স্টারলিংক নিয়ে গর্জন বেশি, বর্ষাবে কতটা?

সরকারের অতিপ্রচারণা স্টারলিংকের সীমাবদ্ধতাকে আড়াল করেছে। স্টারলিংক বাংলাদেশের প্রযুক্তি-সক্ষমতা গড়ে তুলছে না বরং মানুষকে আরও বেশি নির্ভরশীল করবে বিদেশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর।

স্টারলিংক নিয়ে গর্জন বেশি, বর্ষাবে কতটা?

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলের ছাদে ছাদে বসানো একটা স্টারলিংকের সাদা ডিস; ফোর কে ভিডিও স্ট্রিমিং করে দেখানো হচ্ছে কন্টেন্ট। যাদুকরী স্পিডের ইন্টারনেট সরকার চাইলেও বন্ধ করতে পারবে না— এই ধরনের একটা স্বপ্ন বা আশ্বাস নিয়ে রেকর্ড টাইমে ইলন মাস্কের স্টারলিংককে বাংলাদেশে ব্যবসা করার অনুমোদন দেওয়া হয় এবং রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ইলন মাস্কের ভিডিও কল এবং এক্স-এ (টুইটার) যৌথ পোস্টের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তেজনার শুরু। গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউনূস স্টারলিংক বাংলাদেশের ডিজিটাল জগতে বিপ্লব আনবে বলে উল্লেখ করেন। তার পরে কয়েক মাসের ব্যবধানেই সব ধরনের সরকারি অনুমোদন পার করে মে মাস থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু করে স্টারলিংক।

কিন্তু স্টারলিংককে নিয়ে এমন ডামাডোল ও রাষ্ট্রীয় প্রচারণার অন্তরালে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা, যা বহুমাত্রিক সঙ্কট, সীমাবদ্ধতা এবং নাগরিকদের প্রযুক্তিগত স্বাধীনতাকে জিম্মি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, বাংলাদেশে স্টারলিংককের প্রযুক্তি  ‘রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের ধারণা নতুন নয়। ১৯৬০ সাল থেকেই এই প্রযুক্তি চলমান। তবে, সেগুলোর খরচ বেশি আর গতিও কম। সব হিসাব উল্টে দেয় ইলন মাস্কের স্পেস-এক্স। তারা ২০১৫ সালে একগাদা লো আর্থ অরবিট ভূ-উপগ্রহ (Low Earth Orbit-LEO satellite) দিয়ে একটা ক্লাস্টার তৈরি করে। এই স্যাটেলাইট পৃথিবীর অনেক কাছে দিয়ে ঘোরে, তাই সিগন্যাল পাঠাতে দেরি হয় না।

প্রচলিত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের জন্য তার টানার দরকার হয়। মোবাইল ইন্টারনেটের জন্য টাওয়ারের দরকার হয়। এগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা পাহাড়ী এলাকাতে ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এই ক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী এবং এটির সেবা পেতে কোনো ধরনের আলাদা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হয় না। 

বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা পার করতে হচ্ছে ব্যবহারকারীদের। শহরাঞ্চলে উন্নতমানের ফাইবার অপটিক সংযোগ থাকলেও গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায় এখনো অনেক মানুষ ইন্টারনেটসুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই প্রেক্ষাপটে স্টারলিংক একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে সামনে আসে। স্টারলিংক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি সংযোগ প্রদান করে, কোনো ফিজিক্যাল অবকাঠামোর প্রয়োজন ছাড়াই।

তবে, সরকার স্টারলিংকের প্রচারণায় যেভাবে এটিকে প্রায় যাদুকরী প্রযুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে, তা বাস্তবতার সাথে মেলে না।

শাটডাউন ও স্টারলিংকের ভূরাজনীতি

পঁচিশে মার্চের সেই ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “স্টারলিংক চালু হলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে মানুষকে আর তথ্যবন্দী করার কোনো সুযোগ পাবে না।” সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তারাও এর আগে এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তবে এসব বক্তব্যে ইন্টারনেট শাটডাউনের পেছনের প্রকৃত কারণ ও এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আড়াল করার অভিসন্ধি আঁচ করা যায়। শাটডাউনকে শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মূলত জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। আর এই বিভ্রান্তি বিপদজনকও বটে। কারণ, এ ধরনের প্রচারণা জনগণকে নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাসের উপর দাঁড় করিয়ে রাখে। ফলে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

