এনএসআই ও ডিজিএফআই-এর অনাপত্তিতে আবদুল হামিদের বিদেশযাত্রা: নথি

সাবেক রাষ্ট্রপতিকে দেশত্যাগের সুযোগ দেয়ায় বিক্ষোভ

এনএসআই ও ডিজিএফআই-এর অনাপত্তিতে আবদুল হামিদের বিদেশযাত্রা: নথি

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগের সময় অভিবাসন পুলিশের আগেই ‘অনাপত্তি’ জানিয়েছিল জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)। তবে এই ঘটনার জেরে সরকার মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।  

এই ঘটনায় অভিবাসন পুলিশের করা সাধারণ ডায়েরির একটি অনুলিপি নেত্র নিউজের কাছে এসেছে। লিখিত ওই নথি অনুযায়ী, হামিদ ও তার দুই আত্মীয়ের বিদেশ যাত্রার আগে সহকারি পরিচালক পদমর্যাদার একজন এনএসআই কর্মকর্তা ও ডিজিএফআইতে কর্মরত একজন উইং কমান্ডার অনাপত্তি প্রদান করেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমান বন্দরে নিযুক্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেন, “চিকিৎসার জন্য ব্যাংককগামী যাত্রী হিসেবে আবদুল হামিদ বুধবার (৭ মে) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন।”

“আওয়ামী লীগের এই নেতার সম্পর্কে ইমিগ্রেশন ডাটাবেইজে কোনো বিরূপ তথ্যও ছিল না। তবু তাৎক্ষণিকভাবে এনএসআই ও ডিজেএফআই কর্মকর্তাদের খবরটি জানায় ইমিগ্রেশন পুলিশ,” যোগ করেন তিনি।

অনুরোধের প্রেক্ষিতে দুইজন ডিজিএফআই ও এনএসআই কর্মকর্তা অনাপত্তি প্রদান করেন। তাদের অনাপত্তির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা ছিল ওই সরকারি নথিতে। 

নথিতে বলা হয়, “TG340 বিমানে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যাংককামী যাত্রী MD ABDUL HAMID, PP NO-D******** (FORMER PRESIDENT), ভিআইপি টার্মিনালে আসলে টার্মিনাল ইনচার্জ ওসি ইমিগ্রেশন আলফা-১১ স্যারকে অবগত করেন।” 

আলফা-১১ একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সাংকেতিক নাম। 

নথিতে এরপর বলা হয়, “আলফা-১১ স্যার এনএসআই ও ডিজিএফআইকে অবগত করেন। এনএসআই এর সহকারী পরিচালক ****** ** (01817-******) ও ডিজিএফআই এর উইং কমান্ডার **** (01730-******) অনাপত্তি প্রদান করেন।” 

জাতীয় নিরাপত্তায় সম্পৃক্ত ওই দুই কর্মকর্তার নাম ও পরিচয় নেত্র নিউজ গোপন রাখছে।

সরকারি নথিতে আরও বলা হয়, এনএসআই ও ডিজিএফআই থেকে প্রাপ্ত অনাপত্তির বিষয়ে অভিবাসন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ইমিগ্রেশন) তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। 

এরপর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশের প্রেক্ষিতে আব্দুল হামিদ, তার পুত্র রিয়াদ আহমেদ ও তার শ্যালক এএনএম নওশাদ খানের অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

কিন্তু দুইটি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তারা সবাই মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর রাতে পৌনে আটটার দিকে এক ক্ষুদেবার্তায় সাংবাদিকদের জানান, আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। 

সাবেক এই রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের বিশেষ শাখার আরেক কর্মকর্তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি,  কিশোরগঞ্জ জেলার এসপিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে রাত নয়টায় পৃথক বার্তায় জানান এআইজি ইনামুল।

আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন)-কে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ঘটনার সময় ভিআইপি টার্মিনালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, ইমিগ্রেশন) ছিলেন তাহসিনা আরিফ নামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করে নেয়া ওই কর্মকর্তার কাছে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে মুঠোফোনে ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

প্রতিক্রিয়ায় যা ঘটছে

আব্দুল হামিদ ১৯৫৯ সালে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে তিনি পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

২০০১ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি সংসদের স্পিকার ছিলেন। এরপর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি ফের এই দায়িত্ব পান।

২০১৩ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপর একটানা ১০ বছর তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকে ২০২৩ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। এর পর থেকে রাজনীতির বাইরেই ছিলেন ৮১ বছর বয়সী হামিদ। 

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে অন্যান্য কিছু প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতার মতোই তাকে গ্রেপ্তার করা থেকে বিরত থাকে সরকার। 

এবার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ ছেড়ে যেতে দেয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে  জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভে অংশ নেয়া ছাত্রদের কয়েকটি সংগঠন।

এর আগে আরও কিছু আওয়ামী লীগ নেতা দেশ ছাড়তে সক্ষম হন। এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন ওই সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।

এবার তাদের কড়া প্রতিক্রিয়ার মুখে তৎপর হয়ে উঠে সরকার।

ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোসহ বাংলাদেশের একাধিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, দিনাজপুরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আবদুল হামিদের দেশত্যাগে সহায়তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। 

তাদের শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে তিনি দায়িত্বে থাকবেন না বলেও ঘোষণা দেন উপদেষ্টা। 

এদিকে বিদেশ থেকে আবদুল হামিদকে ফিরিয়ে আনতে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে গণ অধিকার পরিষদ। 

জুলাই আন্দোলনের সময় তরুণদের নেতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফেসবুকে লিখেছেন, “অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারের রাষ্ট্রপতিকে চোখের সামনে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। বিচার প্রশ্নে সরকারের প্রতি আমাদের অনাস্থার যায়গা তৈরি হইছে।”

এরই ধারাবািকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রীয় বাসভবনের সামনে মাঝরাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীরা। তারা গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।●

(সম্পাদকীয় নোট: আলোচ্য নথিটি সরকারি কোনো গোপন নথি নয়। এটি ছিল ঘটনার বিবরণ সম্বলিত ইমিগ্রেশন পুলিশের সাধারণ ডায়েরির অনুলিপি। হামিদ অভিবাসন বৈতরণী পার হওয়ার সময় ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছিল পুলিশ। দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে এই সংক্রান্ত সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে।)