ঢাকার স্পিন সুলতানরা কি বিএনপিকে কোণঠাসা করবে?
“প্ল্যান- এ” ছিল চার বছরের মধ্যে পুরোনো রাজনীতিকে পুরোপুরি মুছে ফেলা। কিন্তু অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে বাধ্য হয়ে আগেভাগেই বিদায় নিতে হচ্ছে। তাহলে কি এখন কোনো পশ্চাদপসরণী “প্ল্যান- বি” আছে?

ঢাকার ‘স্পিন সুলতান’ তথা ‘মতামত প্রতিষ্ঠার সম্রাটেরা’ এক ধরনের মিডিয়া আলকেমিস্ট বা অপসরসায়নবিদ। উনারা আত্মসমর্পণকে জয় হিসেবে তুলে ধরেন (যেমন ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও গোপন চুক্তি)। তারা আইএমএফ-নেতৃত্বাধীন মুদ্রাস্ফীতি-অবরুদ্ধ অর্থনীতির দুর্বল ব্যবস্থাপনাকেও চৌকস নেতৃত্ব বলে চালিয়ে দেয় তাদের ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলা গল্পে। গত এক বছরে এই সুলতানরা “বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আদায়”, “চীনা অর্থনীতির সাথে যুক্ত হওয়া”, “সেভেন সিস্টার্স প্রদেশগুলোর প্রবেশদ্বার হওয়ার”, ফাঁপা বুলি দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা “আসিয়ান-এ যোগ দেবেন”। এমনকি এ-ও বলেছেন যে, তাদের জাদুদণ্ডের ইন্দ্রজালে দক্ষিণ এশিয়ায় “সার্ক পুনরুজ্জীবিত করবেন”। নিজেদের আকাশকুসুম এইসব গল্পে তারা দিব্যি মত্ত। এর ফলে আত্মসমালোচনা, শেখা এবং কৌশলগত চিন্তার জায়গা সঙ্কুচিত হচ্ছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পুর্ব এশিয়ার মতো আধুনিকায়নের কৌশলগত পথনির্দেশ তৈরির যে সুযোগ এসেছিলো তা হারিয়ে গেছে। এর বদলে সবাই কেবল দেশীয় সংস্কারেই মন দিয়েছে। এর ফল হরেদরে ২০০৭ সালের পুরনো ধাঁচের পশ্চিমা ‘গুড গভর্ন্যান্স’- এর ডিজিটাল সংস্করণ মাত্র।
সাদা চোখে আর্থিক অভ্যুত্থান?
যদি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে না পারেন আসল সমস্যা কোথায়, তবে তা হতে পারে কেবল এক ধরনের (নব্য-উদারবাদী) পরামর্শের উপর নির্ভরশীল হওয়ার ফল। এর আসল সমস্যা হতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যতিক্রম হতে পারে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ)। ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বেশ বেপরোয়া। আমরা তা পর্যবেক্ষণ করেছি চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল হস্তান্তরের গোলমেলে ঘটনায়। আরও অবাক হয়েছি যখন ইউনূস সরকার প্রায় শেষ সময়ে ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ মহলের সাথে একটি গোপন চুক্তি ঘোষণা করল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ব্যক্তিরা আইএমএফ-এর উদ্যোগকে সমর্থন দিচ্ছে— তাদের লোককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রাখতেই হবে। কিন্তু বিষয়টা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং পুরো প্রতিষ্ঠানকে আইএমএফ-এর নকশা অনুযায়ী গড়ে তোলার ফন্দি। প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে গভর্নরকে সরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সুপ্রিম কোর্টও এতে সম্পৃক্ত থাকবে। ফলে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে— মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যা অনেকটাই প্রত্যাশিত— এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা করে, তখন তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকবে। উচ্চসুদ ও নব্য-উদারনৈতিক রক্ষণশীল নীতি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে, যেটা আমরা এক বছর ধরে দেখে আসছি। চাকরি সৃষ্টি হবে না।
মানুষ দোষ দেবে বিএনপিকে। অসন্তোষ বাড়বে। বিরোধীরা ঘিরে ধরবে। এমনকি বিশ্বব্যাংকও গত এক বছরে নিদারুণ দারিদ্র্য বৃদ্ধির কঠিন সমালোচনা করেছে। বাস্তব মজুরি কমছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সম্প্রতি “ক্ষুধা” ও “অনাহার”-এর মতো শব্দ ব্যবহার শুরু হয়েছে। খাদ্য ট্রাকের লাইনে ভিড় আগের মতোই দীর্ঘ। গরিবরা মরিয়া, এমনকি মধ্যবিত্তও ভোগবিলাস কমাতে বাধ্য হচ্ছে। তাহলে ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে প্রতিবাদ করছে না? আগামী বছর বিএনপিই তাদের লক্ষ্যবস্তু হবে।
