এবং প্রত্যেকটি দল কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন জনের সাথে তাদের সেই সম্পর্কগুলো, রাষ্ট্রীয় যে বাহিনীগুলো আছে বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের সাথে অবশ্যই তারা নেগোসিয়েশনের মধ্যে যান। তারা অবশ্যই তাদের সাথে কথাবার্তা বলেন। এখন সিএইচটিতে (চট্টগ্রাম হিলট্রেক্স) যে পরিমাণের ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখা হয়েছে, কোন দল কী চায়, কোন দল কার সাথে কাজ করছে, কোন দল কার ইন্টারেস্ট ফুলফিল করার চেষ্টা করছে, সেটি বোঝা সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে অসম্ভব।
বীথি: আমরা মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতে দেখি, পাহাড়ের ক্ষেত্রে সবসময় বলা হয়, পাহাড়ের সন্ত্রাসী গ্রুপ। আপনি কতটুকু মনে করেন, সঠিক তথ্য আমাদেরকে মেইন স্ট্রিম মিডিয়া দেয়?
ইয়ান ইয়ান: মেইন স্ট্রিম মিডিয়া অনেক অনেক তথ্যই প্রচার করে এবং মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যদি ফ্রি হতো এবং আমাদের সাংবাদিক ভাইবোনেদের যদি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার আগ্রহ থাকতো বা স্কিল থাকতো অথবা যে মিডিয়া হাউসগুলো আছে তারা যদি তাদেরকে সে ইন্সেন্টিভটা দিতো, তাহলে আমার মনে হয় যে, ভেতরের অনেক কথাই আসলে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মাধ্যমে উঠে আসার সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা যেটা দেখেছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে সবসময় যেটা বলা হয় যে, কোট এন্ড আনকোট, উপরের মহল থেকে যা বলা হয় সেগুলো তারা প্রচার করতে বাধ্য থাকেন, এই কারণে আমি বলেছি যে, মিডিয়া যদি ফ্রিলি কাজ করতে না পারে, অবাধ তথ্য যদি না থাকে, তাহলে খুব কঠিন হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কী পরিস্থিতি চলছে, সেটা জানাটা। সবাই আসলে বুঝতে পারবে না যে, কী চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
বীথি: শেষ প্রশ্ন হিসেবে একদম ছোট করে যদি জানতে চাই, পাহাড়ের এই সমস্যা বা সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ কী, বা কীভাবে হতে পারে? আমরা যদি একটা সলিউশন বেজড আলাপ করতে চাই, তাহলে ঠিক কোন কোন ঘটনাগুলো ঘটলে পাহাড়ের এই সংঘাত, পাহাড়ের আদিবাসীদের আদিবাসী বলা থেকে শুরু করে সব ধরনের সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে আপনি মনে করেন।
ইয়ান ইয়ান: ১৯৭৬ সালের পর থেকে যা কিছু হয়েছে আদিবাসীদের উপর, তাতে একটা অনাস্থা, অবিশ্বাস বিদ্বেষ, বাঙালি এবং আদিবাসীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, তো এই অবিশ্বাস, অনাস্থা, বিদ্বেষ থেকে বের হওয়ার জন্য, আমার মনে হয় যে, প্রথমত, যদি আমরা জনমতের কথা বলি, আলোচনার প্রয়োজন আছে। এবং যে আলোচনায় বাঙালিরা কথা বলতে পারবেন এবং একইসাথে আদিবাসীরাও কথা বলতে পারবেন। সেই প্লাটফর্মটা তৈরি করার প্রয়োজন আছে। আবার আদিবাসীরা খুব ফ্রাঙ্কলি যে কথাগুলো বলতে চায়, অনেক কিছু হয় পাহাড়ে, যেটা আমাদের বাঙালি ভাইবোনেরা সম্ভবত জানতে পারেন না সবসময়, কারণ হচ্ছে তাদের কাছে সেই কথাগুলো পৌঁছে দেওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তো সেই আলোচনার রাস্তাটা তৈরি করা দরকার। এবং একইসাথে যারা এই কথাগুলো বলবেন তারা যেন এই কথাগুলো বলার পর কোনোভাবে মব সন্ত্রাসের শিকার না হন। কোনো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের তারা যেন শিকার না হন, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর যদি শিকারও হন, হতেই পারেন, যদি হন, তাহলে যেন একটা নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা থাকে, যেখানে তারা প্রতিকার পেতে পারেন।
এগুলো যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আমার মনে হয় যে, আদিবাসী যারা আছেন, যারা অনেক কথা বলতে চান, যারা অনেক কিছু শেয়ার করতে চান, তারা ফ্রিলি তাদের কথাগুলো সবার সাথে শেয়ার করতে পারবেন। এটি তো কেবল আমি বললাম আস্থার জায়গাটা তৈরি করার জন্য। এই কাজটা আসলে করা দরকার। অনেক প্লাটফর্ম তৈরি করা দরকার যেখানে আমরা ফ্রিলি কথা বলতে পারবো, একজন আরেকজনের সাথে, একপক্ষ আরেক পক্ষের সাথে।
আরেকটি হচ্ছে, অলরেডি যেহেতু আমাদের লিগ্যাল ইনস্ট্রুমেন্টগুলো আছে, আমাদের ল-গুলো আছে, একটা কোড আছে, সিএইচটি কোড, সেটিকে নিয়ে আগানোটা দরকার। যেহেতু একটি আছেই, সেটিকে বাদ দিয়ে নতুন করে শুরু করার তো প্রয়োজনীয়তা নাই। কোথায় এবং কেন এই সিএইচটি কোড কাজ করেনাই, যদি কাজ না করে থাকে তবে ২৭ বছর পর আমরা কীভাবে সেটির ওপর ভিত্তি করে সামন আগাতে পারি, এটির জন্য তো যারা চুক্তির পক্ষে আছেন এবং বিভিন্ন মতাদর্শী যারা আছেন তাদের সবাইকে একসাথে এনে কথা বলার একটা ইনিশিয়েটিভ নিতে হবে। এবং সেই ইনিশিয়েটিভটা আসলে নিতে হবে রাষ্ট্রের, সরকারের। এবং যদি সেটা না নেওয়া হয়, তাহলে এই অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, সেগুলো তো বাড়বেই। কিন্তু একইসাথে যে সমাধানের দিকে আমরা আগাতে চাই সেই সমাধানে আমরা কখনোই আগাতে পারবো না।
বীথি: ধন্যবাদ রানী ইয়ান ইয়ান, আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আজকে করেছি এবং আশা করছি আপনার মাধ্যমে আমরা দর্শকদের কাছে পাহাড় এবং আদিবাসী সম্পর্কে ধারণাগুলো কিছুটা হলেও দিতে পেরেছি। ভালো থাকবেন এবং সুস্থ থাকবেন।
ইয়ান ইয়ান: ধন্যবাদ আপনাকেও।●