শ্রমিকের মূল্যহীন জীবন, আমাদের দায় কি?

শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের জীবনের অর্থমূল্য মাত্র দুই লক্ষ টাকা। এমন ‘মূল্যহীন’ জীবন নিয়ে শ্রমিকরা যখন নানা দাবিতে পথে নামে তখন তাদের মরতে হয় পুলিশের গুলিতেও।

শ্রমিকের মূল্যহীন জীবন,  আমাদের দায় কি?
ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ

এ বছরের প্রথম দুই মাসে অন্তত ২১৩ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এই হিসাব এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কেবলমাত্র দেশের জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত সংবাদের যোগফল। মৃত্যুর এই পরিসংখ্যানে হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া বা কমে যাওয়ার কোনো ঝোঁক নেই। এই গ্রাফ এভাবেই চলছে, হয়তো এভাবেই চলবে। 

এই কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের সিইপিজেড এলাকায় এলসিবি গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিক উৎপল তঞ্চঙ্গ্যা অসুস্থ অবস্থায় ছুটি না পেয়ে কর্মরত অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন।  

গত ফেব্রয়ারিতে নারায়ণগঞ্জে আদমজী ইপিজেডে অনন্ত এ্যাপারেলসের শ্রমিক লিমা অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ছিলেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাকে ফোন করে কাজে যোগদানে বাধ্য করে। এরপর তিনি আবারো ছুটির জন্য আবেদন করলে মালিকপক্ষ কোনোভাবেই তার ছুটি মঞ্জুর করেনি। এর কিছুক্ষণ পর কারখানাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। 

গত মার্চ মাসে ১৮ মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রম ভবনের সামনে লাগাতার অবস্থান করেন স্টাইল ক্রাফট কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকরা। অবস্থানরত অবস্থায় রাজপ্রসাদ সিং নামের এক শ্রমিক শ্রম ভবনের বারান্দায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। 

অন্যদিকে বহুতল ভবন নির্মাণের সময় ভবন থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিলস-এর প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে কর্মরত অবস্থায় ‘দুর্ঘটনায়’ ৯৭ জন নির্মাণ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। একই বছর ২৯২ জন পরিবহন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন কর্মরত অবস্থায়। ১০২ জন কৃষিশ্রমিক, ৪৩ জন রিকশাশ্রমিক, ৪১ জন প্রবাসী শ্রমিক, ৩২ জন দিনমজুর, ২৩ জন বিদ্যুৎমিস্ত্রী, ১৯ জন মৎস্যজীবী, ১০ জন জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিক, ৯ জন স্টিলমিল শ্রমিক, ৮ জন নৌপরিবহন শ্রমিক, ৭ জন অক্সিজেন কারখানার শ্রমিক, হোটেল–রেস্তোরাঁ, রাইস মিল, ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপ ও দোকানে ৫ জন করে মোট ২০ জন, ৬ জন বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের শ্রমিক এবং অন্যান্য খাতে আর ও ২৭জন শ্রমিক কর্মস্থলে ‘দুর্ঘটনায়’ মৃত্যুবরণ করেছেন। হলফ করে বলা যায়, দৈনিক পত্রিকয়া প্রকাশিত এই সংখ্যাগুলোই সব নয়।

যে দেশে রানা প্লাজা, তাজরীন, মাল্টিফ্যাব, স্পেকট্রাম, সেজান জুস কারখানার মতো বড়দাগের শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না, সেখানে কারখানা বা কর্মস্থলে অসুস্থ হয়ে বা দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে— এমন ভাবাটাই বাতুলতা। 

প্রশ্ন, তাহলে এই মৃত্যুগুলোর সুরাহা হয় কীভাবে?

