বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের পিছু লাগা ব্রিটিশ জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এখন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র

পালাটাইন মিডিয়া এখনো পৃষ্ঠপোষকদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের পিছু লাগা ব্রিটিশ জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এখন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্পর্কে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে লন্ডনের আইনপ্রণেতাদের নজরে আসা একটি ব্রিটিশ জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

গত মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে ভুয়া পরিচয়ে লেখা একাধিক ব্লগ পোস্ট ব্রিটিশ এমপিদের কাছে পাঠানোর পর পালাটাইন মিডিয়া নামে ওই প্রতিষ্ঠান আলোচনায় আসে। সেসব পোস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কন্যার কথিত অঘোষিত সম্পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। মনসুরের সঙ্গে একটি নির্ধারিত বৈঠকের ঠিক আগে আগে চালানো ওই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হন ব্রিটিশ সর্বদলীয় এমপিদের একটি দল।

“রেসপন্সিবল ট্যাক্স অ্যান্ড করাপশন” বিষয়ক এই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই শক্তিশালী সর্বদলীয় মোর্চা পরে এই ঘটনায় আলাদা দুটি সংসদীয় সংস্থার কাছে অভিযোগ জানায় বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। 

তখন নেত্র নিউজ ও গার্ডিয়ানের প্রশ্নের জবাবে পালাটাইন মিডিয়া জানায়নি কার অর্থায়নে এ প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি নেত্র নিউজ–এর হাতে আসা চিঠিপত্রের অনুলিপিতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি এখন সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছে।

“আপনি আওয়ামী লীগের যেসব ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, দয়া করে নিচের বক্তব্যটিকে তাদের সম্মিলিত জবাব হিসেবে গ্রহণ করুন,” একটি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমকে প্রত্যুত্তরে লিখেছেন পালাটাইনের প্রধান নির্বাহী কোনাল ওয়ালশ।

নেত্র নিউজের হাতে আসা তাঁর প্রত্যুত্তরের অনুলিপিতে আরও দেখা যায়, ওয়ালশ নিজেকে “শেখ হাসিনা এবং তাঁর নিকটস্থ পরিমণ্ডল ও পরিবারের সদস্যদের” পক্ষে মুখপাত্র হিসেবে কথা বলছেন।

শেখ হাসিনার পক্ষে দেয়া ওই প্রত্যুত্তরের অংশবিশেষ পরে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যবহৃত হয়।

সম্প্রতি নেত্র নিউজকে দেওয়া বিবৃতিতে ওয়ালশ স্বীকার করেন যে, পালাটাইন মিডিয়া এখন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, মনসুরের বিরুদ্ধে ব্লগপোস্ট ছড়ানোর সময় তারা দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছিল না। “সেই সময় আমরা আওয়ামী লীগের মিডিয়া মুখপাত্র ছিলাম না,” বলেন তিনি।

ভুয়া পরিচয়ে লেখা প্রবন্ধ ব্রিটিশ এমপিদের কাছে পাঠিয়েছিল পালাটাইন মিডিয়া। প্রবন্ধগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুরকে লক্ষ্য করে অভিযোগ আনা হয়েছিল। | ছবি: luxstorm (pixabay.com)

স্বার্থের মিল

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা, এমনকি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ছেলে ও প্রধান উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদও, অনলাইনে ওই মনসুরবিরোধী পোস্টগুলো শেয়ার করেছিলেন।

আইএমএফ–এর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ থেকে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা বিদেশে, এমনকি ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সাধারণত রাজনৈতিক টার্গেট হন না। তাহলে কেন আহসান মনসুর আওয়ামী লীগের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের ঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ীদের স্বার্থের সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্বার্থ এখানে মিলে গিয়েছিল। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন,  “এটা নিছক এক কূৎসামূলক প্রচারণা হলেও, এর উদ্দেশ্য ছিল ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ করা। অর্থ পাচারে সহায়ক চক্রের সঙ্গে এই জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

আওয়ামী লীগের সঙ্গে পালাটাইনের বর্তমান সম্পর্ক এবং মনসুরবিরোধী আগের কার্যকলাপের মধ্যে যোগসূত্র আছে কি না, তা পালাটাইন মিডিয়া স্পষ্ট করতে রাজি নয়। তবে দুই কার্যক্রমের মধ্যে কিছু মিল পাওয়া যায়।

ব্রিটিশ এমপিদের পাঠানো আগের ইমেইলগুলোতে পালাটাইন মিডিয়া টিউলিপ সিদ্দিককেও রক্ষার চেষ্টা করে— তারা লেখে যে মনসুর নাকি তার সততার ওপর আঘাত হানতে চাইছেন।

