আপনার ধর্মবোধের দায় অন্যের ওপর চাপাবেন না
ধর্মের শুদ্ধাশুদ্ধতার লড়াই চলছে। কে ঠিক, কে ভুল– এ বিচার করছে মানুষ। একদল উগ্রবাদী ধার্মিক গিয়ে ভাঙছে মাজার-দরগাহ। ধর্মীয় সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে চালানো হচ্ছে মব।

এক যুদ্ধে রাসুল একদল সাহাবিকে বনু কুরায়জাতে পাঠাতে গিয়ে বললেন, “বনু কুরায়জাতে পৌঁছে আসর নামাজ পড়বে।” সাহাবারা সে মতে চললেন। পথেই আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে তাদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে যায়। একদল বললেন, “রাসুলের সেই কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যাতে জলদি যাই, এতটাই জলদি যে আসর যেন সেখানে পড়া যায়। আর যদি তা না হয়, তাহলে আসর সময়মতোই আদায় করতে হবে।”
অন্যদলের বক্তব্য ছিল, “রাসুল বলছেন, সেখানে গিয়ে নামাজ পড়তে, এর আর কোন ব্যাখ্যা থাকবে না, আমরা সেখানে গিয়েই নামাজ পড়ব”।
দুটো দল হয়ে গেল। একদল ওয়াক্ত যেখানে হলো সেখানেই নামাজ পড়ে রওনা করলেন ময়দানের দিকে। অন্যদল ময়দানে গিয়ে নামাজ কাজা করলো।
যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দুটো দলই রাসুলকে ঘটনাটা জানালেন। রাসুল শুনলেন কেবল, কোন দলকেই বললেন না, “তোমরা ঠিক করেছো, তোমরা ভুল।”
মদিনায় খেজুরের পরাগায়ন একভাবে হতো। সেটা দেখে রাসুল সে পদ্ধতিতে পরাগায়ন না করতে বললেন। সাহাবারা তাঁর কথামতো সে বছর ওই পদ্ধতিতে পরাগায়ন করলেন না। এতে ফলন কম হলো। এরপর নবী বললেন, আমি ধর্ম বিষয়ে যা বলি, তা গ্রহণ করো। দুনিয়াবি বিষয়ে আমি কেবলই একজন মানুষ।
একবার ঈদের দিন আয়েশার ঘরে দুটো কিশোরী গান করছিলো। আবু বকর এসে বললেন, রাসুলের ঘরে শয়তানের বাঁশি বাজছে? রাসুল বললেন, আজকে ঈদের দিন, গাইতে দাও ওদের।
২.
হাদিস থেকে অর্থ বের করার যে ক’টি পদ্ধতি আছে, তার একটি হচ্ছে দালায়েলুন নাস, বা টেক্সটের ইঙ্গিত। পয়লা হাদিসের ইঙ্গিত হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যকার মতামতগত ভিন্নতা থাকবে। সেই ভিন্নতা নামাজের মত ইবাদাতকে কাজা করার পর্যায়েও চলে যাবে। তবুও এই ভিন্নতা উদযাপিত হবে, কাউকেই সঠিক বা বেঠিক বলা হবে না। তার কাজের জন্য উৎসাহিত বা অনুৎসাহিতও করা হবে না।
দ্বিতীয় আর তৃতীয় হাদিসের ইঙ্গিত হলো, প্রতিটি অঞ্চলের কালচার, সংস্কৃতি এবং আনন্দ আয়োজন থাকবে, সেই আনন্দ আয়োজন কখনও আপনার কাছে “শয়তানের বাঁশির” মত মনে হলেও আপনার কিছু বলার অধিকার নেই। রাসুল তার পয়লা খলিফা আবু বকরকেই সেই অধিকার দেননি। বাকি জনগণ তো পড়েই রইলো। একই সাথে বোঝা যায়, যেখানে স্বয়ং শাসক আছেন, সেখানে ধর্ম রক্ষার কোনো দায় আপনার হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই।
৩.
