পুরুষের কলমে নারীর ভাগ্য লেখা বন্ধ হোক

বাংলাদেশের নারীদের কাছে এই রাষ্ট্রের বিরাট ঋণ জমে আছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে ধর্মের নামে যে তীব্র বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে, তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে—এই ঋণ এখন মিটানোর সময় এসেছে। না হলে, নারীরা নিজেরাই সে ঋণ শোধের ব্যবস্থা করবে।

পুরুষের কলমে নারীর ভাগ্য লেখা বন্ধ  হোক

যে দেশে পুরুষেরা দীর্ঘদিন ধরে মাইক এবং নৈতিকতা — উভয়ের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে আসছে, সে দেশে হেফাজতে ইসলামের মতো একটা কট্টরপন্থী গোষ্ঠী, অন্তর্বর্তী সরকারে যাদের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং বেশ কয়েকজন সহানুভূতিশীল ব্যক্তি রয়েছেন, নারী ইস্যুতে তাদের মতাদর্শিক সঙ্গীদের ক্ষোভ প্রদর্শন সম্প্রতি হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হওয়া ঘটনাটা শুধু হাস্যকরই নয় একইসঙ্গে বিপদজনক বলেও মনে হয়েছে। 

একদল পুরুষ, যাদের শরীরে অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন এবং নৈতিকতার স্খলন-সংক্রান্ত অমূলক ভীতি প্রবাহিত, তারা রাস্তায় নেমে এসে “ইসলাম বাঁচানোর” আড়ালে নারীদের অধিকারকে আক্রমণ করছে। তাদের এই ধর্মীয় উগ্র আবেগের মধ্যে আমরা যা দেখছি তা হলো, ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা নয়, ক্ষমতার ভঙ্গুরতা।

এটা পরিষ্কার করে বলা দরকার, এই ক্ষোভটা আদতে ধর্ম নিয়ে নয়। এটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এই ক্ষোভ পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের শেষ দুর্গ— গৃহস্থালি, ব্যক্তিগত পরিসর এবং লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে। কমিশনের সুপারিশগুলো আসলে যে ব্যবস্থাটাকে চ্যালেঞ্জ করে, তা হলো সুপরিকল্পিত এক লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামো, যেখানে পুরুষেরা ঈশ্বরের নামে কথা বলে, আইনের নামে কথা বলে আর সব সময় পুরুষরাই ঠিক করে দেয় নারীরা কী চাইবে, কী পাওয়ার যোগ্য, কিংবা কী সহ্য করবে। মূলত এখান থেকেই নৈতিকতার স্খলন-সংক্রান্ত অমূলক আতঙ্কের সূত্রপাত।

বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠে সমান উত্তরাধিকারের প্রশ্নে অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়ায়। হেফাজতসহ আরও অনেকে দাবি করেন, ইসলাম নারীকে সুরক্ষা দিয়েছে, এই কারণে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় সম্পত্তির অর্ধেক অংশ পায়। হ্যাঁ, ইসলামী শরিয়তে উত্তরাধিকার নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সাধারণত মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক সম্পদ পায়, কারণ সেই সময়ের ধারণা ছিল—পুরুষেরাই পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব বহন করে। কিন্তু এই যুক্তির ভিত্তি ছিল সপ্তম শতকের আরব সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, যা একুশ শতকের বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। আজকের বাংলাদেশে লাখ লাখ নারীই পরিবারের মূল উপার্জনকারী, একক মায়ের ভূমিকায়, সেবিকা কিংবা পরিবারের কর্তা হিসেবে জীবনযাপন করছেন। গ্রামবাংলায় এমন দৃশ্য বিরল নয়, যেখানে একটা মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে বাবা-মা ও ভাইদের ভরণপোষণ করে, অথচ বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সেই মেয়েটার সম্পত্তির দাবিকে অস্বীকার করা হয়।

এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ারও কথা নয় আর বারবার বলারও দরকার নেই— কমিশন ধর্মীয় পারিবারিক আইন পুরোপুরি বাতিল করার কোনো প্রস্তাব দেয়নি। বরং একে ঐচ্ছিক করার কথা বলেছে। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ট একাধিক দেশ ইতিমধ্যে ধর্মীয় পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেই আধুনিক বাস্তবতার আলোকে উত্তরাধিকারের আইন পুনর্বিবেচনা শুরু করেছে।