গত কয়েকদিন আগে ঢাকায় এক বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মীকে একজন মদ্যপ ব্যবসায়ী গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করলেন। শোনা যায় নিহতের পরিবারকে মাত্র তিন লক্ষ টাকা দিয়ে সেই ঘটনা সুরাহা করেছেন সেই ব্যবসায়ী। এতটুকু হয়েছে তা-ও আবার একজন প্রবাসী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার সেই ঘটনার বিচারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন বলে। আর আমাদের শ্রম আইনে কর্মস্থলে কাজ করতে গিয়ে জখম হয়ে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার জন্য দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান আছে। 

শ্রমিক কারখানায় কিংবা কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় কিংবা অসুস্থ হয়ে মারা যাবে— এটা এমন কী আর ঘটনা! মাত্র দুই লক্ষ টাকাই তো শ্রমিকের জীবনের মূল্য।

আমাদের দেশে শোষণের অত্যন্ত কদর্য চেহারাটা আমরা খুব স্বাভাবিকই মনে করছি। পৃথিবীর একটা অন্যতম শীর্ষ পঠিত গ্রন্থে ১৮৬৩ সালে লণ্ডনের একটি কারখানার একজন তরুণ নারী শ্রমিক মেরী আনে ওয়াকলির মর্মস্পর্শী মৃত্যুর এক অনবদ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। অতিরিক্ত পরিশ্রম, খাবারের অপ্রতুলতা, যে ঘরে মেয়েটি কাজ করেছিল সেখানকার অমানবিক পরিবেশ তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ১৬২ বছর আগে ইংল্যান্ডে শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃসহ জীবন আর আজ আমাদের দেশের শ্রমিকদের জীবনের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য।

আমাদের কারখানার শ্রমিকরা ওভারটাইম কাজ চান।  খুব সাধ করে শ্রমিকরা আরো আরো কাজ করতে চান বিষয়টি এমন নয়। শ্রমিকরা এতটাই অল্প বেতন পান যে, ওভারটাইমে কাজ না করলে তার পক্ষে জীবন বাঁচানো অসম্ভব। আমাদের দেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। শ্রম আইনেও জাতীয় ন্যূনতম মজুরির বাধ্যবাধকতা নেই। গার্মেন্টসহ অল্প কিছু খাতে যে ন্যূনতম মজুরি আছে সেটাও সবসময়ই বাজার দরের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।  বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা পৃথিবীর শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক হয়েও পৃথিবীর সর্বনিম্ন মজুরিদাতাও তারাই।

এবারের মে দিবসের দাবি সম্পর্কে দেশের যে কোনো শ্রমিককে প্রশ্ন করলে যে বিষয়টি তারা বলবেন তা হলো— আট ঘণ্টা কাজ করে আমরা যে মজুরি পাই তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। এমনকি রাতদিন ওভারটাইম করার পরও যে মজুরি পাই সেটা দিয়েও সংসার চালাতে পারি না। বাধ্য হয়েই একজন শ্রমিককে ১২ থেকে ১৪ এমনকি ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। একজন শ্রমিকের পক্ষে কারখানা বা কর্মস্থল ছাড়া কাজের বাইরে কিছুই ভাববার মতো ফুরসত থাকেনা বললেই চলে। প্রত্যেক শ্রমিক এক-একটা মেশিনে পরিণত হয়েছেন। যাঁদের কোনো স্বাভাবিক জীবন নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগেও আট ঘণ্টা কাজের দাবি আমাদের দেশের শ্রমিকদের জীবনে এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরের ব্যাপার হিসেবে থেকে গেলো।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, শ্রম আইনে তো আট ঘণ্টা কাজের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট থাকার কথা। তাহলে কেন উপরের কথাটা টানলাম। 

আমাদের শ্রম আইনে কর্মঘণ্টা হিসেবে ৮ ঘণ্টার বিধান ছিল। ২০১৮ সালে যখন শ্রম আইন সংশোধন করা হয় তখন শুধুমাত্র ‘বিরতি ছাড়া’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে দৈনিক কর্মঘণ্টা হিসেবে ৯ ঘণ্টার বিধান করা হয়। মে দিবসের ১৩৯ বছর পরও কেন আমাদের দেশে আট ঘণ্টা কাজের দাবি যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি কিংবা শ্রমিকরা কেন ন্যূনতম একটা স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার পাচ্ছেন না, সেই বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠী দেশের শ্রমজীবী, পেশাজীবী-কর্মজীবী মানুষ। তাদের জীবনের প্রধান সংকটের নাম ‘আয়বৈষম্য’ ও ‘ধনবৈষম্য’। ধারণা করি, আগামীর বাংলাদেশে এই দুই সংকটই হয়তো একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের কারণ হবে।

