নারীরা কোথায় হারিয়ে গেল?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীদের গায়েব করে ফেলার মাধ্যমে আমাদের অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার মত অবস্থা তৈরি করছে। এ ধরনের ঘোর পিতৃতান্ত্রিক বাস্তবতা এ দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে ঠাঁই পাবে না। নারীরা তা হতে দেবে না।

নারী অধিকারের পক্ষে যারা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে আসছেন তারা বহুকাল ধরে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের দাবি জানিয়ে আসছেন, যাতে করে এত বছরের প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য অতিক্রম করা যায় এবং যোগ্য নারীরা যাতে জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হতে পারেন। সংরক্ষিত আসনে নারীদের বেছে নেওয়ার বদলে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ আসনে একটি নির্দিষ্ট শতাংশ নারী প্রার্থীর মনোনয়ন নিশ্চিত করার দাবিও উঠেছে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল ক্ষমতার অলি-গলিতে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার একটি সুবর্ণ সুযোগ।
সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা চাই, কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেখে মনে হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনকে তারা এমন সংকীর্ণ সংজ্ঞায় আবদ্ধ করতে চাইছে, যে কার্যত তা অন্যায্য কিছু একটায় পরিণত হবে। জুলাই সনদকে নিয়ে কিছু মহলে ব্যাপক মাতামাতি শোনা যায়— এটি নাকি জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে। অথচ কে বা কারা ঠিক কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা প্রণয়ন করছে তা এখনো অস্পষ্ট। মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ হলেও, এই ঘোষণাপত্র থেকেও নারীরা বাদ পড়ে গেছে। এতে করে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে নারীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বঞ্চিত করা নয়া বাংলাদেশের নিয়ম-নীতির অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। সনদটির ভাষ্য শুনে মনে হবে, এটা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও অন্যান্য শক্তিশালী অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে, যেন খুব অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা রচনা করা হয়েছে। কিন্তু আসলে মোটেই এমন কিছু হয়নি। এইযে নারীদেরকে এভাবে কাঠামোগতভাবে বাইরে ফেলে রাখা, এই চর্চা কিন্তু রাতারাতি শুরু হয়নি।
বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব তরুণী ন্যায়বিচার ও অধিকার রক্ষার জন্য সরকার পতনের লক্ষ্যে অস্তিত্বের লড়াইয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল, হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রশাসনের অংশ হয়ে ওঠা তাদেরই পুরুষ সহযোদ্ধারা তাদের বাদ দিয়ে দিল। ৫ আগস্টের কয়েক দিনের মধ্যে আমরা যখন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করি, তখন তারা বিচ্ছিন্ন ও হতাশ বোধ করছিল, একই সঙ্গে সেসব ঘটনার পরবর্তী ধকল সামলাচ্ছিল।
তাদের হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ ও মানসিক ট্রমার প্রতি ন্যূনতম বিবেচনা এই সরকারের কার্যক্রমে তো দূরের কথা, মুহাম্মদ ইউনূসের জনসংযোগ ক্যাম্পেইনেও উঠে আসেনি। বরং সরকার তাদেরকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষদের প্রাধান্য দিয়ে আসছে। কোনোপ্রকার ব্যাখ্যা ছাড়াই আন্দোলনের সমস্ত কৃতিত্ব যেন উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। অথচ এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আমজনতা, নারী, শ্রমিক, রাজনৈতিক দলের কর্মীসহ আরো অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। নারীদের জন্য এসব মোটেই কোনো সুলক্ষণ ছিল না।
তারপরও এক ধরনের আত্মতুষ্টি জেঁকে বসেছিল। যে ইউনূস গত কয়েক দশক ধরে নারীরা কীভাবে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে, সে কাহিনী বলে বলে নিজের খ্যাতি গড়ে তুলেছেন এবং ২০০৭ সালে নিজের রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপারে বিস্তারিত বলার সময় যিনি বিশেষভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন, তিনি ও তার উপদেষ্টারা— যাদের অনেককেই আমরা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষের লোক হিসেবে চিনি, তারা নিশ্চয়ই নিশ্চিত করবেন যে নারীরা নতুন বাংলাদেশে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে— এমনটাই আশা ছিল। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং অবশ্যই ২০২৪ সালের শ্রাবণ-বিদ্রোহ পর্যন্ত যত ঐতিহাসিক আন্দোলন পার হয়ে আমরা আজকের এই মুহূর্তে এসে পৌঁছেছি, সেখানে নারীদের অসামান্য ভূমিকা ছিল। তাছাড়া দেশের অর্থনীতিতে তাদের অনস্বীকার্য ভূমিকা তো আছেই। এত কিছু মিলিয়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর যথাযথ মূল্যায়ন তো হতেই হবে এবং তা আরো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।
ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নৈতিক পুলিশি তৎপরতা এবং নারীদের স্লাট-শেমিং করা যখন বেড়ে গেল, তখন সরকারের আশ্চর্য নীরবতা যেন অপরাধীদের আশ্বাস দিল যে, কোনোরকমের শাস্তি তাদের পেতে হবে না। প্রাথমিকভাবে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনেও নারীদের উপস্থিতি হয় ছিল যৎসামান্য আর না হয় একেবারে ছিলই না। পরে যখন আরো পাঁচটি কমিশন যোগ করা হলো, যার মধ্যে ছিল ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি নারী কমিশন, তখন আমরা ভরসা করার সাহস পেলাম। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন (WARC) গঠনের মাধ্যমে নারীদের প্রয়োজন ও চাওয়া-পাওয়াগুলোকে জাতীয় আলোচনায় নিয়ে আসার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, যা জনগণকে ভাবতে, তর্ক-বিতর্ক করতে এবং দরকারি পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারতো।
এরপরে যা যা ঘটেছে তা দেখে মনে হয় যে, ইউনূস প্রশাসনের অধীনে গঠিত নারী কমিশন আসলে ছিল একটা লোকদেখানো উদ্যোগ। এখানে উপরে-উপরে নারীদের প্রতি সংহতি দেখানো হলেও, বাস্তবে এর কাজ ছিল তাদের শক্তিহীন ও বঞ্চিত করার পাশাপাশি কোনোরকম আন্দোলন গড়ে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক সম্ভাবনাকেই দুর্বল করে দেওয়া। কমিশনটির দায়িত্ব ছিল বিশাল। এর কাজ ছিল আইনি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে বিদ্যমান নারীবিদ্বেষ ও বৈষম্য পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করা। কমিশনের সদস্যরা আইন, স্বাস্থ্য, তৃণমূল অ্যাকটিভিজম ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে কাজ করতে এসেছিলেন। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের শহুরে ও গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিলেন।
নারী কমিশনের সদস্যরা সকল বয়সের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, শ্রমজীবী, কৃষক, ডাক্তার, আইনজীবী, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, আদিবাসী সম্প্রদায়, উদ্যোক্তা ও করপোরেট লিডার, সরকারি কর্মকর্তা এবং নীতিনির্ধারকদের কথা শুনেছিলেন। সারা দেশে ৩৯টি পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়, পাশাপাশি আরো ৯টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। নারী কমিশন দ্বারা বিপুল পরিমাণ সরকারি নথিপত্র ও প্রকাশিত গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করা হয়। নারীর নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন ও শিক্ষার মতো ১৫টি বিষয়ে মোট ৪২৩টি সুপারিশ নিয়ে প্রণীত এই প্রতিবেদন দালিলিক প্রমাণ ও যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশার বৈচিত্র্যকে আমলে নিয়ে সার্বিকভাবে নারীদের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ নারী, নিম্ন-আয়ের শ্রমজীবী ও সংখ্যালঘুদের সাথে আলাপ করার মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোকেও সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ করে নেওয়া হয়েছিল।
২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল নারী কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হেফাজতে ইসলাম এবং অন্যান্য উগ্র-ডানপন্থী ইসলামী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। তারা মোট ৪২৩টি সুপারিশের মধ্য থেকে মাত্র তিনটি বিতর্কিত প্রস্তাবকে সামনে টেনে এনে এই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিবেদনটিকে একচেটিয়াভাবে এলিট গোষ্ঠীর কাজ বলে তকমা দেওয়ার চেষ্টা করে এবং দাবি করে যে এটি বাংলাদেশের সাধারণ নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। অথচ অন্য কমিশনগুলোর ক্ষেত্রে এরকম সমালোচনা ওঠেনি। প্রচণ্ড আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখা যায় চারপাশে। কিন্তু নারী কমিশনের প্রধানের ছবি হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে একটি উগ্র-ডানপন্থী সমাবেশে ছড়িয়ে দেওয়া এবং অজস্র হুমকি-ধামকির পরেও সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। অনলাইন ও অফলাইনে, প্রকাশ্যে ও গোপনে, নারীবিদ্বেষী, অসহিষ্ণু, ডানপন্থী একটি গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান হাজিরা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এরকম যে হবে তা হয়তো আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল।
তবে যা কেউ অনুমান করতে পারেনি তা হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিক্রিয়া। জনগণের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পরিসর তৈরি করার বদলে নিজেদেরই করা নারী কমিশনের রিপোর্ট থেকে তারা সরে এলো। এমনকি, ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা নারী কমিশনকে এড়িয়ে গিয়ে যমুনার সেতু তুলে দেন, আবার একইসাথে ইসলামপন্থীদের প্রতি যেন লাল গালিচা বিছিয়ে দেন। নারীদের কণ্ঠস্বরকে এভাবে অগ্রাহ্য করা যে নারী অধিকারের অগ্রগতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে, তা যেন এই অনির্বাচিত সরকারের ভাবনাতেই ছিল না। রাষ্ট্র যখন জোরালো নৈতিক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলো, তখন নারীরা নিজেরাই সংসদ ভবনের সামনে একটা বৈচিত্র্যময় সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করলেন।
২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আলোচনার জন্য তাদের কাছে ছয়টি কমিশনের সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। নারী, শ্রম, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য— এই পাঁচটি কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে পরে জমা দেওয়া হয়। এই পাঁচ কমিশনের প্রধানরা ৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে তাদের সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু সেই চিঠির কোনো জবাব তারা পাননি। সুতরাং জুলাই সনদ মূলত ছয়টি কমিশনের সংস্কার-সুপারিশ থেকে গঠিত একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে দাঁড়ানো, যা ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কখনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যেসব পুরুষ প্রতিনিধি এতে যুক্ত ছিলেন, তাদের জাতীয় পরিচিতি নারী কমিশনের রিপোর্টের সঙ্গে জড়িত নারীদের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র। ব্যাটাসর্বস্ব এই ঐকমত্য কমিশন, যার সভাপতি পদের সাতজনই পুরুষ, সেখান বাদ পড়ে যান নারী অংশীদাররা, যারা এ দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ।
নারীরা শুধু নাগরিক হিসেবেই নয়, অর্থনৈতিক প্রভাবের বলেও টেবিলে আসন পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। অধিকাংশ বিনা মজুরির কাজ তারাই করেন এবং শিশু ও বয়স্কদের পরিচর্যার বড় বোঝা বহন করার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির মেরুদণ্ডও তারাই। কৃষি শ্রমশক্তির ৫৮ শতাংশই নারী, তবুও তাদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। আর এর মধ্যে ৪৫.৭ শতাংশ কোনো পারিশ্রমিকই পান না। গত এক বছরে ইউনূসের অধীনে এই দেশের অর্থনীতি যে টিকে আছে তা চকচকে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, যোগাযোগমাধ্যমে উপচে পড়া অন্তর্বর্তী সরকারের পুরুষ সদস্যদের হাবভাবময় ও বিচিত্র ভঙ্গিমার ছবি ও পোস্ট, কিংবা অনির্দিষ্ট বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি কারণে নয়, বরং নারীদের অবদানের কারণে। দীর্ঘদিন ধরে যেমনটা হয়ে আসছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত নির্ভর করে তৈরি পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমশক্তির ওপর। এর মধ্যে দ্বিতীয়টির ওপর সরকার নিজেই বারবার জোর দিয়েছে। আর এই দুটো ক্ষেত্রই টিকিয়ে রেখেছে নারীরা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে অধিক সুবিধাজনক শর্ত পাওয়ার পর যে সুযোগগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো কাজে লাগানো যাবে কি না সেটাও নির্ভর করছে নারীর শ্রম ও দক্ষতার ওপর।
পোশাকশিল্পের কর্মীদের ৫৩ শতাংশই নারী, এবং প্রবাসী নারী শ্রমিকেরাও বেশি বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এছাড়াও, পুরুষদের বিদেশে কাজ করতে যেতে পারার পিছনে নারীদের ওপর যে অনানুষ্ঠানিক শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় তার কথাও ভুললে চলবে না। অথচ, নারীরা প্রতিদিন যে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হন, সেগুলোর প্রতি ক্ষমতাধরদের কোনো মনোযোগ নেই। ২০০৮ সাল থেকে সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ। সব নারীই কি নারীর অধিকার রক্ষার পক্ষে? না, কিন্তু গবেষণা সর্বসম্মতভাবে বলছে, যদি নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হন তবে নারীর অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর একঘেঁয়ে পাল্টা যুক্তি হলো— নারীরা নাকি প্রস্তুত নন বা তাদের নাকি পাওয়া যায় না। আর এসব নারীবাদী এজেন্ডা নাকি ঢাকাকেন্দ্রিক এক এলিট শ্রেণির পক্ষ থেকে গেলানো হয়, যারা দেশের বাস্তবতা বোঝেন না। কিন্তু বাস্তবে, এই তাগিদ এসেছে নারীদের নিজেদের কণ্ঠস্বর শোনানোর প্রয়োজন থেকে এবং এই তাগিদ এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীদের কাছ থেকে, যারা প্রস্তুত। প্রস্তুত রয়েছে ভোটাররাও। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত জনগণের প্রতিক্রিয়া থেকে দেখা যাচ্ছে যে অপরাধ ও দুর্নীতির দুষ্টচক্রে বন্দি হওয়ার বদলে তারা পরিচ্ছন্ন, যোগ্য এবং সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রার্থীদের ভোট দিতে আগ্রহী, তাদের লিঙ্গ যাই হোক না কেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যপ্রক্রিয়া মৌলিকভাবেই ত্রুটিপূর্ণ। ১১টি সংস্কার কমিশনের নিরলস পরিশ্রমের পরও একের পর এক সময়সীমা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে সুপারিশগুলো অপমানজনক অচলাবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কোন সংস্কারগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মূলত মূলধারার রাজনৈতিক দলের পুরুষ সদস্যরা। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো বা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি দলগুলোর তরফ থেকে নারী নেতৃত্ব অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। ছয়টি কমিশনের পক্ষ থেকে ৮০০টি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছিল; এর মধ্য থেকে মাত্র ১৬৬টি আলোচিত হয় এবং সেখান থেকে মাত্র ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো হয় (যেখানে দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি ছিল)।
জুলাই সনদে আপাতত বলা হয়েছে যে, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা হবে ৫০, যা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে ১০০ করা হবে। এছাড়া সাধারণ আসনের ৫ শতাংশ নারীদের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হবে। ২০৪৩ সাল পর্যন্ত প্রতি নির্বাচনে তা ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হবে এবং এর সর্বোচ্চ সীমা হবে ৩৩ শতাংশ। কিন্তু সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের কোনো উল্লেখ নেই, যা বহু বছর ধরে নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি। অথচ ইউনূস সরকারের নিজস্ব নির্বাচন সংস্কার কমিশন (ERC)-এর ৪৬,০৮০টি পরিবারের ওপর করা জরিপে দেখা গেছে যে, ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন চান। নির্বাচিত না হয়ে মনোনীত হওয়ার প্রক্রিয়া নারীর নেতৃত্ব বিকাশ ও ভোটারদের প্রতি জবাবদিহিতার দিক দিয়ে সমস্যাজনক। এসবের জবাবে সহিংস দঙ্গল তৈরি করার মত পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরোনের ঘাটতি থাকায়, ফোরাম ফর উইমেন’স পলিটিক্যাল রাইটস (FWPR) নামের একটি জোট গঠিত হয় এবং ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট যখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে নারীদের আকাঙ্ক্ষা এবং বুদ্ধিজীবী সমাজের (সমমনা পুরুষ অংশীজনসহ) প্রস্তাবগুলো শোনা তো দূরের কথা, কোনো পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না, তখন তারা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এক ধরনের প্রত্যাশা ও আস্থা ছিল যে, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, অর্থাৎ নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। এরকমটা যে হলো না, তা তাদের পক্ষ থেকে নিখাদ প্রতারণা। নারীদের এরকম বাতিলকরণ অবশ্যই সচেতনভাবে ও মেটিকিউলাসলি ঘটানো হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া FWPR-এর ন্যূনতম দাবি হলো ২০২৬ সালে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণ আসনের ৩৩ শতাংশে নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে। FWPR আরও জোর দিচ্ছে ১৯৭২ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (RPO)–এ প্রয়োজনীয় সংশোধনীর ওপর। বিশেষ করে একটি ফ্রেমওয়ার্ক নির্মাণের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে, যেন রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ মনোনয়ন নারীদের দেয়। নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং নারীদের নির্বাচনী খরচ মেটাতে রাষ্ট্রীয় তহবিল বরাদ্দ দিতে হবে। আমরা মনে করি, এই যৌক্তিক দাবিগুলো নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের আন্দোলনের সমাপ্তি নয়, সূচনামাত্র।
এসব কেবল নারীদের বিষয় নয়, কিংবা শুধু নারীর অধিকারে সীমাবদ্ধ কিছু নয়। নারীদের নিজেদের কণ্ঠস্বরের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা পাওয়া বা না পাওয়া ন্যায়, সমতা ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সততা ও অখণ্ডতার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং একটি স্থিতিশীল ও টেকসই সমাজ নির্মাণের জন্য অপরিহার্য। নারী কমিশন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, নারীর প্রতি সহিংসতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শ্রম অধিকার, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি— এসব ক্ষেত্রে নারীরা জোরালো মত প্রকাশ করে আসছেন এবং অনেক সময় অগ্রগামী ভূমিকাও পালন করেছেন। দেশের কল্যাণের জন্য নারীদের নিজেদেরকেই সংসদে এই বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব হলো নিশ্চিত করা, যেন নারীরা জাতির যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হন। জুলাই সনদ যদি নিজেকে ন্যায্য এবং নিতান্ত এক বুড়ো ছোকড়াসঙ্ঘের (ব্যাটাবৃন্দের?) খরুচে বৈষম্যচর্চার বেশি কিছু বলে প্রমাণ করতে চায়, তাহলে নারীদেরকেও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে শামিল করতে হবে।●
সাদাফ সাজ সিদ্দিকী নারীপক্ষের কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সদস্য এবং ফোরাম ফর উইমেন’স পলিটিক্যাল রাইটসের প্রতিনিধি।