প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ নিয়ে গভর্নর আনন্দের সঙ্গে বলেছেন, “এটি আইএমএফ-এর সুপারিশ অনুযায়ী চূড়ান্ত করা হয়েছে।” অবশ্যই তাই। তিনি আরও যোগ করেন, “সরকার ও আমলাতন্ত্র হয়তো বাধা দেবে”, এবং দেওয়া উচিতও বটে। আংশিক কারণ— নতুন পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের রাখা হবে না। রাষ্ট্রপতি গভর্নর নিয়োগ দেবেন এবং তিনি স্বাধীন মন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন। “প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ চাইলে রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারণ করতে পারেন।” অর্থাৎ না-ও করতে পারেন। এতে মেয়াদ দীর্ঘ হবে এবং বিলম্বের জটিলতা তৈরি হবে।
পর্ষদ সদস্যরা ছয় বছর দায়িত্বে থাকবে, নিজেদের মতাদর্শ ও স্বার্থে পরিচালিত হবে, আর সবসময় আইএমএফ-এর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসের রেমিট্যান্সের সমপরিমাণ ঋণের বিনিময়ে আইএমএফ সরাসরি দেশের মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণে ঢুকে পড়ছে।
সংস্কার? এর চেয়ে বরং বলা চলে দখল।
ক্রমাগত শিল্পহীন হতে থাকা পশ্চিমের দিকেই পুরো নজর নিবদ্ধ রাখার ভবিষ্যৎ হলো স্থায়ী ‘অস্টেরিটি লাইট’ বা কৃচ্ছ্রসাধন। জাতীয় সম্পদ বিক্রি হবে বিদেশি স্বার্থে, নতুন শিল্পে সক্রিয় সহায়তা খুব কম থাকবে— এটাই প্রচলিত পরিচালনা পদ্ধতি।
প্রশ্ন হচ্ছে, চীন কি এমনটা করতে দেয়? চীন কি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিয়ে শিল্প, প্রযুক্তি ও দারিদ্র্য বিমোচনে সফল হয়েছে? ঢাকায় এমন প্রশ্ন কেউ তোলে না। এটাই সমস্যা। এছাড়াও, নানা ধরনের মডেল আছে, ভিন্ন ভিন্ন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার মাত্রা আছে। কিন্তু তা নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি।
এই একই (নব্য-উদারবাদী) অর্থনীতিবিদরা, যারা গভর্নরের পশ্চাদপদ নীতির সমালোচনায় ভীষণ উচ্চকিত, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে কোনও আপত্তি করছেন না। ধনী দেশে হয়তো এ ধারণা কিছুটা প্রযোজ্য, কিন্তু একটি স্বল্পোন্নত দেশের কাঠামোগত সমস্যার জন্য সমন্বিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। শিল্পায়নের শুরুর ধাপে পূর্ব এশিয়ায় এটাই ছিলো কার্যকর পথ।
নব্য-উদারবাদপন্থী অভিজাতরা অনির্বাচিত, বিদেশি ব্যবস্থাপনাতেই সন্তুষ্ট। স্পষ্ট করে বললে, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা জরুরি। অতি অবশ্যই পরামর্শ নিন, আলোচনা করুন, দরকষাকষি করুন —কেন গণতান্ত্রিক তদারকি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তাকে দ্রুত অপসারণের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে?
বিএনপি আবিস্কার করবে যে, ব্যাংক তাদের লক্ষ্য পূরণে বাধা দিচ্ছে। এর ফলাফল— খুব সংক্ষিপ্ত মধুচন্দ্রিমা। যদি আমার বিশ্লেষণের সাথে দ্বিমতও থাকে, অন্তত এই আইএমএফ-আরোপিত অধ্যাদেশ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে হওয়া উচিত। এখন কেন এত তাড়াহুড়া?
ঢাকা যেহেতু গুজবের শহর, এনএসএ-কে ঘিরে অনেক অযাচিত কথা ছড়িয়ে পড়ছে। সম্ভবত এর কৌতুহলীদ্দীপক ও হঠাৎ করে আবির্ভাব এবং পরবর্তী কার্যকলাপের জন্য। তিনি নাকি রাখাইন ও মায়ানমারের অস্থিতিশীল করিডর তৈরি করেন সেনাপ্রধান, চীনা রাষ্ট্রদূত, আরাকান সেনাপ্রধান বা মিয়ানমারের সরকারকে না জানিয়েই। লন্ডনে বিদেশ সফরে গিয়ে রাজনৈতিক ঘোষণা পড়ে শোনান, ট্রাম্প টিমের সাথে বাণিজ্য শুল্ক নিয়েও আলোচনায় বসেন। অথচ এগুলোর কোনওটাই নিরাপত্তা ব্রিফের আওতায় পড়ে না।
তিনি সর্বত্রই প্রভাবশালী। শোনা যাচ্ছে ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেতৃত্ব দেবেন। সেসব সম্মেলনে কি বাঁধাধরা প্রতিশ্রুতি আসবে? এনএসএ পদটি বিলুপ্ত হবে, নাকি স্থায়ী রূপ পাবে? যেভাবেই হোক, পদটির স্পষ্ট সংজ্ঞা, কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা কি নিশ্চিত হবে?
উত্তরের চিঠিটি দয়া করে যমুনার ঠিকানায় পাঠাবেন প্রিয় সুলতানেরা, আপনাদের দোহাই লাগে।
আমি বিএনপির নাম বলছি কারণ তারা স্পষ্টভাবেই আগামী সরকারের দৌড়ে এগিয়ে। তবে অপেক্ষা করুন— কিছু ছাত্রনেতা প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে, তাদের দাবিগুলো পূরণ না হলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকিয়ে দেবে। কোনও দর্শন নেই, চিন্তার ছাপ নেই, কর্মপরিকল্পনা নেই— শুধু দাবি। তার ওপর সর্বদা অনিশ্চিত একটি ঘুঁটি হচ্ছে জামায়াত।
অন্তর্বর্তী সরকারের সুলতানদের শেষ মুহূর্তের চাল ঠেকাতে সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও বিএনপি— তিন পক্ষই নিজেদের মধ্যে সাধারণ স্বার্থের আরও অনেক জায়গা খুঁজে পাবে বলে অনেকে মনে করছেন।●
ফরিদ এরকিজিয়া বখত একজন লেখক ও বিশ্লেষক