আমাদের বাংলাদেশের মুসলমানদের এই মুহূর্তে যে সংকটগুলো চলছে, তার অন্যতম হচ্ছে সালাফি/দেওবন্দিদের সাথে পীর ঘারানার লোকদের দ্বন্দ। সালাফিরা মনে করছেন, মাজার, পীর, পীরের কাছে মানত, এসব ইসলাম সম্মত নয়, বরং ইসলামী বোধের বাইরে। সেখানে অনৈসলামিক কাজ হয়।
আর পীর ঘারানার লোকেরা বিশ্বাস করেন, মাজার, পীর, মানত এসব তাদেরকে খোদা পাইয়ে দেওয়ার একটা তরিকা। তারা মনে করেন, যে মানুষটি আল্লাহকে পেয়ে গেছেন, সেই মানুষটির হাত ধরে, দল ধরে আমরা পার পেয়ে যাব, কিংবা আমার মুশকিলটাও আসান হয়ে যাবে। সেই মুশকিল আসানের জন্যই তারা পীরের দরগাহে যান, মানত করেন।
আর এই ধারনার পেছনেও একটা বড় মনস্তত্ত্ব আছে। এই অঞ্চলের মানুষেরা তো দুইভাবে মুসলমান হয়েছেন। কেউ কেউ ইরান-তুরান, ইয়েমেন আর আরব মুল্লক থেকে এসে এই অঞ্চলে বসতি করেছেন, বিয়ে থা করে জমিয়ে সংসার ও ধর্মচর্চা করেছেন। আর অন্য দল হলেন তারা, যারা এই অঞ্চলেই ছিলেন, ধর্মান্তরিত হয়েছেন। এই ধর্মান্তরিত মুসলমানদের একটা বড় অংশই সেই সময়ে “নিচু” গোত্রের হিন্দু, যারা মানুষের নিদেন মর্যাদাটুকুও পেতেন না। মুসলমান হয়ে সেই মর্যাদা পেয়েছেন। তারা মনে করতেন, এই মর্যাদাপ্রাপ্তির পেছনে পীরদের একটা বড় রকমের হাত আছে। মনে করতেন, তারা আগেও যেমন কোনো প্রয়োজনে বড় জাতের শরণাপন্ন হতেন, কারোর অধীনস্ত হতেন, আল্লাহকে পেতে গেলে তেমনই পীরের অধীনস্ত হতে হবে, তার দলে যোগ দিতে হবে।
এই ভাবনাটা যেমন তাদের স্বস্তি দিতো, একইসঙ্গে তাদের শক্তি দিতো, ক্ষমতা দিতো। সেই ধারাবাহিকতাই চলে আসছে পীর-মাজার-খানকায় ভক্তি ও মানতের কালচার।
আমি পীরদের নিয়ে একটা কাজ করছি। সেই কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, পুরান ঢাকার যেসব খানকা আছে, সেই খানকার পীরদের মুরিদরাও দুই তিন প্রজন্ম ধরেই মুরিদ। দাদা আসতেন কোনো দরবারে, তারপর বাবা এসেছেন, এখন তিনি আসেন।
৪.
মাজার-খানকা আমাদের মধ্যে যে পরিমাণ কমিউনিটি বোধ তৈরি করে, সেই বোধটা অন্য কোথাও খুব একটা তৈরি করে না। প্রতিটা মাজার, খানকা একেকটা কমিউনিটি। মাজারের মুরিদরা পরস্পরের পীর ভাই। এই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের যুগে আপনি যখন একা হয়ে যেতে থাকেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকেন, খানকা আপনাকে জুড়ে দেবে মানুষের সঙ্গে, জুড়ে দেবে কমিউনিটির সঙ্গে। আপনি আর একা হয়ে যাবেন না। আপনি থাকবেন একটা দলের মধ্যে, মানুষের মধ্যে। মানুষ যখনই একা হয়ে যায় তখন তাকে ঘিরে ধরে বিচ্ছিন্নতাবোধ। সেখান থেকে জন্ম নেয় হতাশা ও দুঃখবোধ।
মাজার-খানকা এভাবে কমিউনিটি বোধকে শক্ত করতেই নানা সময়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে মুরিদরা সবাই মিলে আসেন, নিজেদের কান্না শেয়ার করেন, সুখ ভাগ করে নেন। গোটা ব্যবস্থাটাই একটা পরিবারের মতো। সেখানে কারোর মানসিক সাহায্য লাগলে পীরকে বলেন। আর্থিক সাহায্য লাগলে পীরকে বলেন। পীর সেসবের দায়িত্ব নেন। কারোর বিয়ে না হলে বিয়েও করিয়ে দেন পীর।
৫.