দলের সভাপতির ভাতিজি ও লেবার এমপি টিউলিপ একসময় নিজেকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি এখন বাংলাদেশে একাধিক দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি। তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও, অভিযোগের জেরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সরকার থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

পালাটাইন মিডিয়া বলছে, তাদের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের যোগাযোগ কখনও হয়নি। তবে তারা এটিও বলতে চাইছে না — কে তাদের আওয়ামী লীগের কাজের জন্য অর্থ দিচ্ছে বা আগের মনসুরবিরোধী প্রচারণার খরচ বহন করেছিল। 

প্রতিষ্ঠানটির দাবি, “যেকোনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতো, আমরা বাণিজ্যিক ও গ্রাহকের গোপনীয়তার কারণে চুক্তি সংক্রান্ত বিষয়াদি প্রকাশ করি না।”

তবে এ ধরনের গোপনীয়তা ব্রিটিশ চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পাবলিক রিলেশন্স–এর আচরণবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানাতে হবে কার স্বার্থে তারা লবিং করছে এবং তাদের গ্রাহক কারা।

পালাটাইন মিডিয়া যুক্তি দিচ্ছে, তারা “লবিস্ট” নয়। অথচ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট লবিংয়ের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তার মধ্যে চিঠি বা ইমেইল পাঠানোও পড়ে।

ব্রিটিশ দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা স্পটলাইট অন করাপশন–এর উপদেষ্টা অ্যালেক্স বিটি বলেন, যুক্তরাজ্যের দুর্বল নীতিমালা এমন গোপন কার্যক্রমকে সম্ভব করেছে। তিনি বলেন, “রেপুটেশন ম্যানেজমেন্টে যুক্ত হলে পিআর প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে আচরণ করবে তা নিয়ে যুক্তরাজ্যে কোনো নিয়ম নেই, এবং আচরণবিধি মেনে চলা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।”

তার মতে, বাংলাদেশ সম্পর্কে পালাটাইন মিডিয়ার কর্মকাণ্ড “গুরুতর প্রশ্ন তোলে, কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলো যতসামান্য তদারকির মধ্যেই যুক্তরাজ্যের শীর্ষ পিআর ফার্মগুলোকে কাজে লাগাতে পারে।”

আরও লবিং প্রচেষ্টা

আওয়ামী লীগের আইনি ও লবিং কার্যক্রম পালাটাইন মিডিয়াতে সীমাবদ্ধ নয়।

অ্যাটলান্টিকের ওপারে ওয়াশিংটন ডিসিতে, মায়ের পতনের এক মাসের মধ্যেই সজীব ওয়াজেদ দ্রুত একটি প্রভাবশালী লবিং ফার্ম ভাড়া করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যেটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি অগ্রিম ২ লাখ ডলারও পরিশোধ করেন।

প্যালাটাইন কমিউনিকেশনস

ধরন: জনসংযোগ ও লবিং প্রতিষ্ঠান

চুক্তির সময়কাল: সেপ্টেম্বর ২০২৫ (আনুমানিক)

অর্থায়নে: অজানা

অবস্থান: লন্ডন, যুক্তরাজ্য

ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্স

ধরন: আইন সংস্থা

চুক্তির সময়কাল: মার্চ ২০২৫ (আনুমানিক)

অর্থায়নে: অজানা

অবস্থান: লন্ডন, যুক্তরাজ্য

স্ট্রাইক গ্লোবাল ডিপ্লোমেসি

ধরন: লবিং প্রতিষ্ঠান

চুক্তির সময়কাল: সেপ্টেম্বর ২০২৪

অর্থায়নে: ওয়াজেদ কনসাল্টিং ইনক.

অবস্থান: ওয়াশিংটন, ডি.সি., যুক্তরাষ্ট্র

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের জ্ঞাত বিদেশি লবিং প্রচেষ্টা

ব্রিটেনের অন্যতম শীর্ষ মানবাধিকার ফার্ম ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্স–এ ব্যারিস্টার স্টিভেন পাউলস কেসি ও অ্যালেক্স টিনসলে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোতে আবেদন দাখিল করেছেন এই দাবি করে যে, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ কার্যত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে।

ঢাকা পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, তাদের কার্যক্রম কেবল স্থগিত করা হয়েছে, যতক্ষণ না শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা নিষ্পত্তি হয়। যে অভিযোগ জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানও তুলেছেন।

এর আগে একই আইনজীবীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও (আইসিসি) অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন সেই একই অপরাধের দায়ে, যা মূলত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই রয়েছে।

নেত্র নিউজ প্রতিষ্ঠানটির কাছে জানতে চেয়েছিল, কে তাদের বাংলাদেশ–সংক্রান্ত কাজের অর্থ দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের আলাদা একজন মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। ●