২০১৮ সালে তিউনিসিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট বেজি কাইদ এসসেবসি একটি খসড়া বিল উত্থাপন করেন, যেখানে নারী ও পুরুষকে সমান উত্তরাধিকারের অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। পাশাপাশি, যারা ইসলামী ঐতিহ্যগত বণ্টন মেনে চলতে চান, তাদের জন্য ছিল অপ্ট-আউট করার সুযোগ। রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারা বিলটির তীব্র বিরোধিতা করলেও এটি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দেয় এবং এই বিষয়টি গণসচেতনতায় জায়গা করে নেয়।

অন্যদিকে, ২০শ শতকের শুরুর দিক থেকেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ আইনব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত হচ্ছে তুরস্ক— যার প্রভাব জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উদীয়মান চিন্তক এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় ডানপন্থীদের চিন্তাভাবনায় স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত। তুরস্কে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান উত্তরাধিকার দেওয়া হয় তাদের গৃহীত সুইস সিভিল কোড অনুযায়ী। এই আইন সকল নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য, ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন।

মরক্কো এখনো মুদাওয়ানা (পারিবারিক আইন) অনুযায়ী ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অনুসরণ করে। তবে তারা সংস্কারের ব্যাপারে জনপরিসরে আলোচনা শুরু করেছে। প্রভাবশালী নারীবাদী গবেষক ও ইসলামী আলেমরা অর্থনৈতিক বাস্তবতার আলোকে পারিবারিক আইনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার (ইজতিহাদ) আহ্বান জানিয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন, নবী মুহাম্মদ (স.) অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নির্দিষ্ট সময়-প্রেক্ষিত অনুযায়ী। এবং তারা ইসলামী আইনের উচ্চতর উদ্দেশ্য— মাকাসিদ আল-শরিয়া তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ন্যায্যতা ও কল্যাণ।

মিশর ও ইন্দোনেশিয়াতেও বিতর্ক শুরু হয়েছে— উত্তরাধিকার আইন বর্তমান পারিবারিক গঠন ও নারীদের অর্থনৈতিক অবদানকে প্রতিফলিত করে এমনভাবে বদলানো উচিত কি না। যদিও এখনো কোনো সংস্কার আইন পাশ হয়নি তবে এইসব আলোচনা রক্ষণশীল ও প্রাচীণপন্থী চিন্তার ভূমি নাড়িয়ে দিয়েছে এবং পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই উদাহরণগুলো একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে স্পষ্ট করে তোলে, তা হলো— ইসলাম কোনো স্থবির ধর্ম নয়। কোরআন ও হাদিস আমাদের মূলনীতি দেয়। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যার জন্য রয়েছে ফিকহ— যা একটি মানবিক প্রয়াস। ইতিহাসজুড়ে মুসলিম সমাজগুলো তাদের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আইনের প্রয়োগে পরিবর্তন এনেছে।

তাহলে বাংলাদেশের অনেক মানুষ কেন এমন ভান করেন যে, সম্পত্তি আইন একেবারে ছোঁয়া যাবে না, যখন আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্য সব আইন বদলে নিচ্ছি?

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যারা সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যাংকিং ব্যবস্থা মেনে নেয় (যা ইসলাম স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে), শ্রম-শোষণের বাজারে উৎসাহ দেয়, কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশ নেয়, তারা-ই আবার সম্পত্তির ওপর পুরুষের একচেটিয়া অধিকার রক্ষার সময় ধর্মভীরু হয়ে ওঠে! 

এটাকে কি বলা যায়? বাছাই ধার্মিকতা নাকি সুচারু প্রতারণা, যেটা ‘ধর্মের ঐতিহ্য’ বলে চালানো হয়?

আমাদের আশেপাশের কিছু ‘জ্ঞানী বিশ্লেষক' পুরুষ কমিশনের সুপারিশগুলোকে বাতিল করে দিতে চান। তাঁরা বলছেন এসব নাকি “বাংলাদেশের বাস্তবতার” সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ তাঁরা এমন এক কল্পনাজগত তৈরি করে রাখেন, যেখানে দেশের নারীরা কোনো রকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই জীবন কাটান, আর সদা সহানুভূতিশীল পুরুষ অভিভাবকদের স্নেহচ্ছায়ায় নিরাপদে থাকেন। এই ভদ্রলোকেরা একেবারে উদাসীন থাকেন সেই বাস্তবতা থেকে, যেখানে নারীদেরকে সম্পত্তির মালিকানা থেকে কাঠামোগতভাবে বঞ্চিত করা হয়। ফলে বিবাহবিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পর তারা গৃহহীন হয়ে পড়েন। ঋণ, সরকারি ভর্তুকি কিংবা কৃষি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন এবং দারিদ্র্যের এক গভীর চক্রে আটকে পড়েন, যেখান থেকে বের হওয়া প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্যও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আমাদের পুরুষপ্রধান ‘বিশ্লষকবর্গ’ ভুলে থাকতে পছন্দ করেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নারীদের ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। তৈরি পোশাক শিল্পে কোটি কোটি শ্রমিকের মধ্যে অধিকাংশই নারী, কিন্তু তারা এখনও পর্যাপ্ত মজুরি পান না, অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য হন, নিয়মিতভাবে হয়রানির শিকার হন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকেও বঞ্চিত থাকেন। এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের স্বাভাবিক করে তোলা শোষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও পারেন না।

শুধু শিল্পেই নয়, কৃষি ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির মেরুদণ্ডও নারীরাই। তারা বীজ বোনে, জাল টানে, রাস্তার পাশের দোকান চালায়, গবাদি পশু দেখাশোনা করে, খাবার প্রক্রিয়াজাত করে, ফসল বিক্রি করে। এর পাশাপাশি একেবারে একার হাতে ঘরের সব খাটুনি ও অবৈতনিকভাবে যত্নের কাজটাও করে যান, যার কোনো স্বীকৃতি নেই। অথচ ঘর টিকিয়ে রাখার জন্য এসবই সবচেয়ে জরুরি।

তবুও আগের মতোই, নীতিনির্ধারণ, পরিসংখ্যান বা জনচেতনায় তারা রয়ে গেছেন প্রায় অদৃশ্য। তারা ‘চাষী’ বা ‘জেলে’ হিসেবে স্বীকৃতি পান না, কারণ জমি তাদের নামে নয়, জাল তাদের নয়, আর নথিপত্রেও তাদের শ্রমের কোনো উল্লেখ নেই।

এ এক নির্মম অর্থনৈতিক নিপীড়ন। সবচেয়ে নীরব কিন্তু গভীরতম শোষণ।

কী নিদারুণ উপহাস, যে পুরুষেরা নিজেরা সম্পদ কুক্ষিগত করে, নিয়ম বানিয়ে বসে, নারীদের অধিকার কেড়ে নেয়, এখন তারাই আমাদের ন্যায়ের পাঠ দেয়! একে কি বলব নিছক ভণ্ডামি, নাকি "ঐতিহ্য"র নামে চালানো এক সূক্ষ্ম ও কাঠামোগত প্রতারণা?

এ শুধু ধর্মীয় নেতাদের কথা নয়। কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে, রাজনৈতিক স্পেকট্রামের একেবারে মাঝখানে থাকা সেক্যুলার, প্রগতিশীল পুরুষরাও কতটা অস্বস্তিতে পড়েন যখন সংস্কারের কথা ওঠে। তাদের নিজেদের ঘরের ভীত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সুপারিশই যেন কমিশন করেছে। তারা গণতন্ত্রের পক্ষে মিছিল করে, ন্যায়ের জন্য স্লোগান তোলে, শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করে। কিন্তু বিষয়টা বৈবাহিক ধর্ষণ, সন্তান পালন বা যৌনকর্মীদের শ্রম-অধিকার হলে তখনই তারা পিছিয়ে পড়েন জটিল তত্ত্বকথা— ‘পশ্চিমা নারীবাদ’, ‘নৈতিক আপেক্ষিকতা’, ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’ নিয়ে।

মাহা মির্জা সাম্প্রতিক এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে দুর্দান্তভাবে লিখেছেন— আমাদের আধুনিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, প্রশাসন, সবই তো পশ্চিমা অনুকরণ। কিন্তু কোনো নারী যখন তার পারিবারিক সম্পত্তিতে নিজের অধিকার চায়, তখনই শুরু হয় ‘পশ্চিম-ভোলার’ ডাক, যেন নিজস্বতার মানে কেবল পিতৃতন্ত্রে ফিরে যাওয়া!

 কমিশন পশ্চিম থেকে আমদানি করা নিছক কোনো ‘নব্য উদারতান্ত্রিক’ ফ্যান্টাসি প্রস্তাব করেনি। তারা বাস্তবভিত্তিক, মাটির গন্ধমাখা কিছু সংস্কারের কথা বলেছে, যা বাংলার নারীদের প্রতিদিনকার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। এমন কিছু প্রশ্ন তারা তুলেছে— একজন নারী কি নিজের পেশা স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে? কোনো ঝামেলা ছাড়াই সম্পত্তিতে ভাগ পেতে পারে? সহিংস বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সন্তানসহ বের হতে পারে? রাস্তায় কাজে যেতে পারে নির্ভয়ে?

কিন্তু এসব প্রশ্নকে সততার সঙ্গে মোকাবিলা করার বদলে আমরা দেখতে পেয়েছি একরকম  ‘নৈতিকতা সম্পর্কিত সার্কাস’।

আমরা বারবার মনে করিয়ে দিতে বাধ্য হই যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কথা, যেখানে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অথচ তাদেরকে প্রকাশ্য ক্ষেত্র থেকে সযত্নে, একপ্রকার পরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কথিত "জাতীয়" আলোচনা ছিল পুরুষদের একপ্রকার আত্মপ্রদর্শন। সিজেন্ডার, মুসলিম, বাঙালি পুরুষ, প্রত্যেকে দেশের ভবিষ্যতের দ্বাররক্ষী হিসেবে কাজ করে। তারা মনে করে এটা তাদের জন্মগত অধিকার। সংস্কার কমিশন? পুরুষদের দখলে। রাজনৈতিক গোলটেবিল? পুরুষদের দখলে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাগুলো? পুরুষদের দখলে। তবুও দেশের অর্ধেক জনগণ কেন আলোচনার বাইরে, সেটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হয়নি কিংবা এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। যেন পুরুষেরা যখন ক্ষমতা একা নিয়ে নেয়, সেটা "বিশেষজ্ঞতা"; আর নারীরা যখন নিজেদের স্থান দাবি করে, সেটা "বিভাজন সৃষ্টি" বলে চিহ্নিত হয়।

এটা মোটেও কাকতাল নয় যে, ধর্মীয় জনপ্রিয়তাবাদী, কর্তৃত্ববাদী এবং সেক্যুলার উভয় পক্ষই যখন নিজেদের বৈধতা হারাতে বসে, তখন তারা নারীদেহ, নারীর অধিকার, নারীর পছন্দ— এসব নিয়েই নীতি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মূলতা এটা পুরোনো কৌশল। কাঠামোগত ব্যর্থতা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করো। নারীকে বানাও প্রতীক, কখনও ঐতিহ্যের, কখনো মর্যাদার কখনও হুমকির। তারপর ঠিক করো তাকে বাঁচাতে হবে না শাস্তি দিতে হবে।

গত বছর জুলাইয়ে যখন রাজপথ জ্বলে উঠেছিল আর আন্দোলনের ঢেউ স্বৈরতন্ত্রের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তখন বিশ্বাসের এমন এক মুহূর্ত আর আশার আদিগন্ত আলো ছড়িয়ে পড়েছিল যে— হয়তো এবারই সেই বদলের সময়। ভেবেছিলাম, এবার এমন একটা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে পারব, যেটা দাঁড়াবে শোষণের ওপরে নয়, সমতা ও ন্যায্যতার উপর; দাঁড়াবে নিয়ন্ত্রণ নয় বরং যত্নের ওপর। মনে হয়েছিল, ক্ষমতার সঙ্গে জনগণের ভেঙে যাওয়া চুক্তিটা এবার নতুনভাবে লেখা হবে। লেখা হবে আমাদের ভাষায়, আমাদের চাওয়ায়, আমাদের কণ্ঠে।

কিন্তু আন্দোলনের রেশ কাটতেই দেখা গেল সব বিশ্বাস ও আশার ওপর ধুলা বসেছে। পুরনো শাসকেরা ফিরে এসেছে নতুন চেহারায়, চকচকে মুখোশে। এখন যেন চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানো হচ্ছে: এই “নতুন শাসনব্যবস্থা” কোনো দিনই ছিল না শ্রমজীবী মানুষের জন্য। ছিল না কৃষকের, ছিল না প্রবাসীর। আর কখনোই ছিল না সেই সব নারীর জন্য, যারা এই দেশের অর্থনীতিকে বয়ে এনেছে পিঠে, গর্ভে আর নীরব সহ্যশক্তিতে।

এখন এটা স্পষ্ট যে, এই সমাজে নারীদের যত ত্যাগই থাকুক, যত খাটুনি, যত অবদানই থাকুক, যারা চায় আমাদের কণ্ঠ থেমে থাকুক তাদের চোখে আমাদের কোনো জায়গা নেই। তাই স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করার দিন শেষ। এখন সময় এসেছে আমাদের যা প্রাপ্য তা দৃঢ়ভাবে বুঝে নেওয়ার। এই দেশ নারীদের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ঘামে, দুঃখে, নিরব সহ্য-শক্তির ‍ওপর রচিত হয়েছে নানা গর্বের ফলক। আমরা আর অনুরোধ-উপরোধ করছি না, আমরা আমাদের হিসাব চাইছি।

আমাদের প্রাপ্যটা এখনই আমাদের দিয়ে দেয়া হোক।●

সুস্মিতা পৃথা একজন সাংবাদিক ও গবেষক।