ঔপনিবেশিক আইনে আটকা নারীর যৌনতা

বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে যৌনকর্ম একটি পিতৃতান্ত্রিক ধারণা যা নারীকে অসহায়, দুর্বল ও যৌন কর্তাসত্তাহীন প্রতিপন্ন করতে চায়।

ঔপনিবেশিক আইনে আটকা নারীর যৌনতা
কৃতজ্ঞতা: পেপার জুয়েলস

২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই আইনে কিছু সংশোধনী আনে। সেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলাৎকারকে যুক্ত করা, ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং অভিযোগ দাখিলের পর ট্রাইব্যুনালে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে ধর্ষণের মামলা নিষ্পত্তিসহ উল্লেখযোগ্য সংশোধনীর কথা যুক্ত করা হয়। গত ২৫ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির মাধ্যমে নতুন আইন কার্যকর হয়। কিন্তু সেখানে একটি নতুন ধারা ৯ (খ) সন্নিবেশ করা হয়, যেখানে বলা হয়—   “বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম করার দণ্ড। যদি কোনো ব্যক্তি দৈহিক বলপ্রয়োগ ব্যতীত বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে ষোল বছরের বেশি বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেন এবং যদি উক্ত ঘটনার সময় উক্ত নারীর আস্থাভাজন সম্পর্ক থাকে তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।”

মূলত এই ধারাটিকে চ্যালেঞ্জ করে গত ৬ এপ্রিল ‘এইড ফর ম্যান ফাউন্ডেশনের’ পক্ষে সংগঠনের সেক্রেটারি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রাশিদুল হাসান রিট করেন। তাঁদের পক্ষে আইনজীবী ইশরাত হাসান হাইকোর্টে এ রিট আবেদন করেন। রিটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যুক্ত করা “বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্মের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দণ্ডনীয় হবে” — এমন বিধানের বৈধতা চ্যলেঞ্জ করা হয়েছে। বিধানটি সংবিধানের সঙ্গে কেন সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে রিটে। আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে এ রিটে।এ প্রসঙ্গে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক অপরাধ হিসেবে ৯খ ধারায় বলা হয়েছে, যা মূল আইনে ছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার পর, তা না রাখলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাত বছরের দণ্ড হবে বলা হয়েছে। শুধু ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি’ না রাখার কারণে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলে তা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নারীর সম্মতির অধিকার লঙ্ঘন করে। প্রতিশ্রুতি না রাখার কারণে শুধু লিঙ্গের ভিত্তিতে একজনকে অপরাধী এবং অপরজনকে অপরাধী হিসেবে গণ্য না করার সুযোগ নেই। সংবিধান অনুসারে আইনের চোখে সবাই সমান। যখন ঘটনা ঘটছে, তখন তা অপরাধ নয়, পরবর্তী সময়ে প্রতিশ্রুতি না রাখলে তা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে বিধানটিতে। এমন অনুমান বা ধারণার ভিত্তিতে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। (৭ এপ্রিল, প্রথম আলো)

আইন বিশ্লেষকদের মতে, আগে ‘প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়ের’ কথা বলা হলেও সংশোধিত অধ্যাদেশে সুনির্দিষ্টভাবে ‘বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক’কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কী করলে প্রকৃত অর্থে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কেউ বিয়ের কথা বলে যৌন সম্পর্ক করার সঙ্গে সঙ্গেই অপরাধ সংঘটিত হবে, নাকি পরবর্তী সময়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পালন না করলে অপরাধ হবে? 

অর্থাৎ অপরাধকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এখানে অস্পষ্টতা আছে। তারা আরো বলছেন, এটি নারীর ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ ও ‘সম্মতি’র স্বাধীনতাকেও অবমাননা করছে। কোনো নারী যদি প্রতারিত অনুভব করেন তাহলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী প্রতারণার মামলা করতে পারবেন। দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারা অনুযায়ী, “কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তিকে এমন কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত থাকতে প্ররোচিত করেন, যার ফলে ওই ব্যক্তির শরীর, মন বা সম্পত্তির ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেটি প্রতারণা হবে।” সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই ধারায় কোনো নারী বা পুরুষ উভয়েরই প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেক্ষেত্রে নারীর প্রতি অবমাননাকর এমন ধারা রাখারই কোনো দরকার নেই।

এখন এই বিবাহের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ-এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা কী দেখি? আমরা জানি, ভারতীয় দণ্ডবিধি কোড ১৮৬০-তে প্রথম বিবাহ প্রতিশ্রুতিতে যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ব্রিটিশ কমন ল থেকে দণ্ডবিধির এই ধারাগুলো তৈরি হয়েছে। এই আইনে বিবাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে সিভিল অফেন্স হিসেবে এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্ত ১৯৭০ সালে কমন আইনগুলো যখন সংস্কার করা হলো, এই আইনটিই অফেন্সের খাতা থেকে বাতিল হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে বিবাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ তাদের দেশের প্রতারণা আইন ২০০৩-এর অধীনে সিভিল প্রতারণা হিসেবে দেখা হয়, কোনো ফৌজদারি অপরাধ নয়। ধর্ষণ তো নয়-ই। 