ধর্মীয় নানা চিন্তাও কখনো কখনো রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। ধর্মের সেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও কখনও কখনও ভিন্ন চিন্তাকে দমন করতে চায় শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। এসব নির্ধারিত চিন্তার মানুষেরা, যেমন সালাফিরা মনেই করেন, অন্য চিন্তার মানুষেরা কম শুদ্ধ। এবং এই শুদ্ধতাকেই তারা বাইনারি ভাবেন। ভেবে নেন, এর বাইরের সবাই ভুল। অথচ রাসুল নিজেই শুদ্ধাশুদ্ধতার বাইনারিতে যাননি। ধর্মের নানা চিন্তা ও চর্চাকে খারিজ করেননি। সালাফি বাদে অন্যান্য চিন্তার লোকেদেরও এই বাইনারিতে সবকিছু দেখার রোগ আছে। সালাফিরা যেমন ভাবেন, তাঁরা বাদে বাকিরা ভুল তেমনি দেওবন্দীরা ভাবেন, কেবল তাঁরাই সঠিক। আর পীরপন্থায় যাঁরা চিন্তা ও চর্চা করেন, তারাও মনে করেন, সঠিকতা কেবল তাদেরই পক্ষে। ফলে, আপনি যখন আপনার চিন্তাকে রাজনৈতিক মোড়ক দিতে চাইবেন, তখন অন্য চিন্তার বিরুদ্ধে আপনার অবস্থান থাকবে যুদ্ধাংদেহী। হচ্ছেও তাই। মাজার ভাঙার একটা অন্যতম কারণ এই ধর্মের ভেতরকার শুদ্ধতার রাজনীতি।
৬.
মাজার-খানকা কেন্দ্রিক নানা অপরাধ হয় বলে অনেকে দাবি করেন। অপরাধ যে একেবারে হয় না, তা নয়। নানাক্ষেত্রেই দেখা যায় পীরেরা ধর্মের নামে নানাকিছু চাপিয়ে দেন। মুরিদদের থেকে টাকা-পয়সা লোপাট করেন। অনেকেই নারীদের ওপর চড়াও হন। কিন্তু তাই বলে তো মাজারপন্থাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না বা মাজার ভাঙা কোনো দাওয়াইও না। বরং সেই পীরকেই বিচারিক কাঠামোতে নিয়ে আসা জরুরি। আপনি যখনই এরকম একজনের দায়কে সবার ওপর চাপিয়ে দেবেন, তাতে একটা জুলুমের সংস্কৃতি তৈরি হবে।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালু উপন্যাস যা করেছে। সেই উপন্যাসের ন্যারেটিভ এই দেশের মাজারপন্থীদের ওপর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করেছে। সেই নেতিবাচকতার কারণে এই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ কখনও মাজারকে স্বীকার করেনি এবং মাজারের প্রয়োজনীয়তাকে অনুভবও করেনি। ফলে, মাজার ভাঙার বিরুদ্ধে একটা বড় সময়ে কোনো ধরনের কোনো প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি। এখন এই সময়ে এসে মাজার ভাঙা হলে আগে মাজারের প্রয়োজনীয়তা বলে নিতে হচ্ছে মধ্যবিত্তের কাছে। বলতে হচ্ছে, এরা সেই লালসালু নয়, এরা ভণ্ড নয়। বরং এরা ভালো পীর, ভালো মাজার।
৭.
