জুমারদের রাজনৈতিক দলের আদর্শ কি?

ছাত্র-নেতৃত্বের নতুন রাজনৈতিক দল কত দূর যাবে? তাদের কি উপমহাদেশের নিকট অতীতের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে না?

জুমারদের রাজনৈতিক দলের আদর্শ কি?

দুর্নীতিগ্রস্ত বড় দুই রাজনৈতিক দলের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে নতুন যে দলটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে সেটি শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খেলো। এর পরও দলটির পত্তন হওয়ার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। দুর্বলতর অবস্থাতেই টিকে থাকছে সে সম্ভাবনা। জুমারদের (জেন জি, যাদের জন্ম ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে) এ উদ্যোগ বাংলাদেশের ভোটতন্ত্রের জলাভূমিতে নিঃসন্দেহে নতুন রাজনৈতিক যাত্রার হাতছানি তৈরি করছে।

উত্তর ভারতের আম আদমি পার্টির (এএপি) কথা মনে আছে। ২০১২ সালে, যখন আরব বসন্ত এবং “অকুপাইড ওয়াল স্ট্রিট” আন্দোলনের হাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছিলো তখন নতুন এ দলটির আকস্মিক উদ্ভব শহুরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছিল। দলটির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার “পরিবর্তন” আন্দোলনের জন্য মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতেছিলেন। কেজরিওয়ালের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে তার সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে। ঘটনাক্রমে একই বছর মুহাম্মদ ইউনূস তার নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন।

কেজরিওয়াল ২০১১ সালে আন্না হাজারের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। সংবাদপত্র “দ্য প্রিন্ট”-এর মতে, সেই সময়ে দেশে দেশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলনকে তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে অবাধে তুলনা করা হতো। সমাজকর্মী হাজারে চেয়েছিলেন তাদের আন্দোলনটিকে স্রেফ রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চালিয়ে যেতে, অপরদিকে উচ্চাভিলাষী কেজরিওয়াল চেয়েছিলেন সরাসরি নির্বাচনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে। ২০১২ সালের নভেম্বরে তার সে লক্ষ পূরণ হয়েছিলো।

ভারতের অ-বিজেপি এবং অ-কংগ্রেস শিবির প্রথমবারের মতো কেজরিওয়ালকে একজন নতুন জাতীয় নেতা হিসাবে দেখতে শুরু করে, এমনকি তাকে প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার মতো যোগ্য বলেও ভাবা হয়।

তাদের আদর্শ কী ছিল?

শুরুতে দলটির কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ছিল না। কেজরিওয়ালের মতে, “আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা যদি বামে সমাধান খুঁজে পাই, আমরা সেখান থেকে ধার করবো, আর যদি ডানে সমাধান খুঁজে পাই, আমরা সেখান থেকেও ধার করবো।" এ নেতার মূল আদর্শের তিনটি স্তম্ভ ছিল— "অগাধ  দেশপ্রেম, দৃঢ় সততা এবং মানবতা"। এটি কোনো আদর্শ নয়। এটি মূলত মূল্যবোধের বিবৃতি মাত্র।

ডান এবং বাম থেকে ধার নেওয়ার ইচ্ছার কারণে কেউ এটিকে ডিফল্টরূপে “সেন্ট্রিস্ট” বা মধ্যপন্থা বলতে পারি। যদি কোনো মতাদর্শ থেকে থাকে তাহলে তাকে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে: দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এটি কীভাবে অপকর্ম নির্মূল করবে সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য নেই এই নীতিতে। 

আম আদমি পাটি আম্বানি এবং আদানির বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার অভিযোগ করেছিলো। যদিও কীভাবে তারা পাল্টা প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছিলো তা স্পষ্ট করেনি। তবে এটিকে, ভারত একটি “কালার রেভ্যুলেশনের” সন্নিকটে বলে বিবৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

দিল্লিতে স্থানীয় নির্বাচনে বিজয় এবং পাঞ্জাবে রাজ্য বিজয় সত্ত্বেও আম আদমি পাটি কখনোই একটি দেশব্যাপী উল্লেখযোগ্য শক্তি হয়ে ওঠেনি। এক দশক পরে সংসদে ৫৪৩ আসনের মধ্যে তারা মাত্র তিনটি আসন লাভ করে। এখন দিল্লিও হাতাছাড়া হয়েছে।

নতুন বাংলাদেশ কোন পথে?

জাতীয় নাগরিক কমিটি সম্প্রতি একটি জনসমাবেশ ডাকে যেখানে ফরহাদ মজহার বক্তৃতা করেন এবং তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তাদের মতাদর্শ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ঘোষণার বিলম্ব নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি “জনগণের সার্বভৌমত্বকে” দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দেন কমিটির নেতৃবৃন্দকে। এ ঘটনার গভীর ও মৌলিক তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু এ পরামর্শ কি সত্যিই নেওয়ার মতো? 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি একটি বাহাস চোখে পড়েছে, যেখানে রাজনৈতিক নানা বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেমন শাপলা চত্বর বনাম শাহবাগের দ্বন্দ্ব। ফরহাদ মজহারকে উগ্র রাজনীতির আদর্শ ধারক হিসেবে এসব আলোচনায় চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আহসান মনসুরের রক্ষণশীল টেকনোক্রেসির সঙ্গেও তার তুলনা করতে দেখা গেছে। যদিও এসব আলাপে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের জীবন উন্নত করা হবে, তা উঠে এসেছে। তবে সঙ্কটপূর্ণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসব আলাপ খুব একটা অগ্রাধিকার পাবে না—এমন শঙ্কা রয়েছে। 

দেখা গেছে, বিগত শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর ছাত্ররা দেরি না করে পুরানো, বিশেষ করে প্রবীণ গোষ্ঠীর কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। বয়সে নয়, মানসিকতায় প্রবীণ্য দরকার ছিলো সরকারে।  অথচ অর্থনৈতিক, আর্থিক ও শিল্প উন্নয়ন টেকনোক্র্যাটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। পরে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে—নয়া উদারবাদী অর্থনীতির থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক এবং শিল্পপতিরাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মনসুরের বিরুদ্ধাচরণ করছেন।

জুমাররা তাদের নিজস্ব মতাদর্শে বিশ্বাস করা টেকনোক্র্যাটদের কাছ থেকে ক্ষমতার অর্থনৈতিক শক্তি ধার করেছে। এটি নিরপেক্ষ নয়, নিছক প্রযুক্তিগতও নয়। যদিও এটি আর্জেন্টিনার চেইনসো মিলি নয় এবং ভিয়েতনামের মতো রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ও শিল্প-শাসনও নয়। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কৃতি, পরিচয় এবং "সঠিক" ইতিহাস সংস্করণের দিক থেকে পরস্পর আলাদা। অর্থনীতিতে খুব সামান্যই পার্থক্য আছে। কার্যত এটিকে জনগণের সার্বভৌমত্ব বলা যায় না।

শ্রীলঙ্কা তাদের নিজেদের বড় দুই রাজনৈতিক দলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েককে আইএমএফ এবং পশ্চিমা শকুন তহবিলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নির্বাচিত করা হয়। মাঝারি মেয়াদে এটা কতটা র‌্যাডিক্যাল ফল বয়ে আনবে তা স্পষ্ট নয়। যা-হোক, দেশটির একটি ছোট র‌্যাডিক্যাল দল (দশকের পর দশক ধরে অস্থিরতার পর) সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থনৈতিক টিকে থাকার উপর ভিত্তি করে একটি জোট গঠন করতে সক্ষম হয়। জোটটি সংস্কৃতি ও পরিচয়ের উপর কম নির্ভর করে এবং আইএমএফ কঠোর কৃচ্ছ্রতা থেকে মুক্ত।

রাজনৈতিক চক্রে বাংলাদেশের চেয়ে বছর দুয়েক এগিয়ে শ্রীলঙ্কা। তারা রাজাপাকসেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল কিন্তু তার পরে সামান্য পরিবর্তনও দেখতে পায়নি দেশটি। একই ধরনের অবস্থা কি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে?

দিল্লিতে ফিরে আম আদমি পাটি সম্পর্কে “দ্য প্রিন্ট” বলেছিলো, “আদর্শ-মুক্ত রাজনীতির যুগ এখন প্রায় শেষ। প্রায় পনেরো বছর ধরে কেজরিওয়াল কোনো আদর্শিক স্তম্ভ বা ভিত্তি ছাড়াই একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছিলেন এবং এটি ছিলো ইচ্ছাকৃত। তিনি একটি বিদ্রোহী দল তৈরি করেছিলেন যা রাস্তার প্রতিবাদ এবং শহরের মধ্যবিত্তের ক্ষোভ থেকে বিকশিত হয়েছিলো।”

জাতীয় নাগরিক কমিটির কি কোনো আদর্শ আছে?

১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের সাক্ষাৎকার নেয় দ্য ডেইলি স্টার। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, তাদের নতুন দল প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের উপর ফোকাস করবে (যদিও তিনি পরে উল্লেখ করেছিলেন, তারা ভোটারদের বাইপোলার রাজনীতিতে অনুৎসাহিত করতে চায়)। ধারবাহিক প্রশ্নের অংশ হিসেবে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে, সরকার গ্রামীণ এলাকার সাথে সংযোগ স্থাপনে হিমশিম খাচ্ছে কি না। তার জবাব ছিলো চমকপ্রদ— “সত্যিকার অর্থে জনগণের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই বাধাগুলো (আমলাতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা) অতিক্রম করতে হবে এবং জনগণের সাথে আরও কার্যকরভাবে জড়িত হতে হবে”।

নতুন দলের মূল মতাদর্শ এবং নীতিগুলো কি জানতে চাওয়া হলে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন— “এক  লক্ষেরও বেশি লোক অনলাইনে তাদের মতামত জানিয়েছে। আমরা এখন দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র এবং কর্মসূচির খসড়া তৈরির কাজ করছি, পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করছি।”

বাগাড়াম্বরে আচ্ছন্ন হয়ে কেউ কি ভাবছেন যে, জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ও বিশ্বদর্শন আছে? এখানে আসলে অস্বস্তিকরভাবে কেজরিওয়ালের অ-মতাদর্শিক, অ-প্রত্যয়মূলক এবং তথাকথিত কেন্দ্রবাদী রাজনীতিরই মিল পাওয়া যায়। এক লাখ উত্তরদাতার মধ্যে কতজন রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, কারখানার হাত, কৃষক, বিদেশি শ্রমিক, নার্স, পরিবহন শ্রমিক এবং অন্যরা ছিলেন? অন্যভাবে বললে বলতে হয়— উত্তরদাতাদের শ্রেণিবিন্যাস কি? 

এদের মধ্যে নতুন মধ্য-ডানপন্থী দলের সব শর্তই বিদ্যমান। দৃশ্যত এর কেন্দ্র রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী। অর্থনৈতিকভাবে ডানপন্থী, যদিও ছাত্ররা এ বিষয়ে অবগত নন।

 বতমান পরিস্থিতি যে আভাস দিচ্ছে তার বাস্তবায়ন হলে আমরা অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আনু মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন পাবো না। এতে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ, ভোক্তাদের ক্ষোভ, কৃষকের দুর্দশা এবং বেকারদের নতুন চাকরির দাবি ঘনীভূত হবে এবং উদ্বেগ বাড়াবে।

মনে রাখা দরকার, বাস্তবে কেজরিওয়াল আদানি সম্পর্কে কিছু করতে চাননি। এটা ছিল স্রেফ ভান। খবরের শিরোনাম-সন্ধানী লোকরঞ্জনবাদী পদক্ষেপ ছিল মাত্র। কিন্তু নতুন বাংলাদেশের নিশ্চয়ই জ্বালানির উচ্চ দাম এবং সার্বভৌমত্ব হারানো ইস্যুতে আদানির বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত! তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কল্পনাতীত রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আজ স্পষ্ট। ফুলবাড়ী, রূপপুর, রামপাল আন্দোলনসহ অন্য ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো লড়াই নয়।

আমরা ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা অনেক শুনেছি। ইতিমধ্যে এটা আমাদের আছে। প্রজাতন্ত্রের পাঁচ দশকের মধ্যে চার দশক ধরেই একটি অসম সমাজ বজায় রাখার বিষয়ে দুই দলই ঐকমত্য দেখিয়েছে। অদৃশ্য দারিদ্র্যের বিপরীতে সম্পদের প্রাচুর্য, গ্রামীণ অঞ্চলকে অবহেলার বিনিময়ে নগর-কেন্দ্রিক উন্নয়ন, নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য— ৫ আগস্ট কি এই বাস্তবতায় কোনো পরিবর্তন এনেছে?

২০৩০-এর দিকে যাত্রা 

দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের পর একটি আদর্শকে ধারণ করে একটি জোটের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

সম্ভবত, প্ল্যান ‘এ’ ছিল চার বছরের মেয়াদী। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে আসে সে মুহূর্তেই সেটা শেষ হয়ে যায়। আর সম্ভাব্য প্ল্যান ‘বি’ হলো, বিএনপিকে নিজেদের বিতর্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ঠ সময় দেওয়া। অর্থাৎ প্রত্যাশিতভাবে বিএনপির হাতে বিশৃঙ্খল অর্থনীতি সামলানোর চাপ চলে আসবে এবং তাতে বর্তমান সময়ের মতোই অব্যবস্থাপনা প্রকট হবে। ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী অসন্তোষ ও জনরোষ তৈরি হবে। তারপর হয়তো আরেকটি গণঅভ্যুথান, অথবা আরও একটি এক-এগারো!●

ফরিদ এরকিজিয়া বখত একজন লেখক ও বিশ্লেষক।