ডিজিএফআই-র্যাব, কোনোটারই দরকার নেই বাংলাদেশে: সানজিদা ইসলাম তুলি
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিবাদ জানানো সানজিদা ইসলাম তুলি "মুখোমুখি" হয়েছিলেন নেত্র নিউজের।
কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের সময়ে বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে “মায়ের ডাক” নামের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সানজিদা ইসলাম তুলি। ২০২৪-এ জুলাই অভ্যুত্থানের পর যখন রাষ্ট্রের নানামুখি সংস্কারের আলাপ চলছে তখন তিনি গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত র্যাব, ডিজিএফআইয়ের মতো বাহিনীগুলোর বিলুপ্তির দাবি তুলেছেন। সম্প্রতি নেত্র নিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন নেত্র নিউজের সুরাইয়া সুলতানা বীথি।
বীথি: বিগত বছরগুলোতে, যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার যেসব মানুষ রয়েছে, তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। এবং মায়ের ডাকের যেভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেটাও একদম খুবই ব্যক্তিগত শোকের জায়গা থেকে। ব্যক্তিগত শোকের জায়গা থেকে বা কষ্টের জায়গা থেকে কীভাবে এমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন তৈরি করলেন, কীভাবে এ ধরনের একটি সংগঠন গড়ে তুললেন?
তুলি: শুরুটা, হ্যাঁ, ব্যক্তিগত উদ্যোগেই। কারণ হচ্ছে, যখন আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ওয়ান, ওই সময়টা ছিল ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির ইলেকশন পূর্ববর্তী সময়। এবং সেই সময়টাতে আপনি দেখবেন যে, নির্বিচারে ভিন্ন দলের, ভিন্নমতের মানুষদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, একটা ভয়ের সংস্কৃতি ক্রিয়েট করার জন্য। আমার ভাইয়ের কেসটা ওই সময়ের একটা কেস। আমার ভাইকে যখন র্যাব তুলে নিয়ে গিয়ে অস্বীকার করে… ওই সময়টা তো, আমরা জানতাম না… গুম বা এই এরকম কোনো মেকানিজম আছে বা এটার সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না।
তখন থেকে আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম যে, ডিনায়ালটা কেন শুরু হলো, তারা অস্বীকার যে করছে… আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক ইলিগ্যালভাবে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে… এবং অবৈধভাবে রাখা যায় কাস্টডিতে… এবং এরকম ইলিগ্যাল কাস্টডি বা সিক্রেট ডিটেনশন সেলগুলোতে।
তো, সেই জিনিসটা বুঝতে আমাদের মনে হচ্ছিল যে… মানে তখন থেকে বোঝা শুরু হলো যে, গুমটা কি? এরকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয়… বা আমরা এক্সট্রা জুডিশিয়্যাল কিলিংসগুলো দেখেছিলাম… কিন্তু বলপূর্বক গুম যে, সেটাও হয় আমার দেশের কালচারে… সেটা পরিচিত হচ্ছিলাম। এবং হওয়ার পরে যেটা হলো, তখন আমার মা, আমার বড় বোনেরা, আমাদের পরিবারের বাকি যারা, প্রত্যেকটা জায়গায় যখন যায়, র্যাব থেকে শুরু করে হেডকোয়ার্টার, ডিজিএফআই থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যত ইনস্টিটিউশন আছে বাংলাদেশে, সবখানে আবেদন দেওয়ার পরেও যখন কোনো রেসপন্স পাই না, যখন কোনো ইনভেস্টিগেশন হয় না, কোনো উত্তর আসে না, তখন থেকে তাদের মধ্যে, এই যে ডিনায়ালটা, এই যে অস্বীকার করে যাচ্ছে, সত্যটাকে… কারণ ভাইদেরকে যখন নিয়ে গিয়েছিল, রাষ্ট্রীয় বাহিনী র্যাব কর্তৃক, তখন কিন্তু অনেক মানুষের সামনে থেকে নিয়ে গিয়েছিল। ওখানে একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন প্লট… ওখানে অনেকজন মানুষ কাজে ছিলেন, বিশ-পঁচিশজনের মতো। তাদের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সে র্যাবের ইউনিফর্ম পরা, র্যাবের ডাবল কাভারভ্যানে… ওই সত্যগুলো তো আমাদের কাছে ছিল। সেই সত্যগুলোসহ সামনে কথা বলার মত অবস্থা ছিল না এবং ওই সময়টায় আমার মা প্রথম, হাজেরা খাতুন, উনি এখন ৭৫ বছর, তখন আমার মা বলেন যে, যেহেতু এত আবেদন দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না এবং লিগ্যাল কোনো ইনভেস্টিগেশন বা স্টেপে আমরা যেতে পারছি না যে, জিডি করবো বা এফআইআর করবো, কোনো ইনভেস্টিগেশন… আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে পারছি না। সেই সময় আমার মা যখন দাঁড়ান তার সন্তানের জন্য, এটা একেবারেই আন্তরিকভাবে যেটা, সেটা করেন তিনি, পারিবারিকভাবে তার সন্তানের জন্য।
বীথি: যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সেটা সবসময় হয় প্রতিহিংসামূলক। একটা দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তার বিরোধী দলকে দমন করে, তাদের দলের নেতাকর্মীদেরকে এই ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এখন তো আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় নাই। এখন বরং আপনার ভাই যে বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার হয়েছিলেন, সেই দলের একটা ভালো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেক্ষেত্রে কি আমরা দেখবো যে, আওয়ামীলীগের কোনো নেতাকর্মী যদি গুমের শিকার হন, বা বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার হন, সে ক্ষেত্রে কি আপনারা তাদেরকে রক্ষায় কাজ করবেন?
তুলি: আপনি যেটা বললেন যে, আমার মায়ের উদ্যোগের পরে যখন শুরু হয় মায়ের ডাক, তখন পুরো দেশ থেকে এরকম যারা ভিকটিম ফ্যামিলিগুলো, আমরা সবাই কানেক্টেড হই। একটা বড় নেটওয়ার্ক ক্রিয়েট হয়। তখনো কিন্তু আমাদের যে ফ্যামিলি নেটওয়ার্ক এবং তার মধ্যে কিন্তু চারটা ফ্যামিলি আছে যাদের আওয়ামী লীগের… তার সন্তান হচ্ছে আওয়ামী লীগ করতেন এবং অন্তঃকোন্দলে তাকে গুম করা হয়েছে। তো আওয়ামী লীগের যে ভিক্টিম, তাদের নিয়ে যে আমরা দাঁড়াই, এটা আমরা দাঁড়ানো শুরু করেছি গত বিগত ১১-১২ বছর আগেই। এটা আসলে সামনে যে পরবর্তী সরকার আসবে বা কী করবে সেটার অবস্থা আমরা বিবেচনায় না রেখেই করেছি।
বীথি: আপনার উপরে, আমরা জানি যে, ভয়ঙ্কর রকমের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলেছে, আপনার উপর যে নজরদারি চলছে, তো, সকল পরিবারের ক্ষেত্রে কি এটা ঘটেছে? নাকি আপনি যেহেতু একটা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, একটা নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে, মানে নির্বাচিত প্রতিনিধি, সেটা বলছি না, কিন্তু একটা আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আপনি, সেক্ষেত্রে কি অন্যান্য পরিবারগুলোর চেয়ে আপনাকে একটু বেশি… এই ধরনের ঘটনার শিকার হতে হয়েছে? নাকি একই রকম?
তুলি: প্রত্যেকটা পরিবারকেই কোনো না কোনোভাবে হ্যারেস করা হয়েছে। এবং এটার মাত্রাটা আসলে… যেমন, আমার ক্ষেত্রে হ্যান্ডেল করাটা বা আমাকে ফেস করাটা হয়তো… আমার দুই পায়ে অতটুকু জোর ছিল যে, আমি অতটুকু সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। কিছু কিছু পরিবারের ক্ষেত্রে এই হ্যারেসমেন্টটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, আপনি জানেন যে, স্ত্রীরা… ভাবীদেরকে, আমরা তাদেরকে হাফ উইডো বলি, তাদেরকে যখন রাত আটটার সময় থানায় ডেকে নিয়ে যেতো, ১২টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখতো, সাদা কাগজের সাইন নেওয়ার জন্য, এটা আবার অন্যরকম একটা ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। একটা মেয়েকে এই বয়সের… এবং আপনারা জানেন যে, তারা খুব কম বয়সে তাদের স্বামীদেরকে এরকম হারিয়েছে, গুম হয়ে গেছে, এবং তারা কিন্তু এখনো এই… বিগত, এত বছর, প্রায় এক যুগ আমরা একসাথে… এবং এল্ডারলি প্যারেন্টস যারা, তারপরে তাদেরকেও বাড়িতে… এবং একটা বাহিনী না, বিভিন্ন মেকানিজমে, বিভিন্ন বাহিনী দ্বারা ডিফারেন্ট ডিফারেন্ট ওয়েতে হ্যারেস করা হতো।
সামাজিকভাবে এটা হ্যারেস করা হতো, তাদের বাড়িতে গিয়ে সম্পত্তি ক্রোক করার নামে, তাদের থেকে সাদা কাগজে সাইন নেওয়ার নামে, তাদের বাড়িতে কোনো ছেলে মানুষ থাকলে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার নামে, এটা যে আমার উপরে হয়েছে শুধুমাত্র, তা না। হয়তো আমার উপরে হয়েছে, সেটা সামনে এসেছে এবং এটার জন্য সব মানুষ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা যখন প্রত্যেকটা পরিবার, বাংলাদেশের… আমাদের যে ভিকটিম ফ্যামিলিগুলো, এটা আমরা অনেক ওয়েল কানেক্টেড। তো, যেখানেই যার যেটা যখন হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে যখন আমাদের কাছে খবর আসে, আমরা বুঝতে পারি, আমরা কানেক্ট করতে পারি যে, প্রত্যেকটা পরিবারের উপরে… একভাবে না, একাধিকভাবে এই হ্যারাসমেন্টগুলো করা হয়েছে।
বীথি: আপনি বলছিলেন সাদা কাগজ যে স্বাক্ষর করার ব্যাপার… এটা আসলে কী, মানে এটা নিয়ে কী হতো বা কী করতো?
তুলি: বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক যখন হয়, তখন যেটা হলো যে, সত্যগুলো সামনে আসা শুরু হলো। কারণ, প্রত্যেকটা কেসের আইউইটনেস ছিলো। কাউকে নিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ সামনে ছিল, কাউকে নিয়ে যাওয়ার পরে তারা কল পেয়েছে বা বুঝতে পারলো, বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাদা কাগজের সাইনটা হচ্ছে, এই পরিবারগুলোকে কোনোভাবে মুখ বন্ধ করানো যাচ্ছিল না। আপনারা দেখেছেন যে, সরকারের মধ্যে… সরকারপ্রধান হাসিনা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা মন্ত্রীর তখন একটা বয়ান ছিল। যখনই ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্মে জিজ্ঞেস করা হতো, তারা বলতো যে, এই মানুষগুলো পালিয়ে গেছে। দেনার দায়ে পালিয়ে গেছে, এক্সট্রা মেরিটাল আফিয়ারের জন্য হয়তো পালিয়ে গেছে। তো, এইরকম কোনো কারণ দেখানো হতো এবং তারা তাদেরকে গুম করা হয়নি, তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে— এরকম কোনো কিছু জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হতো, মানুষের সামনে। সেটাকে দাঁড় করানোর জন্য, যখন পরিবারগুলোকে ডেকে নিয়ে যেতো থানায়, নিয়ে সেখানে একটা সাজানো হতো, অন্য স্টেটমেন্ট দিয়ে যে, বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। বা সাদা কাগজের সই নেওয়া হতো যে, এই পরিবারই তো স্বীকার করেছে যে, সেই মানুষগুলো আসলে নিজেরা লুকিয়ে আছে— এই জিনিসটা স্টাবলিশমেন্টে আনার জন্য আসলে মনে হয় যে, এটা তারা প্রয়োগ করতো।
বীথি: অনেকে মানবাধিকারের প্রসঙ্গ আসলেই বা বিচারের প্রসঙ্গ আসলেই বলেন বা টেনে আনেন, পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক-বাহক… এ ধরনের কথা বলেন, বা বলেন, বাংলাদেশে আসলে মানবাধিকারের যে ধারণা বা বিচারের যে ধারণা, মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে একটা বিচারের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে, এ ধরনের কথা আসলে বলেন, এগুলো খুব পশ্চিমা সংস্কৃতির কথাবার্তা। আপনি কী বলবেন, আপনার কি মনে হয় কখনো যে, আসলে পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে ধার করে নিয়ে এসে আমরা একটা বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কারের কথা বলছি বা পরিবর্তনের কথা বলছি? বা একজন অপরাধীর শাস্তি চাওয়া হচ্ছে?
তুলি: আমার মনে হয় যে, সবকিছুর পরে যেটা মনে হচ্ছে, এখনকার পরিস্থিতিতে, সব সময় আমাদের ভিক্টিমদের পক্ষ থেকে একটা চাওয়া ছিল যে, এটা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডে হোক, ইনভেস্টিগেশন বলেন, বিচার বলেন, এর পরবর্তী যত প্রক্রিয়া… ট্রায়াল প্রসেস বলেন, যেটাই চলুক না কেন, এটা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডেই হোক। সেটা এনশিওর করার জন্য হয়তো সব মেকানিজমে এখন কাজ করা হচ্ছে। আমরা কিন্তু এখনো শিওর না যে, আসলে আমরা সেই স্ট্যান্ডার্ড মেন্টেইন করে পারছি কি না কাজ করতে, সেটার রিফ্লেকশন কিন্তু এখনো আমাদের কাছে ক্লিয়ার না।
বীথি: কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড কি পশ্চিমা সংস্কৃতি— দুটোর মধ্যে কি আসলে পার্থক্য নাই? মানে কেন বলা হয় এটা, আপনি কি মনে করেন?
তুলি: এখানে বিচারের জায়গায় যেমন দেখা যায় যে, শাস্তির প্রথাটা যদি ধরেন, যেমন আমাদের দেশের মধ্যে… আমাদের বয়ান থাকে একটা… মানুষের মধ্যে যখনই নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রাটা বেড়ে যায়… আমরা জুলাইয়ে দেখেছি, আমাদের সামনেই গুলি করে মারা হয়েছে, তো, আন্দোলনের একটা স্লোগান থাকে যে, এটার… আমরা খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই…এরকম একটা বয়ান চলেই আসে। তো, সেইখানে আসলে বিচারিক প্রক্রিয়ায় যেটা আসবে বিচারে, সেটাই হবে তার বিচার। কিন্তু, যখন আমাদের আপামর জনগণ… বা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে কিন্তু এটা আছে যে, যখনই বিচার চাওয়া হয়, তখন এমনভাবেই চাওয়া হয় যে, সর্বোচ্চ শাস্তিটা দেওয়া হোক তাকে। কারণ, এই যে অপরাধগুলো, এই যে মানবতার লঙ্ঘনগুলো, এইগুলো আসলে, বিগত ১৫ বছরে তো আমরা দেখেছি, মানুষকে টর্চার, হত্যা, গুম, খুন, এরপরে আবার জুলাইয়ে দেখেছি আমরা। যে নির্বিচারে ছাত্র, জনতা, মজদুর ভাইদেরকে কেমনভাবে নির্বিচারে গুলি করা হত্যা হয়েছে। তো, সেই জায়গা থেকে ওই মানসিক পরিস্থিতি থেকে আসলে আমার দেশ এখনো তো বের হয়ে আসতে পারেনি। এটা ম্যাসিভ ট্রমা, পুরো বাংলাদেশে, এতগুলা জেনারেশন আমাদের কিন্তু বয়ে বেড়াতে হবে। ওইখান থেকে এই বয়ানটা থাকে। কিন্তু আমরা চাই, এটলিস্ট আমরা চাই যে, যারা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলি বা বলতে চাই বা এই পয়েন্টটা জারি রাখতে চাই যে, সুষ্ঠ একটা বিচার হোক এবং এমন কোনো অসঙ্গতি আমরা দেখতে চাই না, যেখানে পরবর্তীতে এই বিচার নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারে।
বীথি: আমরা নানান সময়ে এই ধরনের কথা শুনেছি যে, র্যাব ও ডিজিএফআইকে যেন বিলুপ্ত করা হয়, বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আপনার এই বিষয়ে মন্তব্য কি?
তুলি: প্রথম থেকেই, যখন থেকেই প্রমাণিত হচ্ছিল যে, আমাদের ভাইদেরকে গুম করা হয়েছে, র্যাবের বাহিনী করছে এবং আমরা দেখেছিও নির্বিচারে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের সাথে ইনভল্ব। র্যাবকে ব্যান করার জন্য আমাদের এ ডাক ছিলই, আমাদের প্রপোজালের মধ্যে, আমাদের যত চাওয়া ছিল, ডিমান্ডগুলো ছিল তার মধ্যে। আর এই মেকানিজমগুলোতে যে যে বাহিনীগুলো ছিল, ডিজিএফআই বলেন, র্যাব বলেন, আদৌ তাদের দরকার আছে কি না, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে, প্রশাসনিক কাজ চালানোর ক্ষেত্রে? কারণ এযাবৎকালে, ১৫ বছরে আমরা তাদেরকে আসলে কোনো কনস্ট্রাক্টিভ কাজ করতে দেখিনি। তাদেরকে বরং দেখেছি যে, রাষ্ট্রের নিপীড়ক হয়ে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের ক্ষেত্রে ইউজ করা হয়েছে তাদেরকে। এবং সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে, এরকম চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো তাদের দ্বারা করানো হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিক কাজে তাদেরকে এনগেজ করার কথা ছিল, সেই কাজটা আসলে আমরা করতে দেখিনি তাদেরকে। তো, আমাদের পক্ষ থেকে আসলে মনে হয় ডিজিএফআই-র্যাব, দুইটার কোনটারই দরকার নেই বাংলাদেশে।
বীথি: অনেকেই আমরা দেখেছি যে, জুলাই আন্দোলনের পরে যখন বেশকিছু ব্যক্তি গোপন বন্দিশালাগুলো থেকে বের হয়ে আসলেন এবং অনেকেই মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন… কিন্তু এক ধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি যে, এগুলো কিছু ছিল না। যেমন একজন বন্দীকে আমরা দেখেছিলাম যে, তার যে গামছা, সেটা অনেক নতুন মনে হচ্ছিল। তো, তখন সবাই এক ধরনের… একটা গোষ্ঠীর মানুষ বলা শুরু করলো যে, এগুলো আসলে বানোয়াট, মিথ্যা, সাজানো নাটক। তো, একজন সংগঠক হিসেবে এবং মায়ের ডাকের মতো একটা সংগঠনের সংগঠক হিসেবে আপনি যখন এই ধরনের বয়ান দেখেন, এই ধরনের সমালোচনা দেখেন, তখন আপনার আসলে কী মনে হয়?
তুলি: আমার যেটা মনে হয়… কারণ আমি তো এখনো দেখছি… সিক্রেট ডিটেনশন সেলগুলো ওপেন হওয়ার পরে যারা বের হয়ে আসলেন, আমরা যখন পাঁচ ছয় সাত তারিখ ডিজিএফআই অফিস ঘেরাও করি, ওই সময়টাতে এনারা বের হন। তো, তাদের আসার পরের যে বয়ানটা এবং বিগত ১৫ বছরে আমি দেখেছি যে, একটা টাইপের বয়ান থাকে যে, এরকম কিছু হচ্ছে না। গুম বলে তো আসলে কিছু নাই বা সিক্রেট ডিটেনশন সেল বলে আসলে কিছু নাই। এবং এটা আমার মনে হয় একটা পার্টিকুলার গোষ্ঠী দ্বারাই এটা পরিচালনা করা হয়। আপনি যদি এই জায়গাটা থেকে দেখেন যে, আওয়ামী লীগ… আজ শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন…এবং তার পিছনে যে অংশ, লেজ আর মাথা… যে সমস্ত জায়গায় জায়গায় রেখে গেছে, দেশে, দেশের বাইরে, বিভিন্ন জায়গায়… এবং যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে গেছে তারা… তো, তারা এত বড় একটা সময়, এত বড় একটা পিরিয়ড ক্ষমতায় থাকার পরে, ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলার পরে এই সত্যগুলো সামনে আসা শুরু হলো, যে মানুষগুলো সিক্রেট ডিটেনশন সেলগুলো থেকে আসছে, তাদের… মানে, আমি কি বলবো আসলে, এই মানুষগুলোকে আমার মানুষ বলে মনে হয় না, কারণ যারা মোরালি ওইটা সাপোর্ট করতো, গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে এবং তারা রাজনৈতিকভাবে তখন তাদেরকে মনে করেন, ওইটার বৈধতা দেয়াটা… এবং এই যে মানুষগুলো এখনো এই যে, আয়নাঘর নেই বলে প্রচার করছে না? যে মানুষগুলো এখনো হাহা রি-এক্ট দেয় আয়নাঘরের কোনো ডকুমেন্টরি বা কোনো নিউজ গেলে, যে মানুষগুলো এখনো বের হয়ে আসছে, যারা গুম হয়েছিলো, তাদের বয়ান বা ভাষ্যের পরে, আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখি, অনেক অনেক কমেন্ট আসছে। তো, এই যে প্রপাগান্ডাটা চালানো হয় না? যেটা চালানো হয়, এটা আমরা আগেও দেখেছি। এটা যে ১৫ বছর দেখিনি, তা না। সে মানুষগুলো এখন এটা আরেকটু বড়ভাবে, বিশদভাবে করে, কারণ হচ্ছে, বাইরে থেকে এই মেকানিজমটা চালানোর মতো বিশাল অর্থ তাদের কাছে আছে। আর, তাদের এখন কাজটাই তো সেটা, মিথ্যাটাকে কীভাবে করে সামনে এনে এটলিস্ট মানুষের মাঝখানে কতটুকু কনফিউশন ক্রিয়েট করা যায়?
বীথি: যাদেরকে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা ছিল, তাদের কি কোনো সন্ধান আপনারা পাচ্ছেন? বা গুম কমিশন তৈরি হলো, গুম কমিশন তাদের প্রতিবেদন তৈরি করছে এবং এখনো তারা এগুলো নিয়ে কাজ করছে, প্রশ্নটা হচ্ছে যে, আর যারা বন্দী ছিল, তারা আসলে কোথায়?
তুলি: এই প্রশ্নটা অনেক ভারি, আমার জন্য, অনেক ভারি। ১৫ বছর ধরে আমরা যখন রাস্তায় দাঁড়াই, তখন এই আশাটা নিয়ে দাঁড়াই যে… আমি সবার ছোট আমার পরিবারের… আমার ভাই আমার বড় ছিল। আমার মত যারা দাঁড়ায়, যে বাচ্চাগুলো ১২ বছর ধরে দাঁড়াচ্ছে আমার সাথে, তিন বছর ছিল, ওরা এখন হাই স্কুলে যায়, কিছু ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। ভাবীদেরকে দেখছি যে, ১২ বছর দাঁড়াচ্ছে, মা তখন খুব স্ট্রং, এখন কিন্তু হাঁটতে পারেন না… একটা অনেক বড় অংশ জীবনের… তখন আশাটা ছিলো যে, সিক্রেট ডিটেনশন সেলে তো নিয়ে গেছে, তো, এই মানুষগুলোকে কবে ফিরে পাবো? হাসিনা চলে গেলেই ফিরে পাবো— এরকম একটা আশা আমাদের মধ্যে ছিলো। সেই আশাটা… তখন খুব আনন্দ নিয়ে আশাটা ছিলো। সাহস নিয়ে দাঁড়াতাম খুব। আর আগস্টের পর যেটা হলো… ৫ আগস্টের পরে পরিবর্তন হয়ে দেশে। আমাদের যেটা, আমরা এই যে এতগুলা পরিবার, ভিকটিম ফ্যামিলি যারা, এই যে গুমের শিকার বলেন, প্রত্যেকটা মানুষের ক্ষেত্রে যেটা হলো যে, যারা ফেরত আসলেন… আমরা খুব বেশি নাম্বার দেখলাম না ফেরত আসতে, পাঁচ তারিখের পরে। যে আশাটা ছিলো… এনারা ফেরত আসার পরে, আপনাদের যেমন প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, অনেক মানুষ ছিল… এনারা ফেরত আসার পরেও ভিকটিমরা বলতেছেন যে, উনারা অনেকজনকে দেখেছেন সিক্রেট ডিটেনশন সেলগুলাতে। এবং সেলগুলো শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট বা এমন জায়গায় না, সেলগুলো সারা দেশব্যাপী। যেখানেই র্যাবের অফিস ছিল, যেখানেই পুলিশের অফিস ছিল, যেখানেই অন্য কোনো বাহিনী ছিল, সবখানে তাদের মেকানিজম কাজ করেছে। এখন, যে মানুষগুলো এখনো মিসিং, যারা গুম হয়ে যাওয়ার পরে একযুগ হয়ে গেছে, পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেছে, এখনো আসেনি, সেই মানুষগুলো কোথায়? এই প্রশ্নটা আসলে… বললাম যে, ৫ আগস্ট পর্যন্ত আশাটা নিয়ে দাঁড়াতাম, তখন মনে হতো যে, জীবন যতক্ষণ আছে যতক্ষণ পর্যন্ত লড়ে যাবো। ৫ আগস্টের পর থেকে এটা আমার জন্য, আমাদের জন্য অনেক বড় একটা, বিশাল রকমের একটা ট্রমা। প্রতিদিন মনে হয় যে, একটা বীভৎস রকমের সত্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সিক্রেট ডিটেনশন সেলগুলো যখন সামনে আসলো, প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে, আমাদের যারা গিয়েছিলেন, সেই সেলগুলো সামনে আসার পরে… এবং যারা সার্ভাইভার ওখান থেকে বেঁচে ফিরেছেন, তাদের মুখ থেকে শোনা… যে পরিমাণ টর্চার, কী প্রক্রিয়ায় টর্চার করা হয়েছে তাদেরকে। এবং যে পরিমাণ মানুষ ছিলেন ওখানে, যে মানুষগুলো ওখানে থাকার ইয়ে (প্রমাণ) পাওয়া গেছে, সে মানুষগুলোকে এখন যাচ্ছে না। কে কী করেছে সেটাও এখনো প্রমাণিত হয় নাই।
বীথি: গুম কমিশন, তাদের যে সামর্থ্য ছিল, সে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করেছে, কিন্তু তারপরেও তারা খুঁজে পায়নি… বা গুম কমিশনের কাজ নিয়ে আপনার কোনো সমালোচনা… বা আশা-হতাশা কিছু আছে?
তুলি: সেটা তো অবশ্যই। কারণ, আমাদের সবার এত বছরের একটা প্রতীক্ষার পরে একটা ইনকোয়ারি করার জায়গা বাংলাদেশে ক্রিয়েট হলো, ফাইনালি আগস্টের পরে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমাদের আবেদন, তথ্য, যার যেখানে যা ছিল, জিডি– জেনারেল ডায়েরি, সবকিছু মিলিয়ে সেখানে সাবমিট করা হয়। এবং এখানে নাম্বারটা দেখেন ১৮৫০- এর মতো একটা নাম্বার এসেছে। কমিশনের ক্যাপাবিলিটি এন্ড ক্যাপাসিটি নিয়ে আমাদের যে আশা ছিল, সে আশা তো অবশ্যই… মানে ওই জায়গায় আমরা যেতে পারিনি। এক্সপেক্টেশনের জায়গায় আমরা যেতে পারিনি। কারণ, কমিশনকে অত বেশি এখতিয়ার দেওয়াও হয়নি । কমিশনকে কাজটা দিয়েছে হয়তো, যে ওই কেসটা আইডেন্টিফাই করা, ইনকোয়ারি করা… ইভেন ওইটাকে যে বিচারিক প্রক্রিয়া নেওয়ার জন্য কানেক্ট করা, সেটাও তাদের দায়িত্বে পড়ে না বা এখতিয়ারের মধ্যে নাই। আইডেন্টিফাই এটলিস্ট করা… কেসগুলোকে, ইভেন যারা মিসিং আছেন এখনো, সে জায়গাগুলোতে আমরা আসলে এখনো পর্যন্ত… তারা ওই আইডেন্টিফাইয়ের জায়গাটাতে আসতেই পারেননি। বিগত ১২ বছর ১৩ বছর যারা আন্দোলন করে আসছি, আমরা রাস্তায়, তারা ওই জায়গায় রয়ে গেছি। তথ্যগুলো আসলে আমরা জানতাম, কোন কোন বাহিনী নিয়েছে, কিন্তু স্পেসিফিক, এই যে, একটা ইনস্টিটিউশন দ্বারা আইডেন্টিফাই করা, করে জানানোটা… আর প্রত্যেকটা পরিবারের তো আসলে অধিকার আছে জানার, তাদের স্বজন, তার সাথে কী হয়েছিল বা উনাকে কে ধরে নিয়ে গেল… তারপরে আমরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় যাব। কিন্তু আইডেন্টিফাই করার… অনেকদিন তো পার হলো… দশ মাস তো…
বীথি: আইডেন্টিফাই কেন করতে পারলেন না? কোন জায়গাটা আসলে খামতি ছিল?
তুলি: অনেক বড় একটা… কী বলব… যারা এর পিছনে ছিলেন, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা বাহিনী… তারা কিন্তু এখনো… অনেক মানুষ ইউনিফর্মে ওই জায়গায় রয়ে গেছেন, যারা ওখানে প্রমোটেড হয়েছেন। তারা পোস্টিং পেয়েছেন, রিটায়ারমেন্টে আছেন কিছু… কিন্তু সবগুলো মানুষ তো আর পালিয়ে যায়নি। কিছু মানুষ তো পালিয়ে গেছে, আমরা জানি। ইভেন তাদের অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট যাওয়ার পরেও পালিয়ে যেতে পারে তারা। এরকম দেখা গেছে যে, যারা এটার পেছনে ছিল, সে মানুষগুলো তো এখনো আছে আমার দেশে। তারা সার্ভিং এখনো। সেই জায়গা থেকে আসলে মানুষকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা, যখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীদ্বারা এত বড় একটা ক্রাইম হয়, ক্রাইমগুলো… এরকম হাজারো মানুষের সাথে। যারা মিসিং… এখনো ফেরত আসেনি, যারা গুম হয়ে ছিল, টর্চার করেছিল তাদেরকে মিথ্যা মামলায় জেলে দেওয়া হয়েছে… সারভাইভাররা… এই নাম্বারটা ম্যাসিভ। এই নাম্বারটাতে যখন, যে বাহিনী, যে মানুষগুলো ইনভল্ব ছিল, তাদের সংখ্যাও কম না। যে বাহিনী তুলে নিয়ে আসতো, আরেকটা লেয়ার তাদেরকে হ্যান্ডওভার করতো, আরেকটা লেয়ার তাদেরকে কাস্টোডিতে রাখতো, একটা লেয়ার তাদেরকে টর্চার করতো, আরেকটা লেয়ার তাদেরকে পরবর্তীতে কী হবে সেটা নির্ধারণ করতো— সে মানুষটা বেঁচে থাকবে কি থাকবে না… অনেক বড় একটা লেয়ার… কারা ডিরেকশন দিত… তাই না? কমান্ডিং অফিসার কারা ছিল, শেখ হাসিনা পর্যন্ত… এই বিশাল একটা ইয়ের (কমোন্ডের) মধ্যে যারা যারা ছিল, এই মানুষগুলো তো চলে যায়নি। অনেকটা রয়ে গেছে, অনেক বেশি সহজ হচ্ছে না তথ্যগুলো আনা।
বীথি: আপনার কি মনে হয় যে, রাষ্ট্র আসলে কোনোভাবে এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে বা তাদেরকে কোনোভাবে সুরক্ষা দিচ্ছে? বা আপনারা যারা, পরিবারগুলো রয়েছেন, ভুক্তভোগী পরিবার, তাদের প্রতি কি যথেষ্ট সহানুভূতি দিয়ে রাষ্ট্র আপনাদেরকে সাহায্য-সহায়তা করছে?
তুলি: না। সেই জায়গা থেকে আমরা বলবো যে, না। আমরা একেবারেই আশাহত। কারণ হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যারা এতদিন গুম-খুন করলো, সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করার জন্য ক্যান্টনমেন্টে ৬শ মানুষকে প্রটেকশন দেওয়া হয়েছিল ৫ অগস্টের পরে। সেই মানুষগুলো কোন বাহিনীর? র্যাবের বা ডিজিএফআইয়ের… যারাই, জানি না কেন, ওই সময়কালের মধ্যে যারা ছিল, সার্ভিং… কাউকে কিন্তু এসে আমরা এখানে কোনো এভিডেন্স প্রডিউস করতে দেখিনি এখনো। তারা মাফ চাচ্ছে, র্যাব মাফ চাচ্ছে, কিন্তু কয়টা ঘটনার ক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তারা সামনে এগিয়ে এসেছেন? আসেননি কিন্তু।
বীথি: আমরা জানি যে, বিগত ১৫ বছর বা তিনটা যে টার্মের কথা বললেন, তখন তো আপনাদের এক ধরনের হতাশা ছিল, ভয় ছিল, ক্ষোভ ছিল, এবং ৫ আগস্টের যে একটা বড় ধরনের আন্দোলনের মুখে সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে চলে গেলেন… এরপরে যে দুই চারজন… যারাই বের হয়ে আসলো, তারপরে তো সবাই খুব আশায় বুক বেঁধেছিলো যে, প্রত্যেকে তাদের স্বজনদের আবারো ফিরে পাবেন। সেখান থেকে এখন তো তারা নাই। তাহলে এই ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সামাজিক এবং মানসিক যে সুরক্ষা, সেটাকে কোনোভাবে আসলে নিশ্চিত করা যাচ্ছে কি না? বা যদি না করা যায়, তাহলে এটা কাদের ব্যর্থতা?
তুলি: অবশ্যই আমি বলবো যে, এটা প্রথম ও প্রধান প্রায়োরিটি ছিল এখনকার যে ইন্টারিম এসেছে, সরকার… তাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ছিল যে, যারা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার, এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব নেওয়া। ১৫ বছরে যারা গুম-খুন হয়েছে জুলাইসহ… সেই জায়গা থেকে আসলে কতটুকু করা হয়েছে? আর আপনি যেটা বললেন যে, মানসিক ট্রমা এবং বিহ্যাবিলিটেশন যে ব্যবস্থা, সেটা। সেটাতে পরে আসছি। প্রথম ও প্রধান কাজ যেটা, বিচারিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, সত্যটাকে সামনে আনা, যেটা মানসিকভাবে হয়তো ওই পরিবারগুলোকে একটা জায়গায় নিয়ে যেত। আমরা প্রতিদিন প্রতিরাত এখনো অপেক্ষা করে আছি এবং প্রতিদিন ওই সিক্রেট ডিটেনশন সেলের ওয়ালের যে দাগ খুঁজি, যে যেখানে যেতে পারে, দেখে যে, দেওয়ালে আসলে কার নাম লেখা। ওইখানে দাঁড়ানোর পরে মনে হয় যে, এই যে, যে জায়গায় আমারই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ৩০ মিনিট দাঁড়াতে পারি না, এখানে আমার ভাই কতদিন ছিল? ভয়ঙ্কর রকম একটা…যে সামাজিক অবস্থা… এই যে বীভৎস চেহারাটা… এটা আসলে… এটা নিয়েই কিন্তু আমরা সামনে যাচ্ছি। আমার সারা জীবন… আমার শেষ দিন পর্যন্ত আমার ভিতরে এটাই কাজ করবে যে, আমার ভাইকে ওখানেই তারা রেখেছিল। রাখার পরে পরবর্তীতে হয়তো সত্যগুলো আরো সামনে আসবে যে, তার সাথে কী করা হয়েছিল।
তো, এদের ক্ষেত্রে… যে পরিবারগুলোর কথা বলছেন, বেশিরভাগ পরিবারই মার্জিনালাইজড… তাদের ক্ষেত্রে… তিন বেলা মিল ভালোমতো এ্যারেঞ্জ করার ক্ষমতাটাও নাই, যেখানে অনলি আর্নিং মেম্বার ছিল, হয়তো বাবা বা ভাইটা, সন্তনটা, যাদেরকে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। তারা ফেরত আসেনি ১২ বছর তারা অপেক্ষা করছে। তো ১২ বছর পার হওয়াটা অনেক কষ্টেরই ছিল তাদের জন্য… আমাদের জন্য সারভাইভ করে এই পর্যন্ত আসাটা… হয়তো আমরা দাঁড়াতে পেরেছি রাস্তায়। একটা ব্যানার করতে পেরেছি, একটা পোস্টার করতে পেরেছি, একটা জায়গায় দাঁড়াতে পেরেছি। অনেক সময় দাঁড়ানোটা অনেক বেশি কষ্টসাধ্য ছিল। ইন্টেলিজেন্স সার্ভাইলেন্সের জন্য অনেকে অনেক বেশি… কিন্তু প্রত্যেকটা পরিবার… যার হয়তো একবেলা খাওয়ার পরে আরেক বেলা খাওয়ার ঠিক মতো আছে কি না, ঠিক ছিল না, সেও কিন্তু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, ভেতর থেকে ওই তাগাদাটা ছিল, জানবো যে, আমার ভাই বা আমার স্বামী বা আমার বাবা বেঁচে আছে কি না? যে বাচ্চাটা এক বছরের, যে বাচ্চাটা জন্মায়নি… সাফা যখন আমার সাথে দাঁড়ায়, সোহেল ভাইয়ের মেয়ে, ও তখনও জন্মায়নি, সাফা এসে জিজ্ঞেস করে যে, তুলি ফুফু… ৫ আগস্টের পর থেকে তার বাবার বিছানা রেডি করে এসে বাড়িতে, আমাকে বলে যে, বিছানা গুছায়ে রেখে এসেছি, এখন খুঁজে বের করলে হয়তো বাবাকে যদি পেয়ে যাই… এই বাচ্চাদেরকে আমরা কোনো উত্তর দিতে পারিনাই। রাষ্ট্র এর ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে না কখনোই, জাতির ওপর যে ট্রমা যাচ্ছে এবং গেছে বিগত ১৫ বছরে, এটার ক্ষতিপূরণ হয় না। কিন্তু রাষ্ট্র যেটা মিনিমাম করতে পারে, এই যে, এই পরিবার যারা, তাদের সন্তানগুলোর শিক্ষা, তাদের বাঁচার জন্য… যেমন তারা ব্যাংক রিলেটেড কাজগুলো করতে পারছে না, তার জন্য কোনো ব্যবস্থা… স্পেশাল কোনো ল-এর ব্যবস্থা করা… যেটাতে তারা এই কাজগুলো করতে পারবে এবং প্রপার্টি রিলেটেড, ব্যাংক রিলেটেড…
বীথি: ব্যাংক রিলেটেড কাজ… আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন? মানে কী ধরনের…
তুলি: গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রে, তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টটা আর কোনো কাজ… ফাংশনাল থাকে না। এবং সেখান থেকে তার পরিবার কোনো টাকা উঠাতে পারে না, নিতেও পারছে না। এবং পরবর্তীতে ওইটা ওইভাবেই পড়ে থাকছে। বাবার যদি অনেক টাকা থেকেও থাকে, তার সন্তান কিন্তু ওইখানে অর্ধারে অনাহারে থাকছে, কারণ তার ওইটা দিচ্ছে না। লিগ্যাল প্রসেসে সেটা আটকে যাচ্ছে। সেটা এত পরিবারের সাথে কিন্তু হয়ে চলেছে এত বছর ধরে। প্রপার্টি রিলেটেড যেটা, যেমন, ভাইয়ের ক্ষেত্রে, ভাইয়ের যে প্রপার্টি তিনি পাবেন, সেই প্রপার্টি তাকে তো দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ আমরা তো জানি না, তিনি জীবিত নাকি তিনি জীবিত না। সে ক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, এই দায়িত্বগুলো সরকারের থেকে ডিক্লারেশনগুলো খুব জরুরি দরকার যে, একটা প্রসেসে উনি এতদিন গুম। এটার প্রেক্ষিতে কীভাবে একটা নতুন ফরমেশনে, আইন এনে তাদের এই পরিবারগুলোকে একটা ডকুমেন্টেশনের মধ্যে নেওয়া যায়। আদারওয়াইজ এই প্রসেসগুলোতে তারা কাজ করতে পারছে না। তাদেরকে সারভাইভ করতে হবে তো। অনেক বছর তো, অনেক বছর… তাদেরকে… এই যুদ্ধট শুধু যে মানসিক যুদ্ধ, ট্রামার মধ্যে আছে, তা না। তাদেরকে তো বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তাদেরকে বাচ্চাদেরকে যথাযথ শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটা যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য একটা যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তো, সেই জায়গায় চিকিৎসার জন্য বয়স্ক যে মায়েরা আছেন, তাদেরকে একটা অনেক বড়… প্রত্যেকটা পরিবার… যারা এই বলপূর্বক গুমের শিকার… আমরা দেখেছি যে, রাষ্ট্র কিছু কিছু মানুষের দায়িত্ব নিয়েছে জুলাইতে। এবং সমানভাবে আমার মনে হয় যে, পাশাপাশি, এই যে যারা ভিক্টিম ফ্যামিলি, তাদেরও দায়িত্ব… এগুলো তো রাষ্ট্র কর্তৃক অপরাধ, তাদের সাথে করা হয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব না যে এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব নেওয়া?
বীথি: যে রাজনৈতিক দলই আসুক না কেন, তাদের পক্ষে কি এই বাহিনী বা বাহিনীর সদস্যদেরকে বিচারের আওতায় আনা কি সম্ভব?
তুলি: সেই স্ট্রাগলটা আমরা এখনো দেখছি। রাজনৈতিক দল ছাড়া, যেটা ইন্টেরিম গভর্মেন্ট এখন আছে, তাদের পক্ষেও কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে যে, সেই মানুষগুলোকে সত্যসহ সামনে তুলে ধরে আনা। যেখানে এত হাজারো মানুষকে গুম করে হত্যা করা হলো, তারপরে জুলাইয়ে হত্যা করা হলো, এর মধ্যে তো ম্যাসিভ আকারে এই হত্যাজজ্ঞ চললো। তার সাথে যে বাহিনী জড়িত, সে বাহিনীর ওই নামগুলো… সত্যপ্রকাশ করে আনতে… এ্যারেস্ট তো আরো পরে, সত্যপ্রকাশ করে সেই বয়ানটা সামনে আনাটা অনেক বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। এখানে যে ইনকোয়ারি কমিশনের মতো আরো যত প্রক্রিয়া, সব আটকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ডেফিনেটলি আমার মনে হয় যে, তাদের তো নিজেদের একটা এজেন্ডা থাকে। এবং সেই এজেন্ডার মধ্যে অনেক বড় একটা ইনফ্লুয়েন্সের ব্যাপার থাকে যে, এই বাহিনীগুলোকে তারা কীভাবে হ্যান্ডেল করছে। সেই বাহিনীগুলোর… এটার আশঙ্কাটা সবার মধ্যেই আছে, যে রাজনৈতিক দল আসবে, তারা কীভাবে এটা হ্যান্ডেল করবে? কিন্তু আমরা আশা করবো, যে রাজনৈতিক দলই আসুক না কেন, বিগত সময়ের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের সাথেই হয়েছে। এবং নির্বিচারে, প্রত্যেকটা দলমত নির্বিশেষে, সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট— কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। সেই জায়গা থেকে যদি বিবেচনা করে, তাহলে হয়তো এটাকে তাদের ওভারলুক করার কোনো জায়গা নেই। এই সত্যগুলো সামনে আনাটাই, আমার মনে হয়, সেটা তাদের ক্ষেত্রেও জনগণের সমর্থনের জায়গায় আনার একটা প্রক্রিয়া। কারণ, জনগণ কিন্তু এখন… মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি জুলাইয়ের পরে কিন্তু অনেক বড় একটা পরিবর্তনের জায়গায় এসেছে। সেই জায়গায় আমি যদি বিচার ব্যবস্থায় এমন কোনো পরিবর্তন না আনি বা আমি যদি রিফ্লেকশনটা না আনি, আমার সামনে, আমার পাবলিকের কাছে, এই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন যেটা হয়েছে এবং যে নিপীড়নের শিকার আমরা হয়েছি, এক যুগেরও বেশি সময়, সেটার কোনো বিচার না করি এবং সেটার যথাযথ দায়ভার… যারা করেছিল, যাদের এগেইনেস্টে এলিগেশনগুলো, তাদেরকে আমরা যদি বিচারের আওতায় না আনি, তাহলে আমার মনে হয় না, আমরা যে রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছি বা যে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার এশিওরিটি দিচ্ছি, সেটা করতে পারবো।
বীথি: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো বা সংস্থাগুলো যারা রয়েছে, তারা কি এই ক্ষেত্রে কোনো সাহায্য-সহায়তা করতে পারে? বা করছে কি না আদৌ?
তুলি: বিগত সময়গুলোতে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোই এই বয়ানটা জারি রেখেছিল। কারণ, তখন আমাদের দেশের মধ্যে আমাদের কোনো, ইভেন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এই প্রচারের জায়গা ছিল না, বা কথা বলার কোনো জায়গা ছিল না আমাদের। আর এই ইন্টেমিডেশন, হ্যারাসমেন্ট তো ছিলেই। সেই জায়গা থেকে আমরা যখন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনগুলো আসলো, এবং তারাই কিন্তু এই বয়ানটা আস্তে আস্তে বলা শুরু করলো, সরকারের কাছে জবাব চাওয়া শুরু করলো, ওই একটা জায়গা থেকে আমরা বিগত সময়ে, আমার মনে হয় যে, মানবাধিকার রক্ষার কথাটা বলে আসতে পেরেছি এবং আশা করবো হয়তো সামনের সময়টাতেও সেটা সম্ভব হবে।
বীথি: এই যে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, বিগত দশকগুলোতে, এবং বলপূর্বক অন্তর্ধান এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এই ঘটনাগুলোতে আসলে মিডিয়ার ভূমিকা কী ছিল, কী রকম দেখেছেন তাদেরকে?
তুলি: আপনি যদি দেখেন, আমরা নেত্র নিউজের সাথে যোগাযোগ করতাম লুকিয়ে। তখন নেত্র নিউজের যে ডকুমেন্ট্রি বের হয়েছিল প্রথম, এবং তার আগে গুম নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কোনো কিছু জানতোই না। কথাই বলার কোনো জায়গা ছিলো না। এখন হয়তো আমরা কথা বলতে পারছি, যে কেউ আসছেন, অনেক রিপোর্টার এখন কোনো অনুষ্ঠান হলে থাকেন। কিন্তু ১৫ বছর যখন আমরা করেছি, তখন তাদেরকে…ন্যাশনাল কোনো মিডিয়া বা জার্নালিস্ট আসলে তাদেরকে লুকিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে হয়েছে। এমনও হয়েছে, পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে, তাদেরকে পালিয়ে যেতে হয়েছে, এরকমও হয়েছে। এবং আমরা যখনই কোনো প্রোগ্রাম করবো, কোনো ক্যাম্পেইন দিতাম, হিউম্যান চেইন বা প্রেস কনফারেন্স বা কোন স্পেশাল অকেশনে আমরা দাঁড়াবো একসাথে, তার আগে থেকেই… না, করা যাবে না, আমাদের কোনো ভেন্যু দেওয়া হতো না। মিডিয়ার যে জায়গাটা ছিল, সেই জায়গাটাও এরকমই ছিল, তারা যতটুকু সামনে এসেছে, খুব কম আমি বলব, সেটা যদি পাশাপাশি থাকতো স্ট্রংলি, হয়তো আমরা আরো একটু কঠোরভাবে বিচারের জায়গায় যেতে পারতাম, অনেক আগেই। সামনে সত্যগুলো আনা সম্ভব হতো। মিডিয়ার ক্ষেত্রে আসলে যে জায়গায় থাকার কথা, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তারা কোনো কথা বলতে পারেনি তখন।
বীথি: আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন, আপনার কি এই ধরনের স্বপ্ন রয়েছে, যখন রাষ্ট্র এই ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করে, দায় স্বীকার করবে এবং পরিবারগুলোকে সেই সান্ত্বনা বা সহানুভূতি বা সহমর্মিতার সঙ্গে দেখবে?
তুলি: স্বপ্নটা আছে। স্বপ্নটা আমরা প্রতিদিন দেখি। প্রতিদিনই দেখি, প্রতিদিন চিন্তা করি, রাতে, আমরা যখন একসাথে হই, মায়ের ডাকে, যে পরিবারগুলো… অনেকদিন তো একসাথে… কষ্টটা ভিতর থেকে আসে, যখন আমরা কাঁদি না? সবাই দেখা যায়… একই.. একই… কান্নাটা আসলে একই রকম সবার। কারণ ব্যথাটা, কষ্টটা একই রকম। ওই ব্যথাটা বুঝি দেখেই মনে হয় যে, প্রত্যেকটা পরিবারকে ওই জায়গাটা দেখিয়ে দিক, আঙ্গুল দিয়ে, যেহেতু উনার সন্তানের সাথে… আমার মাকে দেখাক… উনি যতদিন বেঁচে আছেন, উনার জানা দরকার যে, মা, সুমন ভাই হয়তো ওখানে ছিল, ওই সেলে ছিল, তার পরবর্তীতে তার সাথে কী হয়েছে? রাষ্ট্র… তার সাথে… কারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে… আমার মায়ের মত যত মা আছে, যত শত সন্তান আছে, এই যে যত পরিবার আছে, তাদেরকে হাত তুলে মোনাজাত করার জন্য বলে দিক, উনারা কী বলবে আল্লাহর কাছে? সন্তানের জন্য… এই পারের কথা বলবে, না পরকালের কথা বলবে, কী বলবে, কী বলে দোয়া করবে?
বীথি: ধন্যবাদ আপনাকে সানজিদা ইসলাম তুলি, আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।
তুলি: ধন্যবাদ আপনাকে, ধন্যবাদ নেত্র নিউজকে, বিগত সময়ে আমাদের সাথে থাকার জন্য, এখনো থাকার জন্য। আশা করি সামনের সময়টাতেও থাকবে।