৫ আগস্টের পর থেকেই মাজারে হামলা হচ্ছে। ধর্মের নানা ব্যাখ্যাকে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো করে গ্রহণ করছেন না, তারা শিকার হচ্ছেন হয়রানির। নানা জায়গায় ভাংচুর হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানুষের জান-মাল, ইজ্জত, আব্রু। অথচ সরকার কোনো দায় নিচ্ছে না। বরং কোনো না কোনোভাবে এসবের বৈধতা উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদন করছেন আমাদের চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীরাই। আলেম-উলামারাও সরাসরি কোনো বিরোধিতা করছেন না এসব ভাঙচুরের। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন সব কথা বলছেন, তাতে ভাঙচুরকে উৎসাহিত করছে।
একইসঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কখনো মাজার ভাঙার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠায়নি। ফলে মাজার কখনো এমন মানুষের কনসার্নের বিষয় হয়ে ওঠেনি, যাদের মধ্যে কনসার্ন তৈরি হলে মাজার ভাঙা এভাবে বৈধতা পেতো না। মাজার ভাঙা বন্ধ হতে পারতো।
এই লেখার প্রথম দিকের হাদিসের ইঙ্গিত আমাদের বোঝায়, মানুষকে কখনো কোনোভাবে ধর্মীয় ভিন্নমতের ওপর আঘাত করার অধিকার দেওয়া হয়নি। বরং তাদের সমস্ত মতের ওপর সম্মান করতে শেখানো হয়েছে। সেটা তার মতের ঠিক বিপরীত কোনো মত হলেও। সত্যাসত্য নির্ণয়ের ভার আল্লাহ নিয়েছেন। সত্যাসত্যের বিচার স্বয়ং আল্লাহই করবেন কেয়ামতের দিন।
৮.
ধর্মের চিন্তা ফ্রেমের বাইরে গিয়ে দেখলেও আমরা ভুল করছি অনেক বেশি, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ভুল করছেন। ভুল করছেন রাজনীতিবিদরাও। ভুল করছেন হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের মন পাওয়ার জন্য। তারা মনে করছেন, এই নতুন সময়ে এসে তারা ক্ষমতায় যাবেন তাদের ভোটে কিংবা সমর্থনে। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠের মন কিন্তু ধ্রুব কিছু না। বরং যে কোনো সময়ে যে কারোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের অহম সত্যাসত্য কিংবা নীতিবোধ রহিত করে দেয়। অন্ধ করে দেয়। আর সেই অন্ধতা থেকে যখনই আপনি চোখ খুলবেন এবং অনেক কিছু মানতে পারবেন না, তখন আপনিই সেই অন্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তখন তো আপনিও সংখ্যাগরিষ্ঠের রোষের মুখে পড়বেন, ভাংচুরের শিকার হবেন। লোকে আপনাকেও নাকচ করে দেবে।
তবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠের বোধকে কমিউনিটি বোধের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না যেন। কমিউনিটি বোধের মধ্যে সমানূভুতি থাকে, সংখ্যাগরিষ্ঠের বোধে তা থাকে না। কমিউনিটি তার ভেতরকার প্রত্যেক সদস্যকে অনুমোদন করে, সমর্থন করে এবং রক্ষা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠরা তা করে না। বরং তারা সংখ্যালঘুকে মাড়িয়ে চলে যায়।
তাছাড়া দেখুন, অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে জনগণ, তারা হাসিনাকে নামিয়েছে, নামিয়ে নতুন সরকার বসিয়েছে। কাজ তো এখন সেই সরকারের। সরকার প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে, কোনোভাবেই হাসিনা হয়ে উঠবে না, কাউকে হাসিনা হয়ে উঠতেও দেবে না। কিন্তু তা বাদ দিয়ে এই সরকার কেন যেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই কেবল মূল্য দিচ্ছে, লোকরঞ্জনবাদী হয়ে উঠছে। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ভিন্নমতের মানুষেরা। অভ্যুত্থানের সরকার কেন যেন প্রতিটি নাগরিকের অভিভাবক হয়ে ওঠার দায় নিতে পারছে না কিংবা সাহসটা দেখাতে পারছে না। এটা হতাশাজনক।●
তথ্যসূত্র:
[১] সহিহ বুখারি (সংখ্যা: ৯৪৬, ৪১১৯, ৭৩৫১) সহিহ মুসলিম (সংখ্যা: ১৭৭০)
[২] সহিহ মুসলিম (সংখ্যা: ২৩৬১) সুনান ইবনে মাজাহ (সংখ্যা: ২৪৭০) মুসনাদ আহমাদ (সংখ্যা: ১৩৯৫৩, ১৩৯৫৪)
[৩] সুনান ইবনে মাজাহ (সংখ্যা: ২১৪২)
মীর হুযাইফা আল মামদূহ — ইসলাম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক।