টেলিগ্রাম যোগাযোগে আড়িপাতার সরঞ্জাম কিনেছে র‍্যাব

বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নজরদারি ও আড়িপাতার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে ইজ্জি গ্রুপ।

টেলিগ্রাম যোগাযোগে আড়িপাতার সরঞ্জাম কিনেছে র‍্যাব

বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ ইউনিট র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সম্প্রতি এনক্রিপ্টেড বার্তা আদানপ্রদানের জনপ্রিয় মাধ্যম টেলিগ্রামে আড়িপাতার যন্ত্র কিনেছে বলে ফ্রান্স-ভিত্তিক একটি সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। প্যারিস-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইন্টেলিজেন্স অনলাইন জানিয়েছে, “টুকান” নামক ওই যন্ত্র কেনা হয়েছে ইজ্জি (Ezzy) কমিউনিকেশন্স নামের একটি স্থানীয় পরিবেশকের মাধ্যমে।

তবে “টুকান”-এর মূল নির্মাতা কারা, সেই ব্যাপারে প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

খবরে আরও বলা হয়, “এই সিস্টেম ব্যবহার করে টেলিগ্রাম ব্যবহারকারীদের পরিচয় উদ্ঘাটন (ডিঅ্যানোনিমাইজ করা), টেলিগ্রাম প্ল্যাটফর্মে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ বা কি-ওয়ার্ড নিয়ে কিছু প্রকাশিত হলেই তা জানা এবং ব্যবহারকারীদের মেটাডাটা (যেমন: ফোন নম্বর, ঠিকানা ও ইমেইল) সংগ্রহ করা সম্ভব।”

নেত্র নিউজ স্বতন্ত্রভাবে এই খবর নিশ্চিত করতে পারেনি।

২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, টেলিগ্রামে ব্যাক্তিগত বার্তা আদানপ্রদানে অনুপ্রবেশ করা সম্ভব হলে, ব্যবহারকারীদের প্রকাশ্য ও গোপন বার্তা সংগ্রহ করা এবং সম্ভাব্য মানসিক বিশ্লেষণের কাজে তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। ব্যবহারকারীর নাম ও ফোন নম্বরের বিপরীতে খোলা অন্যান্য বার্তা আদানপ্রদানের মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে টেলিগ্রাম থেকে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখাতেও সক্ষম টুকান।

বাংলাদেশে নিজেদের ব্যবহারকারীদের সংখ্যা টেলিগ্রাম প্রকাশ করে না। তবে নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তাদের অ্যাপের খ্যাতি আছে; যদিও অ্যাপটির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সমালোচনাও রয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও নিরাপদ এনক্রিপ্টেড যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন পেশার মানুষ টেলিগ্রাম ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে বা কী ধরণের টেলিগ্রাম যোগাযোগ “টুকান”-এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে বা আদৌ হবে কি না তা স্পষ্ট নয়। এসব দাবির বিষয়ে জানতে টেলিগ্রামের জনসংযোগ বিভাগের সাথে যোগাযোগ করেছে নেত্র নিউজ।

ইজ্জি


বাংলাদেশের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন নজরদারির যন্ত্র সরবরাহ করে আসছে ইজ্জি গ্রুপ নামে একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং প্রতিরক্ষা  গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকেও (ডিজিএফআই) অতীতে এই ধরণের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।

ইন্টেলিজেন্স অনলাইন নিজস্ব সূত্রের বরাতে জানায়, সেলেব্রাইট, গ্যামা গ্রুপ, ইউটিম্যাকো, ৩আই-মাইন্ড (বর্তমানে ডিজিটাল ক্লুজ)-এর মতো অনলাইনে নজরদারির যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে ইজ্জি।

নেত্র নিউজ পৃথকভাবে ইজ্জি গ্রুপের প্রাক্তন দুই কর্মকর্তার সন্ধান পেয়েছে যারা ডিজিএফআই সদরদপ্তরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে আড়ি পাতা ও নজরদারির এসব যন্ত্র ও সিস্টেম পরিচালনায় সহায়তা করতেন।

ইজ্জির অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইসরায়েল-ভিত্তিক সেলেব্রাইটের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নজরদারির যন্ত্র ক্রয় করেছিল বলে ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র হারেৎস ও আল জাজিরায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো প্রতিক্রিয়া না হলেও, ইসরায়েলের একটি নাগরিক অধিকার সংগঠনের মামলার মুখে বাংলাদেশে নজরদারির যন্ত্র সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেয় সেলেব্রাইট

ইন্টিলিজেন্স অনলাইনের প্রতিবেদনে নিজস্ব সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, নজরদারির যন্ত্র ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে অত্যন্ত আধুনিক “জিরো-ডে” হ্যাকিং টুলও সরবরাহ করে ইজ্জি।

ব্রাজিল-ভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা গবেষক এডোয়ার্ডো আইযাইকি তার বই “ন্যাশন স্টেট সাইবার ক্যাপাবিলিটিজ”-এ লিখেছেন, ডিজিএফআই বৃটিশ-জার্মান কোম্পানি গ্যামা ইন্টারন্যাশনালের ফিনফিশার ও জার্মান প্রতিষ্ঠান ট্রোভিকরের দুইটি “জিরো-ডে” হ্যাকিং টুল ব্যবহার করতো, যার পরিবেশক হিসেবে কাজ করেছে ইজ্জি এন্টারপ্রাইস।

এডোয়ার্ডো আইযাইকির বই “ন্যাশন স্টেট সাইবার ক্যাপাবিলিটিজ” থেকে নেওয়া। 

ডিজিএফআইয়ের সার্ভারে ফিনফিশারের উপস্থিতি নিয়ে ২০১৫ সালে দীর্ঘ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা গবেষণাগার সিটিজেন ল্যাব।

২০১৬ সালের জুলাইয়ে ব্যাক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল বৈশ্বিক আড়িপাতা ও নজরদারি খাতের ওপর একটি দীর্ঘ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে ইজ্জি এন্টারপ্রাইসকে এই খাতের পরিবেশকের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।

বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পরিবর্তন শনাক্ত করে এমন একটি ডাটাবেজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল ইজ্জি কম্যুনিকেশন্স তাদের ওয়েবসাইট থেকে নিজেদের বিভিন্ন পার্টনারের নাম সরিয়ে ফেলে। এদের মধ্যে গ্যামা ইন্টারন্যাশনাল ও ট্রোভিকরের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটির আর্কাইভ ওয়েবসাইটে এখনও তাদের নাম পাওয়া যায়। গ্রাহক হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও এনটিএমসির নামও সেখানে রয়েছে।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক নজরদারির যন্ত্র স্থাপনের কাজটিও সম্পন্ন করে ইজ্জি গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। চীনের বিতর্কিত কোম্পানি হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থাপিত ওই নজরদারির যন্ত্র চলমান গাড়ির নম্বরপ্লেট শনাক্ত করা ও মানুষের গতিবিধি তৎক্ষণাৎ শনাক্ত করতে সক্ষম বলে বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের “ভিশন ২০৪১” পরিকল্পনার আওতায় একই ধরণের নজরদারির নেটওয়ার্ক সারা বাংলাদেশে স্থাপন করা হবে বলে জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

তেল ও গ্যাস উত্তোলন, ইন্টারনেট নিরাপত্তা ও নজরদারির সরঞ্জাম সরবরাহ, মানবসম্পদ রপ্তানি ও পর্যটন খাতে ব্যবসা রয়েছে ইজ্জি গ্রুপের। গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। তার ছেলে জুলফিকার আলী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জুলফিকার আলী বাংলাদেশে গুয়েতেমালার অনরারি কনসাল জেনারেল।  

গ্রুপের অন্যতম পরিচালক শাহনুল হাসান খান বাংলাদেশের বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফতের ব্যবসায়িক আংশীদার। পদ্মা ব্যাংক, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন একটি ব্যাংকের সাবেক এই দুই সহকর্মী।এছাড়া “নিউজবাংলা ২৪” নামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক শাহনুল হাসান খান, যার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে আছেন চৌধুরী নাফিজ সরাফত। ২০২০-২১ সালে তার নাম পরিচালক হিসেবে ইজ্জি গ্রুপের ওয়েবসাইটে যুক্ত করা হয়। তার আগ পর্যন্ত এটি ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এই প্রতিবেদনের জন্য জুলফিকার আলী ও শাহনুল হাসান খানের মন্তব্য চেয়ে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করেছে, তবে তারা কোনো সাড়া দেননি।

নজরদারি ও আড়িপাতায় সক্ষমতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচনের যখন আর বছর খানেক বাকি, তখনই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের নজরদারি ও আড়িপাতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।

এর আগে ২১ আগস্ট এক পৃথক প্রতিবেদনে ইন্টিলিজেন্স অনলাইন জানিয়েছে, ফরাসি সংস্থা ইন্টারসেকের কাছ থেকে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে জিওলোকেশন বা অবস্থান শনাক্তের যন্ত্র ক্রয় করেছে বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিকম্যুনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংস্থা ক্রিয়েটিভিটি সফটওয়্যারকে হারিয়ে ওই চুক্তি জিতে নিয়েছে ইন্টারসেক।

ক্রিয়েটিভিটি সফটওয়্যার সম্প্রতি কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসএস৮। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের জটিল সম্পর্কের বিষয়টি ক্রিয়েটিভিটি সফটওয়্যারের পক্ষে যায়নি বলে দাবি করা হয় প্রতিবেদনে। বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালে র‍্যাব এবং প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ।●