বর্তমানে কোনো শ্রমিক তার প্রাপ্ত মজুরিতে ক্ষয়কৃত ক্যালরি পূরণের মতো খাদ্য, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদনের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। পোশাকশ্রমিকেরা মাত্র ৪০-৪৫ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। পোশাক শ্রমিকদের গড় বয়স নিয়ে কোনো গবেষণা হলে, আমরা ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী হিসেবে যা বলছি অন্যরা সেটা সহজেই বুঝতে পারবেন। 

একই চিত্র অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই।  কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকরা এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। যেমন চা, ট্যানারি, চাতাল, ইটভাঙ্গা শ্রমিক। এসব শ্রমিকের ক্রমান্বয়ে শ্রমশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির স্বার্থেই শ্রমিকদের জীবনধারণে  প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

আমাদের পোশাক শিল্প যেহেতু দেশের অর্থনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তা্ই পোশাক শ্রমিকদের বিষয়টা বেশি আলোচিতও হয়ে থাকে। গত চার দশকের বেশি সময়ে গড়ে ওঠা পোশাকশিল্পের যে সাফল্য ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা আজ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় তার পেছনের ইতিহাস আসলে কী? কৃতিত্বের গৌরবটাই বা কার?

মানুষ, সভ্যতা ও শিল্পায়নের ইতিহাস তীব্র শ্রম শোষণের ইতিহাস– যে কথা সাধারণত বলা হয় না। আর যে শ্রমিকদের অতি সস্তা শ্রমে আজ এ শিল্প এতদূর এলো, যাদের সীমাহীন আত্মত্যাগে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এত বাহাদুরি, কৃতিত্বের মাল্য তাদের গলায় কখনই জোটে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ মালিকরা মনে করেন, তাঁদের বিশেষ ক্যারিশমা দিয়ে তারা পোশাকশিল্পকে আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। তাঁরা এই খাতের প্রায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের অবদান এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্যান্য সুবিধা এবং আনুকূল্যকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা সবসময়ই নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তাজরীন, রানা প্লাজার মতো নৃশংস শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের পর তাঁদের প্রকৃত চরিত্র যখন বিশ্বব্যাপী উন্মোচিত হলো, তখনো আমরা তাঁদের অন্ধ অহমিকার কমতি দেখিনি।

আমাদের পোশাকশিল্পের বিকাশের পেছনে রয়েছে শ্রমিকের সস্তা শ্রম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শ্রমিকের লাশ, রক্ত, স্বজন হারানোর বেদনা, অসংখ্য মানুষের কান্না আর আহাজারি। এর কোনোটিকেই আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আজ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একটি শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছেন পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা।

কিন্তু দুই সন্তানসহ একটি শ্রমিকপরিবারে খাওয়া খরচ, বাসাভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা, পোশাক ও অন্যান্য খরচ হিসাব করলে, সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও সবচেয়ে সস্তা খাবার খেয়েও তো তাঁদের জীবন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিকের সন্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এটাই শিল্পের ভেতরের চেহারা। শুধু বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের যে বাহ্যিক চাকচিক্য, তা দেখে আত্মতুষ্টিতে থাকলে এ সুখ খুব বেশিদিন টেকসই হবে না।

শ্রমিকরা যখনই কোনো ন্যায্য দাবি উত্থাপন করেন, তখনই সবখান থেকে গেলো গেলো রব তোলা হয়। গার্মেন্ট শিল্পের ‘ক্রয় আদেশ অন্য দেশে চলে যাবে’ এই জুজুর ভয়কে শ্রমিক ঠকানোর প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে প্রথম থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাজরীন ও রানা প্লাজার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও কি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে? 

প্রকৃতপক্ষে বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফেরায়নি। শ্রমিকের সস্তা শ্রমে উৎপাদিত পোশাক উন্নত দেশগুলোতে চড়া দামে বিক্রি করে তারাও মুনাফার পাহাড় গড়ছে। আমাদের মুনাফালোভী মালিকদের পাশাপাশি ওইসব ক্রেতাদের সময় ও চাহিদামতো শিপমেন্ট নিশ্চিত করার চাপ রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের জন্য কম দায়ী নয়। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে নানান হুমকি দিলেও সস্তা শ্রমের লোভে তারা তাদের ক্রয়াদেশ প্রায় ঠিকই রেখেছে। দেশি মালিক ও আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থাগুলো- উভয়েই আজ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অমানবিক এবং মানবেতর জীবনের জন্য দায়ী। 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম মজুরিতে পোশাকশ্রমিকেরা বাংলাদেশে তাঁদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন। আমাদের মালিকেরা কোনো ধরনের দর-কষাকষি ছাড়াই আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের থেকে অর্ডার নেন এবং নিজেরা অধিক মুনাফা লাভের জন্য শ্রমিকের ওপর তীব্র শ্রমশোষণ চালান।  আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থা ও দেশীয় মালিকের তীব্র শ্রম শোষণ আজ এমন পর্যায়ে রয়েছে— পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের পক্ষে আট ঘণ্টা কাজের দাবি বাস্তবায়ন দুরহ ব্যাপার।

আট ঘণ্টা কাজের দাবি ছিল ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের আন্দোলনের মূল দাবি। সেই আন্দোলনে হে মার্কেটে বিশাল শ্রমিক সমাবেশে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল। শ্রমিক নেতৃবৃন্দের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিচারের নামে প্রহসন করে পাঁচ জন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল।  এরপর পৃথিবী বহুদূর এগিয়েছে। আমরা এখনো সেই তিমিরেই আছি।  শ্রমিকের ন্যায্য দাবির মিছিলে এখানে নির্বিচারে গুলি চলে। হরহামেশা মিথ্যা মামলায় শ্রমিকদের জেল খাটতে হয়। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের শেষ বছরে ২০২৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে অন্তত ৪ জন শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, যাঁদের মধ্যে ৩ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

সঙ্গত কারণেই শ্রমিকেরা স্বৈরাচারী শাসকের চরম ফ্যাসিবাদী জুলুম থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শ্রমিকেরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন এবং শহীদ হয়েছেন। এই গণঅভ্যুত্থানে রিকশা শ্রমিকদের অকাতরে জীবন দেওয়ার কথা কমবেশি সবাই জানেন। ২০ জুলাই, শনিবার চিকিৎসা নিয়ে ফেরার সময় ঢাকার শনিরআখড়ায় হকার্স ইউনিয়ন সূত্রাপুর থানা কমিটির নেতা ইউসুফ সানোয়ারকে রাস্তা পারাপারের সময় আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা অবস্থায় ঠাণ্ডামাথায় নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।  এই ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী শহীদ ইউসুফ সানোয়ারের বোন সে সময় পত্র-পত্রিকায় যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা শুনে কোনো মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। 

একই দিন গাজীপুরের গাজীপুরা সাতাইশ সড়কে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র সংগঠক নিজামুদ্দিন মনির গুলিতে শহীদ হন। অন্য সাথী শ্রমিকরা বলেছেন, একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা অন্য অনেকের সাথে নিজামুদ্দিনের মরদেহও নিয়ে যায়। এমনকি ২ আগস্টের দ্রোহযাত্রায় হাজারো শ্রমিক শিল্প এলাকা থেকে এসেছিলেন। পরের দিন থেকে আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে আর কোনো কারখানায় কাজ হয়নি।  ৫ আগষ্ট ঢাকার উদ্দেশে মিছিল নিয়ে আসা হয়নি আশুলিয়ার গার্মেন্ট টিইউসি সংগঠক আশরাফুলের। বাইপাইলে মিছিলে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হন।  শত শত শ্রমিকের আত্মত্যাগের এ সকল বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। ‘মূল্যহীন’ জীবনের মতো তাদের অবদানেরও তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। তবুও যদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে শ্রমিকের দুর্দশা সামান্য লাঘব হতো! সেটা তো হয়নি, এমনকি বন্ধ হয়নি গুলি করে শ্রমিক হত্যার ঘটনাও।

জুলাই গণঅভ্যুথানের পরেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে সুমন মিয়া, চম্পা বেগম, কাওসারসহ চারজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় শ্রমিকের জীবনমান আর জীবনের মূল্য উভয়ই এখনও বহু দূরের পথ।

এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় মে দিবস ‘মূল্যহীন’ সব জীবনের প্রতি আমাদের দায় মনে করিয়ে দিয়ে যায়।●

জলি তালুকদার, রাজনীতিবিদ ও শ্রমিকনেতা