২০২৩-এ সুদানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সুদান সরকার কর্তৃক ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরিত্রিয়া, চাদসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে স্টারলিংক ডিভাইস কেনার মাধ্যমে রেসিডেন্ট, এনজিওকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীরা ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। এমনকি গৃহযুদ্ধের একটি সশস্ত্র পক্ষ আরএসএফও (র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস) এই উপায়ে স্টারলিংক ব্যবহার করেছিলো। কিন্তু পরের বছর এপ্রিলে স্টারলিংক সুদানে তার সেবা বন্ধের ঘোষণা দেয়, যা সুদান সরকারের পক্ষেই গিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স না থাকা, আর আরএসএফের অপব্যবহারকে উল্লেখ করে। অধিকারকর্মীরা এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে ইলন মাস্কের প্রতি জোরালো আহ্বান জানালেও, তা কাজে দেয়নি।

অন্যদিকে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর দেশটিতে ইন্টারনেট সংযোগ ভেঙে পড়ে। ২০২২ সালে ইউক্রেন সরকার রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়ায় অভিযানের জন্য স্টারলিংক চালুর অনুরোধ করলেও ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও পারমাণবিক উত্তেজনার আশঙ্কার কথা জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, জার্মানি ও অন্যান্য মিত্রদের অর্থায়নে স্টারলিংক ইউক্রেনে সামরিক ও বেসামরিক যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

তবে ২০২৫ সালের শুরুতে নতুন এক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ওঠে, যুক্তরাষ্ট্র স্টারলিংক সংযোগ বন্ধের হুমকি দিয়ে ইউক্রেনকে একটি খনিজ সম্পদের চুক্তিতে রাজি করাতে চায়। পোল্যান্ডসহ ইউরোপীয় দেশগুলো এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এর জবাবে পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ইলন মাস্ক জনসম্মুখে “স্মল ম্যান” বলে টুইট করেন।

ইলন মাস্ক অবশ্য পরবর্তীতে ইউক্রেনে কখনোই স্টারলিংক বন্ধ না করার কথা জানান। কিন্তু এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে দেয়— একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রযুক্তি কোম্পানি এখন একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে এবং সেটি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এবং দেখিয়ে দেয়, স্টারলিংক কেবল একটি প্রযুক্তি নয় বরং এটি এখন একটি কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক শক্তিও। ফলে এর নিয়ন্ত্রণ কেবল একজন ব্যক্তির হাতে থাকা গভীর উদ্বেগের বিষয়।

বাংলাদেশে স্টারলিংক আনার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা করতে গিয়ে ইলন মাস্কের সাক্ষাৎ পান। ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর তুলা আমদানির চাপ দেয় এবং সেখানেই স্টারলিংক নিয়ে মাস্কের সঙ্গে কথা বলেন খলিল। এতে স্পষ্ট হয়, এটি শুধু প্রযুক্তির প্রসার নয়, বরং এক ধরনের কূটনৈতিক সমঝোতার ফলও হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যখন ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাস্কের সেই ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে ভূরাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছিল, তা কতটুকু নিরবচ্ছিন্ন থাকবে  সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

‘শাটডাউন’ কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়। প্রযুক্তিগত ত্রুটির ফলে ইন্টারনেট ব্যবস্থা ধ্বসে পড়লে তাকে সাধারণত শাটডাউন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। ‘শাটডাউন’ একটি রাজনৈতিক বিষয়, যেখানে সরকার বা ডি ফ্যাক্টো অথরিটির মাধ্যমেই এর বাস্তবায়ন ঘটে। বাংলাদেশের স্টারলিংকের ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট করেছে যে, স্টারলিংক বাংলাদেশের NGSO (Non-Geostationary Satellite Orbit) নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হবে। এর মানে হচ্ছে, ইন্টারনেট ট্রাফিক সরকার-অনুমোদিত ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (IIG) ও ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (NTMC) মাধ্যমে যাবে। সুতরাং, সরকার চাইলে অনায়াসেই স্টারলিংকের সেবা বন্ধ করতে পারে।

স্টারলিংককে বাংলাদেশের আইন মেনেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আর NGSO নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনে ব্যবহারকারীর তথ্য সরকারকে সরবরাহ করতে তারা বাধ্য। ফলে স্টারলিংক কোনো স্বাধীন বা সরকারের নিয়ন্ত্রণবহির্ভুত প্ল্যাটফর্ম নয়; বরং এটি প্রচলিত আইএসপিগুলোর মতোই একটি নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট সেবাপ্রতিষ্ঠান।

উপরন্তু বলা যায়, কোনো এক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে বাংলাদেশের জনগণের ইন্টারনেট সেবা-প্রাপ্তির ভাগ্য নির্ভর করবে সে সময়কার সরকার, স্টারলিংক ও ইলন মাস্কের ভূরাজনীতির হিসাবের ওপর।

ডিজিটাল বৈষম্য কি আসলেই দূর হবে?

