রোহিঙ্গাদের জন্য অস্পষ্ট মানবিক শব্দচয়ন ছাড়া বাস্তব প্রতিশ্রুতি জুটছে না
দুনিয়ার বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো নাটকীয় ঘোষণা দিলেও সেই নাটককে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের নেতারা শরণার্থীদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

“রোহিঙ্গা সংকটের সূচনা মিয়ানমারে, সুতরাং এর সমাধানও মিয়ানমারেই।”
“রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমার থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। আর এর সমাধানও মিয়ানমারেই নিহিত।”
প্রথম উক্তিটি শেখ হাসিনার, ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণ থেকে উদ্ধৃত। দ্বিতীয়টি মুহাম্মদ ইউনূসের, ২০২৫ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি কথাগুলো বলেন। সেই ভাষণের শুরুতেই ইউনুস হাসিনাকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে উল্লেখ করেন। সম্ভবত হাসিনার বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করার ঝুঁকির ব্যাপারটা মাথায় নিয়েই ইউনুসের সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার মাধ্যেমে হাসিনার এসব বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।
হাসিনা নিজেকে মানবতার মা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন আর তার স্তাবকেরা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তার ভূমিকাকে কেন্দ্র করে এই দাবি অক্লান্তভাবে পুনরাবৃত্তি করেছে। মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যার শিকারদের আশ্রয় দিয়ে তিনি মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিলেন। ব্যাপারটি ছিল তার আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এক ধরনের আবরণ, যে সরকার দেশে ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছিল। এ কারণেই মিয়ানমারে শান্তির পথ খুঁজে বের করা ও রোহিঙ্গাদের নিরাপদে নিজভূমিতে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার আহ্বান জানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চাইতে হাসিনা কখনো দ্বিধা করতেন না।
রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ও গণহত্যার অষ্টম বার্ষিকীতে দেওয়া ইউনূসের ভাষণও একই বক্তব্যে পূর্ণ ছিল। তার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল হাসিনার মতোই একথা পুনরাবৃত্তি করা যে, এই দরিদ্র দেশ, যেটি নিজ সমস্যায় ও জনগণের চাপে জর্জরিত, তারা কেবলই বিশ্বের কাছে ভিক্ষা চাইতে পারে শরণার্থীদের জন্য; অথচ শরণার্থীদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ, বৈষম্যমূলক ও বর্জনশীল মনোভাব পোষণ করে তাদের রাষ্ট্র। সংহতির কিছু মিষ্টি কথা ও “প্রতীকী রোজা”র উল্লেখ থাকলেও, বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তার ভাষণে কোনো বাস্তব প্রতিশ্রুতি ছিল না।
আট বছর পর, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি সংকট রয়ে গেছে। প্রথমত, মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা। দ্বিতীয়ত, শরণার্থীদের পরিস্থিতি। কেবল একটি বেসামরিক সরকারই উভয়ের সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে পারে। কিন্তু হাসিনা থেকে ইউনূস— সবাই শুধু প্রথম সংকটের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, দ্বিতীয়টির দায় এড়িয়ে যায়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের সুপারিশ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, কিংবা শরণার্থীদের বিষয়ে কোনো অভ্যন্তরীণ আইনও প্রণয়ন করেনি। যদিও সুপ্রিম কোর্ট আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের নন-রিফাউলমেন্ট নীতি স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু এই সামান্য পদক্ষেপ শরণার্থীরা মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য মোটেই যথেষ্ঠ নয়। যখন রাষ্ট্র নিজের সীমানার ভেতরে থাকা মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে এত প্রকাশ্যে অস্বীকৃতি জানায়, তখন সুযোগসন্ধানী ও দুষ্টচক্রেরা সেই শূন্যতা পূরণ করে, আর শিকাররা আরও ভুক্তভোগী হয়। বঞ্চিত হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকা ও স্বাভাবিক জীবনের সামান্য সুযোগ থেকেও।
একদিকে চীনের মতো এক পরাশক্তি, যার রোহিঙ্গাদের রক্ষায় কোনো আগ্রহ নেই অন্যদিকে ভারতের মতো এক আঞ্চলিক পরাশক্তি, যে দেশটিও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং প্রায় সব আসিয়ান সদস্যের মতো কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী নয়। উপরন্তু ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বাংলাদেশিদের “উইপোকা” ও “অনুপ্রবেশকারী” বলে আখ্যা দেয়। এই দুই শক্তির মাঝে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে থাকা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুরাবস্থা সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তার পূর্বসূরীর মতোই এ বিষয়টি তার এজেন্ডা তথা আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে অনাগ্রহী প্রমাণ করেছে। আওয়ামী লীগের মতো, তারা কেবল অস্পষ্ট মানবিক শব্দচয়ন করছে, কিন্তু কার্যকর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। ইউনূস তার ভাষণে বলেছিলেন, “যদি রাখাইনে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়, তবে তা হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল।” কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিটি রোহিঙ্গার জীবনের কী হবে?●