২০১৩ সালে দিল্লীর হাইকোর্ট বলছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মাত্র নারীর সম্মতি আছে কি নাই সেটা অকার্যকর হয়ে যায়। অপরদিকে ২০২৪ সালে কলকাতা হাইকোর্ট বলছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে যৌনকর্ম ধর্ষণ নয়। কারণ প্রতিশ্রুতি প্রদানে প্রতিশ্রুতিটি আসলে লঙ্ঘন হবে কি না তা নিশ্চিত করা যায় না। কিন্তু ভারতের ঔপনেবেশিক দণ্ডবিধিতে এখনো বিবাহ প্রতিশ্রুতিতে যৌনকর্ম ধর্ষণ। দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, পাঁচটি অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয়েছে, যার চার নাম্বারটি হলো, “নারীর সম্মতি নিয়েই শারীরিক সম্পর্ক, কিন্তু পুরুষটি জানেন যে, তিনি ওই নারীর স্বামী নন এবং ওই নারী তাঁকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তাঁর আইনসংগতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেন”।

একমাত্র বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানেই এই পেনাল কোড জারি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আফ্রিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে একটি সিভিল অফেন্স হিসেবেই দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ উন্নত বিশ্ব বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে সিভিল অফেন্স হিসেবে দেখলেও আমরা বিয়ের প্রলোভনকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখছি এখনো। যে সময়কার ব্রিটিশ আইন নিয়ে আমাদের পেনাল কোড চর্চিত, এখনকার ব্রিটিশ আইন আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখে না। তারা এটাকে সিভিল প্রতারণা হিসেবে দেখে। কেবল অর্থ, সম্পদ, পরিচয় গোপন কিংবা ইমিগ্রেশন প্রসঙ্গ যদি বিয়ের প্রতিশ্রুতির সাথে যুক্ত থাকে তখন তা ফৌজদারি প্রতারণা হিসেবে দেখে। 

বিয়ের প্রলোভনে যৌনকর্ম করার দণ্ড আইনটির আওতায় নারীই কেবল ভুক্তভোগী হতে পারবে। কিন্তু বিবাহ প্রতিশ্রুতিতে যৌন সম্পর্কে নারী-পুরুষ উভয়েরই অংশগ্রহণ থাকে। অথচ আইনটি ধরে নিচ্ছে নারী যৌনকর্মে দাতা এবং অধীনস্ত বা দাসের ভুমিকা পালন করে, অন্যদিকে পুরুষ সেখানে উচ্চতর এবং গ্রহীতা হয়। পুরুষের যৌনতায় বিয়ে আবশ্যক নয় যতটা আবশ্যক নারীর জন্য। এইটা সামাজিক বাস্তবতায় নানাবিধ রীতিনীতি দিয়ে প্রচলিত থাকলেও, যখন কোনো আইন তাকে বৈধ করে তোলে তখন আধুনিক রাষ্ট্রের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এই ধারণার মধ্য দিয়ে মূলত আমাদের পিতৃতান্ত্রিক আইন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, যার আড়ালে থাকে সেই আদি অকৃত্রিম ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধ, নারীর যৌন পবিত্রতা ও সম্ভ্রম রক্ষার ধারণা প্রতিষ্ঠা। এজন্য এখনো আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক ইন্ডিয়ান পেনাল কোডকে আশ্রয় করে আইনগুলো তৈরির প্রচেষ্টা থাকে। অথচ যে অগ্রগামী সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা এ কথাগুলো বলছি, সেখানে এই ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধ বহু জায়গায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অথচ আমরা নারীর যৌনতা প্রশ্নে বিগত দুই শতাব্দী আগের ধারণাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে চাচ্ছি।

সংকট হচ্ছে এই যে, বিয়ের প্রলোভনে যৌনকর্ম করার দণ্ডটি যেভাবেই হোক নারীকে অসহায়, দুর্বল ও যৌন কর্তাসত্তাহীন প্রতিপন্ন করতে চায়। অনেক সময় বলা হয় দরিদ্র শ্রেণীর নারীর জন্য এই আইনটি সুরক্ষার কাজ করবে। আসলে বাস্তবে যৌনতার প্রশ্নে শ্রেণী সংগ্রামের কারণেই শ্রমজীবী নারীরা যৌন কর্তাসত্তাতে মধ্যবিত্ত নারীর চাইতে এগিয়ে থাকে। বরং এই আইনটি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা প্রদানের চাইতে নারীর প্রতিশোধের অস্ত্র হয়ে উঠার কাজটিই করে থাকে। অনেক সময় সেখানে নারীর নিজ ভুমিকার চাইতে, পুরুষ বনাম পুরুষের প্রতিশোধের খেলায় নারীকে হাতিয়ার করে তোলার চর্চাই দৃশ্যমান হয়।

যার কারণে এই আইনটি থাকা মানে, সামনের দিনগুলোতে নারীর যৌনতার কর্তাসত্তার ধারণাকে সামাজিকভাবে নারীর যৌনতাকে দেখার জায়গাটিকে আরো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আটকে ফেলবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পিতৃতান্ত্রিক ধারণাকে পুনরুৎপাদন করবে। পরিণতিতে, প্রতারণাকারী (কিংবা  ধর্ষক)-এর সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে এবং আইনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত যৌন জীবনে ওপর রাষ্ট্রের খবরদারি বাড়বে।●

ফেরদৌস আরা রুমী ও মারজিয়া প্রভা, সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।