সরকার বিভিন্ন সময় সাশ্রয়ীমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা সরবরাহের কথা বলেছে। কিন্তু স্টারলিংকের প্রি-অর্ডারে দেখা গেলো, হার্ডওয়ারের দাম প্রায় ৪৮,০০০ টাকা। মাসিক প্যাকেজ দুটি; Residential- ৬,০০০ টাকা এবং Residential Lite- ৪,২০০ টাকা। বেশ কিছু আফ্রিকান দেশে (যেমন কেনিয়া, জাম্বিয়া, বৎসোনিয়া ইত্যাদিতে) ২০-২৫ হাজার টাকার স্টারলিংক মিনি কিট এবং বেশ কিছু অল্প খরচের প্যাকেজ পাওয়া যাচ্ছে। যা তাদের প্রচলিত ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারদের দামেরও কম।

BBS-এর সর্বশেষ তথ্য (২০২৪-২৫ এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন) অনুয়ায়ী দেশের শহর অঞ্চলে ৬৮.৪% ভাগ মানুষ এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ৩৭.৮% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড সেবা না থাকলেও বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিসে ৯৯% কভারেজ আছে, চতুর্থ জেনারেশনের (4G) ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য। 

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের আওয়াতাভুক্ত না হওয়ার একমাত্র কারণ অবকাঠামো নয়, বরং সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট না থাকা এবং ডিজিটাল লিটারেসির অভাব। জনপ্রতি যেখানে গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয় ৬,১০০ টাকা, সেখানে ৪২০০ টাকা প্রতিমাসে ইন্টারনেট বিল বৈষম্য কমানোর বদলে বাড়াবে বলেই  ধারণা করা যায়।

স্টারলিংক বাংলাদেশে আসলে ভোক্তা পর্যায়ে মূলত কারা উপকৃত হবেন; এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং এবং টেক সার্ভিসের একটা ক্রমবর্ধমান ঢেউ যাচ্ছে। যাদের আয় দেশের গড় ইনকাম থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি, তারা হয়তো এই সার্ভিস থেকে সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হতে পারেন। তবে, তার বাইরে উচ্চমূল্যের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ভোক্তার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন। আবার শহরের সাধারণ ব্যক্তিগত বা বাসা-বাড়িতে ব্যবহারের বিষয়টি চিন্তা করা হলে, সেক্ষেত্রে স্টারলিংকের চেয়ে অনেক কম খরচে ভালো মানের ইন্টারনেট সেবা অন্যান্য কোম্পানি থেকে পাওয়া সম্ভব। এছাড়া, স্টারলিংক BDIX (Bangladesh Internet Exchange) এর আওতাভুক্ত নয়। অন্যান্য প্রায় সকল দেশীয় ISP-এর মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যুক্ত। যার ফলে ফেসবুক, ইউটিউব ও অন্যান্য গুগলের সার্ভিস, লোকাল স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটসহ অন্যান্য ওয়েবসাইটে কম লেটেন্সিতে এবং দ্রুত সময়ে ভিডিও বা অন্যান্য কন্টেন্ট লোড হয়।

প্রধান উপদেষ্টার অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজের পোস্ট অনুযায়ী, তার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব আহমেদ স্টারলিংক কিটটি সমিতি আকারে তহবিল গঠন করে কিনে শেয়ার করে ব্যবহারের কথা বলেছেন। এবং এই সেবাটি আশেপাশের দোকানে বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও আইনে এর বাধা নেই বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

কিন্তু স্টারলিংকের সর্বজনীন শর্তাবলী (Starlink Terms of Service) অনুযায়ী Residential প্যাকেজ দুটি কোনো ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিষেধ আছে। যদি শেয়ার করে চালানো হয়, তাহলে এই স্পিড বিভিন্ন ডিভাইসের ভিতরে ভাগ হয়ে যাবে এবং দাম কমে আসলেও উচ্চগতির ব্যাপারটি আর থাকবে না। তাছাড়া, স্টারলিংকের শর্ত না মানলে এবং তারা যদি কোনো ধরনের নিয়মভঙ্গের প্রমাণ পায় সেক্ষেত্রে সার্ভিস পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে পুরো হার্ডওয়ার কেনার টাকাটাই পানিতে যাবে।

অন্যান্য অঞ্চলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি) সময়ও স্টারলিংক ব্যবহারের নজির রয়েছে। তবে বৃষ্টি বা মেঘের ভিতরে এর কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার Residential প্ল্যান দিয়ে এই ধরনের কাজ করা যাবে কি না, সেটাও স্পষ্ট নয়। কেননা, তাদের নীতিমালা অনুযায়ী, এই প্যাকেজ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্থানে ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিকভাবেই ব্যবহার করা যাবে।

অন্যদিকে, বিজনেস প্ল্যানে Local Priority প্যাকেজের ক্ষেত্রে নিজ প্রতিষ্ঠানে, নিজ হোটেলে গেস্টদের কাছে বা এই ধরনের প্রেক্ষাপটে এই সেবা বিক্রি, কিংবা কমিউনিটি ওয়াই-ফাই বা “হটস্পট” হিসেবে শেয়ার করা যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তার দাম আরও বেশি এবং রয়েছে ডেটা লিমিট। এই ডেটা সীমা অতিক্রম করলে ইন্টারনেটের গতি নেমে যাবে— ডাউনলোড স্পিড ১ এমবপিএস, আর আপলোড স্পিড ০.৫ এমবিপিএসে।

সরকার বলছে, গ্রামীণ নারীরা মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে স্টারলিংক কিনে ‘ইন্টারনেট ব্যবসা’ শুরু করতে পারবে। অথচ, স্টারলিংকের শর্ত অনুযায়ী রেসিডেনশিয়াল প্ল্যানটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। আর প্রায়োরিটি প্ল্যানটিও সাশ্রয়ী নয়। কেউ এই শর্ত লঙ্ঘন করলে তার সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাহলে তখন এই মাইক্রোক্রেডিট নেওয়া নারীদের দায়িত্ব কে নেবে? তাদের যদি কয়েক মাস পর সেবা বন্ধ হয়ে যায়, তখন কী হবে?

অবকাঠামোগত উন্নয়নের বদলে করপোরেট নির্ভরতা

ইন্দোনেশিয়াতে ২০২৪ সালে আইফোন ১৬ বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয় তাদের একটি আইনের কারণে। Local Content Requirement (LCR) শীর্ষক এই আইন অনুযায়ী, দেশে বিক্রির জন্য যে স্মার্টফোনগুলো আনা হবে তা অন্তত ৪০% স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি হতে হবে। দেশটির বাতাম দ্বীপে অ্যাপল একটি AirTag উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এই কারখানাটি ২০২৬ সাল নাগাদ প্রায় ২০০০ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিনিয়োগের পরও আইফোন ১৬-এর ক্ষেত্রে LCR-এর শর্ত পূরণ না হওয়ায় প্রথমদিকে ইন্দোনেশিয়া আইফোন ১৬ বিক্রি করতে দিতে রাজি হয়নি।

অন্যদিকে, ইলন মাস্ক হচ্ছেন বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রতিটি কিট বিক্রিতে তার পকেট ভারী হচ্ছে। অথচ, এই বিপুল অঙ্কের টাকা বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি কিংবা দেশীয় টেলিকম বা ইন্টারনেট শিল্পের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে না। স্থানীয় ফাইবার অপটিক কোম্পানিগুলো যেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাবল টেনে, লোকবল নিয়োগ করে এবং সরকারকে রাজস্ব দিয়ে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে, স্টারলিংক সেখানে একটি সম্পূর্ণ বিদেশি মডেল নিয়ে কাজ করছে, যার প্রধান সুবিধাভোগী ইলন মাস্কের কোম্পানি ছাড়া আর কেউ নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা কেবল একটি করপোরেট স্যাটেলাইট প্রজেক্টের খরিদ্দার, বিনিয়োগের অংশীদার নই।

মোদ্দাকথা দাঁড়ায় এই যে, স্টারলিংক প্রযুক্তি হিসেবে নিঃসন্দেহে চমৎকার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেভাবে এবং যে শর্তে এটি বাংলাদেশে এসেছে, সেটি দেশের অধিকাংশ মানুষের বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। খরচ, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং স্থানীয় অবকাঠামোর সঙ্গে বিস্তর অসংগতি চোখে পড়ার মতো। 

কিন্তু, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সরাসরি সম্পৃক্ততায় স্টারলিংককে অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি অবিশ্বাস্যরকম দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হয়। এ বিষয়ে সরকার যে অর্ধসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে তা আত্মঘাতী এবং জুলাই আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক।

বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে “সবার জন্য ইন্টারনেট” চায়, তাহলে তা হওয়া উচিত দেশীয় অবকাঠামো ও সংস্থার মাধ্যমে। বিদেশি কর্পোরেট সেবা দিয়ে ডিজিটাল সমতা আনা সম্ভব নয়। স্টারলিংক আসলে বাংলাদেশের প্রযুক্তি সক্ষমতা গড়ে তোলেনি, বরং বাংলাদেশের মানুষকে আরও বেশি নির্ভরশীল করছে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদেশি কোম্পানির ওপর। সত্যিকার অর্থে যদি দেশের প্রতিটি প্রান্তে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি চাওয়া হয়, তাহলে প্রয়োজন দেশীয় অবকাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ, স্বচ্ছ নীতি ও তার বাস্তবায়ন এবং সকলের নাগালে থাকা সাশ্রয়ী ইন্টারনেট নিশ্চিত করা।●

শাশ্বত সিয়াম একজন ডিজিটাল প্রোডাক্ট ডিজাইনার। তিনি লাইফ ডেটা নামে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোম্পানির প্রিন্সিপাল প্রোডাক্ট ডিজাইনার।